কৃষি ও কৃষক
চতুর্থ অধ্যায়
ইতিমধ্যে ৫০-এর মন্বন্তর নেমে এল বাংলাদেশের বুকে। খাদ্যের অভাবে দুর্ভিক্ষ ক্লিষ্ট কৃষকরা শহরে খাদ্যের সন্ধানে বের হল এবং এক বিশাল অংশের মানুষ গ্রামে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হল এবং এই দুর্ভিক্ষে সুন্দরবনের বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে ২৪ পরগণা এবং খুলনার কৃষকরা নিদারুণ দুর্দশার শিকার হল। ২৪ পরগণা খুলনা বরিশালের কৃষকরা মন্বন্তরের বছরেই শতকরা ৫ জন তাদের সমস্ত জমিজমা বিক্রয় করতে বাধ্য হয়েছিল আর শতকরা ৯.৭ শতাংশ আংশিকভাবে জমি বিক্রয় করতে বাধ্য হয়েছিল। এ সমস্ত জমি নামমাত্র মূল্যে এলাকার সুদখোর মহাজন ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়েছিল কিংবা ১০ বছরের জন্য খাইখালাসি চুক্তিতে অথবা অন্যভাবে জমি বন্ধক পড়ে গিয়েছিল। মন্বন্তরের বছরে সুন্দরবনের এসব ব্যবসায়ীরা চাষির ধান সস্তায় কিনে নিয়ে মজুত করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে এবং এই মুনাফা তারা জমিতে নিয়োগ করেছিল।
সুন্দরবনে অনেক বৃদ্ধ চাষি এখনও মন্বন্তরের দিনগুলির এই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে। মন্বন্তরের বছরে বা তার পরের বছরে দু’তিন বস্তা ধানের বিনিময়ে ১০/১২ বিঘা জমি বন্ধক দিতে বাধ্য হয়েছিল কিন্তু পরে সেই জমি আর ফিরিয়ে নিতে পারেনি -এ ধরনের অনেক অভিজ্ঞতা সুন্দরবনের কৃষকের জীবনের বাস্তব বিষয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের পক্ষ থেকে মন্বন্তর পরবর্তীকালে ডঃ এস. পি. চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ২৪ পরগণার ভূমি সদ্ব্যবহার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁরাও লক্ষ করেছিলেন ‘During the famine the Jotders turned trader cum Hoarder and became enormously rich.
মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও একদল মানুষ বিভিন্ন এলাকায় প্রভূত বিত্তের অধিকারী হয়েছিল সেযুগে। সন্দেশখালি থানার চুটকিয়ার জমাদার, মিনাখাঁর গোলদার, হাসনাবাদের খড়মপুরের মোল্লারা- এ ধরনের অসংখ্য ধনী পরিবারের উদ্ভব লক্ষ করা যায়।
মন্বন্তর পরবর্তীকালে গরিব চাষিরা লক্ষ্য করল তাদের সামনে সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে বর্গাদারদের তেভাগার অধিকারের কথা কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে চাষিদের সামনে তুলে ধরা হল। বাঙলার বিভিন্ন প্রান্তে খন্ড বিক্ষিপ্তভাবে চাষিরা আওয়াজ তুলল ‘তেভাগা চাই’। কৃষক সমিতি এবং কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন প্রগতিশীল ব্যক্তি বর্গাদার ও অন্যান্য স্তরের কৃষকদের নিয়ে আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল। সরকারের কাছে নানাভাবে আবেদন নিবেদন করা হল; শেষপর্যন্ত প্রত্যক্ষ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলার কৃষক সমাজ। অবিভক্ত বাংলার ১৯ টি জেলার ৫০ লক্ষ কৃষক এই আন্দোলনে সাড়া দিল।
৭০ জনের ওপর কৃষক শহীদ হল আহত হল ২০/২৫ হাজার কৃষক, ৫০ হাজারের ওপর কৃষককে বিভিন্ন কেসে জড়িয়ে গ্রেপ্তার করা হল। অনেক এলাকাতে মুক্ত এলাকা গড়ে তুলে কৃষকরা নিজেদের প্রশাসন চালু করল। গ্রাম থেকে সুদখোর মহাজন, বড় ব্যবসায়ী, জমিদারের অত্যাচারী নায়েব বরকন্দাজরা পালিয়ে গেল। থানাগুলি কৃষক বিক্ষোভের সামনে অনেক ক্ষেত্রে অসহায় দর্শকের ভূমিকা পালন করল- পুলিশ বুঝতে পারছিল দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে- সুতরাং আগামী দিনে দেশ কোন পথে চলবে তার হদিশ করতে না পেরে অত্যাচারী পুলিশ অফিসাররা এসময় একটু থমকে দাঁড়িয়েছিল এ ঘটনা সত্য। কিন্তু হাজার হাজার কৃষকের তুমুল বিক্ষোভের মুখে তাদের কিছু করারও ছিল না।