০৬:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫
খরচ ও নিয়ন্ত্রণের চাপে ছোট ও দক্ষ এআই মডেলের দিকে ঝুঁকছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো শীতকালীন হামলা জোরদার হওয়ায় রাশিয়ার ভেতরে ড্রোন অভিযানে প্রস্তুতির ইঙ্গিত ইউক্রেনের চীনের পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট খাতে আইপিও সহজ করল বেইজিং, স্পেস প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকে টপকানোর বার্তা নতুন রেকর্ডে রুপা রাশিয়ার নতুন অর্থায়নে তুরস্কের পারমাণবিক স্বপ্নে গতি, আক্কুইউ প্রকল্পে এল ৯ বিলিয়ন ডলার মার্কিন আদালতের নির্দেশ মানার আহ্বান ভেনেজুয়েলানদের, এল সালভাদরের কারাগার থেকে ফেরত বন্দিদের আইনি লড়াই নাইজেরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় সহযোগিতা, একক মার্কিন সামরিক হুমকি এড়াল আবুজা চীনের নিষেধাজ্ঞার কড়া বার্তা, তাইওয়ান অস্ত্র বিক্রিতে মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থার ওপর চাপ রাশিয়ার ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কেঁপে উঠল কিয়েভ, সক্রিয় আকাশ প্রতিরক্ষা ট্রাম্পের সঙ্গে রোববার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে জেলেনস্কি, ভূমি ও নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিয়ে চূড়ান্ত সমঝোতার ইঙ্গিত

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৮৯)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৫০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪
  • 76

সন্ন্যাসী ঠাকুর

একদিন আমার বড় ভাই একখানা বেত লইয়া আমাকে এমন প্রহার করিলেন যে, আমার পিঠে হাতের আঙুলের মতো দশ-বারোটি দাগ পড়িয়া গেল। কোনো কোনো দাগে রক্ত উঠিয়া পিঠ লাল হইয়া গেল। আমি মাটিতে পড়িয়া বলির ছাগলের মতো আছাড়ি-পিছাড়ি করিতে লাগিলাম।

তারপর বহুক্ষণ চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া কাটিয়া মুখহাত মুছিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে আসিলাম। তখন আমার চক্ষের পানি শুকাইয়া গিয়াছে, কিন্তু তাহার দাগ মোছে নাই। সন্ন্যাসী ঠাকুর আমাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ তোমাকে এত বিমর্ষ দেখাইতেছে কেন?” তখন আমি আর কান্না সংবরণ করিতে পারিলাম না। কাঁদিতে কাঁদিতে পিঠের কাপড় তুলিয়া দেখাইলাম আর আনুপূর্বক সকল ঘটনা তাঁহাকে বলিলাম। আমার সমস্ত কাহিনী শুনিয়া তিনিও প্রায় কাঁদিয়া ফেলিলেন। আমার পিঠে হাত বুলাইয়া আমাকে শান্ত করিতে চেষ্টা করিলেন। ইহাতে আমার কান্না আরও বাড়িয়া গেল।

সেইদিন সন্ধ্যাবেলায় যখন শহর হইতে ভদ্রলোকেরা আসিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে উপস্থিত হইয়াছেন তাহাদের নিকট তিনি আমার প্রতি আমার বড় ভাইয়ের অমানুষিক অত্যাচারের কথা আনুপূর্বক সকল বলিলেন। সেই হইতে তাঁহার ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে আমি শহীদের মতো উচ্চ সম্মানের অধিকারী হইলাম।

ইহার পরে আমাকে সন্ন্যাসীর নিকট যাওয়া বন্ধ করিতে আমার বড় ভাই আরও অভিনব শাস্তির ব্যবস্থা করিলেন। কিন্তু ধ্রুব প্রহ্লাদের যে আদর্শবাদ আমার মনে স্থান পাইয়াছিল তাহারই বলে আমি সমস্ত অত্যাচার সহ্য করিলাম। মিথ্যা হৌক সত্য হৌক মানুষ যে-কোনো বস্তু লইয়াই বিশ্বাস স্থাপন করুক না কেন, অত্যাচার করিয়া, পীড়ন করিয়া কেহ তাহাকে সেই বিশ্বাস হইতে টলাইতে পারে না। আমার বড় ভাই যদি আমাকে ভালোবাসিয়া সেই সন্ন্যাসী ঠাকুরের চাইতে আরও স্নেহমমতার সঙ্গে আমাকে বুঝাইতে পারিতেন যে সন্ন্যাসীর কাছে যাওয়া আমার পক্ষে ভালো না, ইহাতে আমার ভবিষ্যৎ জীবনের ক্ষতি হইবে; তবে
হয়তো তিনি আমাকে সেখানে যাওয়া হইতে নিবৃত্ত করিতে পারিতেন। যুক্তি ছাড়িয়া যেখানেই কেহ শক্তির দন্তে অপরকে নত করিতে যায়, সাময়িকভাবে ইহাতে কিছুটা সাফল্য দেখা গেলেও সে সাফল্য শুধু বালুর উপরে লেখন লেখা, অল্প দিনেই মুছিয়া যায়।

