কৃষি ও কৃষক
চতুর্থ অধ্যায়
সুতরাং এসব আর্ত মানুষদের সাহায্য করার দায়িত্ব জমিদারদের নেবার আদেশ করলেন। ১৯৪৩-এ শুরু হল পঞ্চাশের মন্বন্তর এবং সরকার খাদ্যশস্যের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তুলে দিয়ে দেশকে চোরাকারবারি ও মজুতদারদের হাতে তুলে দিল। ভিটে মাটি সব কিছুই ক্ষুধার জ্বালায় বিক্রয় বা বন্ধক দিতে শুরু করল চাষিরা। হাজার হাজার চাষি খাদ্য-সংগ্রহ করতে না পেরে শহরের দিকে ছুটে চলল এবং সেদিন শহরে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল তারই জীবন্ত দলিল রচনা করেছেন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য তাঁর ‘নবান্ন’ নাটকে। মন্বন্তরের বছরে সরকারের পক্ষ থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকায় কয়েকটি রিলিফ ক্যাম্প খোলার ব্যবস্থা করা হল। তারই পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং কৃষকসমিতির পক্ষ থেকেও রিলিফ ক্যাম্প খোলার ব্যবস্থা করা হল। কমিউনিস্টরা এ সময়ে জনযুদ্ধের আওয়াজ তুলে সরকারি রিলিফের কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল এবং বিভিন্ন স্থানের রিলিফ ক্যাম্পের দায়িত্ব নেয়।
২৪ পরগনার ফলতার কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতিষ রায় কাকদ্বীপ ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব নেন। জ্যোতিষ রায় দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন জনহিতকর কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলতার স্কুল সংগঠনে তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল এবং দীর্ঘকাল স্কুলের সম্পাদক থাকাকালীন অনেক দুঃস্থ পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন। কাকদ্বীপ ক্যাম্পের কাজে সতীশ মাইতি আসেন তার মামা গুণধর মাইতিকে সঙ্গে নিয়ে। এই গুণধর মাইতি কাকদ্বীপ মথুরাপুরের মানুষের কাছে এখনও ‘মামা’ নামে পরিচিত। (১৭)
বন্যা ও মন্বন্তরের পর যারা বেঁচে রইল, কলকাতা ও বিভিন্ন শহর থেকে ফিরে এসে চাষের কাজে নামার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। চাষিদের গোরু নেই, লাঙল নেই অনেকের জমি মন্বন্তরের সময়ে চলে গেছে সেই সঙ্গে খোরাকি বীজধান কিছুই নেই এরকম নানা সমস্যায় অধিকাংশ চাষি বিপর্যস্ত। চাষিরা দলে দলে গ্রাম্য প্রধান নায়েব জোতদার মহাজন সকলের কাছে ছোটে নতুন করে ঋণ পাবার জন্য। বুধাখালি গ্রাম কাকদ্বীপের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় নাম, এখানে পরবর্তীকালে অহল্যা বাতাসী শহীদ হয়েছিল। বুধাখালি গ্রামের জমিদার মণীন্দ্র জানার অধীন চকদার বটকৃষ্ণ সাউ (বাড়ি ছিল কলকাতার জানবাজার) এর কাছে চাষিরা দল বেঁধে যায় বিগত বছরগুলির ঋণ মকুর করার জন্য এবং নতুন ভাবে কিছু ধান ঋণ পাবার জন্য। সে সময়ে বট সাউ- এর কাছারির তিনটি গোলায় প্রচুর ধান মজুত ছিল। চাষীরা সকলে বটসাউ এর পা জড়িয়ে ধরে সাহায্য প্রার্থনা করে ১৯৪৪ এর জৈষ্ঠ মাসের এক অপরাহ্ণে। চাষিদের তিনি বলেন ‘আমি পাষাণ, আমার হৃদয় গলবে না’। চাষিরা ফিরে এল শূন্য হাতে। সে সময়ে এ এলাকায় কোন সংগঠিত কৃষক আন্দোলন ছিল না।
বিভিন্ন এলাকায় রায়ত চাষিরা সংঘবদ্ধ হয়ে বিভিন্নভাবে জমিদার জোতদার ইজারাদারদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল। কমিউনিস্টরা ধীরে ধীরে সারা ভারত কৃষব সভার মধ্যে নিজেদের প্রভাব সংগঠিত করছিল। কৃষক আন্দোলনে কমিউনিস্টদের পাশাপাশি সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রান্তে অবশ্য কিছু জাতীয়তাবাদী কৃষকদরদী মানুষ কৃষকদের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করছিল আর এদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সোমেন ঠাকুরের আর.সি.পি.আই, কংগ্রেস নেতা মুরারিশরণ চক্রবর্তী এবং বলশেভিক পার্টির কৃষক কর্মীরা। ২৪ পরগনা জেলার কৃষকসমিতিতে নিত্যানন্দ চৌধুরী, প্রভাস রায়, হরিধন চক্রবর্তী, জ্যোতিষ রায়রা প্রধান ভূমিকা নিচ্ছিলেন। কাকদ্বীপের বুধাখালির গ্রামের এক দাওয়ায় বসে কৃষক সমিতির অশোক বসু, সতীশ মাইতি প্রমুখ কৃষক নেতারা অসহায় চাষিদের সেদিন বলেছিল ইজারাদার চকদাররা সকলে বট সাউ-এর ভাষায় কথা বলছে – জমিদার পাষাণ, এই পাষাণ গলে না টলে না পাষাণ আছাড় দিলে ভাঙে’।