আমার এই বড় ভাই অপরিণত বয়সে আমাকে এরূপ প্রহার করিয়া আমার যে ক্ষতি করিয়াছেন এমন ক্ষতি আমার কেহই করে নাই। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনায় আমার স্মরণশক্তি এমন প্রখর ছিল যে, বাড়িতে না পড়িয়া স্কুলে যাইয়া শুধুমাত্র দুই-একবার বই দেখিয়াই আমি শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করিতাম। কিন্তু অপরিণত বয়সে এইরূপ অমানুষিক প্রহারের ফলে ধীরে ধীরে আমি সেই শৈশবেই স্মরণশক্তি হারাইয়া ফেলিলাম।

এইজন্য যেমন আমার পাঠ্য-জীবনে তেমনি ভবিষ্যৎ-জীবনে স্মরণশক্তির অভাবে আমাকে বহু দুর্গতি সহ্য করিতে হইয়াছে।

 

চলবে…

 

জনপ্রিয় সংবাদ

খরচ ও নিয়ন্ত্রণের চাপে ছোট ও দক্ষ এআই মডেলের দিকে ঝুঁকছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৮৯)

১১:০০:৫০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪

সন্ন্যাসী ঠাকুর

একদিন আমার বড় ভাই একখানা বেত লইয়া আমাকে এমন প্রহার করিলেন যে, আমার পিঠে হাতের আঙুলের মতো দশ-বারোটি দাগ পড়িয়া গেল। কোনো কোনো দাগে রক্ত উঠিয়া পিঠ লাল হইয়া গেল। আমি মাটিতে পড়িয়া বলির ছাগলের মতো আছাড়ি-পিছাড়ি করিতে লাগিলাম।

তারপর বহুক্ষণ চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া কাটিয়া মুখহাত মুছিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে আসিলাম। তখন আমার চক্ষের পানি শুকাইয়া গিয়াছে, কিন্তু তাহার দাগ মোছে নাই। সন্ন্যাসী ঠাকুর আমাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ তোমাকে এত বিমর্ষ দেখাইতেছে কেন?” তখন আমি আর কান্না সংবরণ করিতে পারিলাম না। কাঁদিতে কাঁদিতে পিঠের কাপড় তুলিয়া দেখাইলাম আর আনুপূর্বক সকল ঘটনা তাঁহাকে বলিলাম। আমার সমস্ত কাহিনী শুনিয়া তিনিও প্রায় কাঁদিয়া ফেলিলেন। আমার পিঠে হাত বুলাইয়া আমাকে শান্ত করিতে চেষ্টা করিলেন। ইহাতে আমার কান্না আরও বাড়িয়া গেল।

সেইদিন সন্ধ্যাবেলায় যখন শহর হইতে ভদ্রলোকেরা আসিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে উপস্থিত হইয়াছেন তাহাদের নিকট তিনি আমার প্রতি আমার বড় ভাইয়ের অমানুষিক অত্যাচারের কথা আনুপূর্বক সকল বলিলেন। সেই হইতে তাঁহার ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে আমি শহীদের মতো উচ্চ সম্মানের অধিকারী হইলাম।

ইহার পরে আমাকে সন্ন্যাসীর নিকট যাওয়া বন্ধ করিতে আমার বড় ভাই আরও অভিনব শাস্তির ব্যবস্থা করিলেন। কিন্তু ধ্রুব প্রহ্লাদের যে আদর্শবাদ আমার মনে স্থান পাইয়াছিল তাহারই বলে আমি সমস্ত অত্যাচার সহ্য করিলাম। মিথ্যা হৌক সত্য হৌক মানুষ যে-কোনো বস্তু লইয়াই বিশ্বাস স্থাপন করুক না কেন, অত্যাচার করিয়া, পীড়ন করিয়া কেহ তাহাকে সেই বিশ্বাস হইতে টলাইতে পারে না। আমার বড় ভাই যদি আমাকে ভালোবাসিয়া সেই সন্ন্যাসী ঠাকুরের চাইতে আরও স্নেহমমতার সঙ্গে আমাকে বুঝাইতে পারিতেন যে সন্ন্যাসীর কাছে যাওয়া আমার পক্ষে ভালো না, ইহাতে আমার ভবিষ্যৎ জীবনের ক্ষতি হইবে; তবে
হয়তো তিনি আমাকে সেখানে যাওয়া হইতে নিবৃত্ত করিতে পারিতেন। যুক্তি ছাড়িয়া যেখানেই কেহ শক্তির দন্তে অপরকে নত করিতে যায়, সাময়িকভাবে ইহাতে কিছুটা সাফল্য দেখা গেলেও সে সাফল্য শুধু বালুর উপরে লেখন লেখা, অল্প দিনেই মুছিয়া যায়।

আমার এই বড় ভাই অপরিণত বয়সে আমাকে এরূপ প্রহার করিয়া আমার যে ক্ষতি করিয়াছেন এমন ক্ষতি আমার কেহই করে নাই। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনায় আমার স্মরণশক্তি এমন প্রখর ছিল যে, বাড়িতে না পড়িয়া স্কুলে যাইয়া শুধুমাত্র দুই-একবার বই দেখিয়াই আমি শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করিতাম। কিন্তু অপরিণত বয়সে এইরূপ অমানুষিক প্রহারের ফলে ধীরে ধীরে আমি সেই শৈশবেই স্মরণশক্তি হারাইয়া ফেলিলাম।

এইজন্য যেমন আমার পাঠ্য-জীবনে তেমনি ভবিষ্যৎ-জীবনে স্মরণশক্তির অভাবে আমাকে বহু দুর্গতি সহ্য করিতে হইয়াছে।

 

চলবে…