০৫:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫
খরচ ও নিয়ন্ত্রণের চাপে ছোট ও দক্ষ এআই মডেলের দিকে ঝুঁকছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো শীতকালীন হামলা জোরদার হওয়ায় রাশিয়ার ভেতরে ড্রোন অভিযানে প্রস্তুতির ইঙ্গিত ইউক্রেনের চীনের পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট খাতে আইপিও সহজ করল বেইজিং, স্পেস প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকে টপকানোর বার্তা নতুন রেকর্ডে রুপা রাশিয়ার নতুন অর্থায়নে তুরস্কের পারমাণবিক স্বপ্নে গতি, আক্কুইউ প্রকল্পে এল ৯ বিলিয়ন ডলার মার্কিন আদালতের নির্দেশ মানার আহ্বান ভেনেজুয়েলানদের, এল সালভাদরের কারাগার থেকে ফেরত বন্দিদের আইনি লড়াই নাইজেরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় সহযোগিতা, একক মার্কিন সামরিক হুমকি এড়াল আবুজা চীনের নিষেধাজ্ঞার কড়া বার্তা, তাইওয়ান অস্ত্র বিক্রিতে মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থার ওপর চাপ রাশিয়ার ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কেঁপে উঠল কিয়েভ, সক্রিয় আকাশ প্রতিরক্ষা ট্রাম্পের সঙ্গে রোববার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে জেলেনস্কি, ভূমি ও নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিয়ে চূড়ান্ত সমঝোতার ইঙ্গিত

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৯১)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৫৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪
  • 55

সন্ন্যাসী ঠাকুর

সেই চির-বন্ধুর হিমাচল পথে ভীষণ শীত। তাই আমাকে শীত জয় করিতে হইবে। শীতকালে কোনোরকম লেপ-কাঁথা গায়ে দেওয়া ত্যাগ করিলাম। শুইলে বেশি শীত করে বলিয়া কোঁচার খোঁট গায়ে দিয়া একটা তক্তায় হেলান দিয়া সারারাত আধঘুমে কাটাইতাম। সকাল হইলেই নদীতে যাইয়া স্নান করিয়া শীতে ঠির ঠির করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে আমার ঘরের আসনে বসিয়া নাভিমূলে চাহিয়া থাকিতাম। কিন্তু কোনোদিনই নাভিমূলে একটুকুও আলোকরশ্মি দেখিতে পাইলাম না। সন্ন্যাসী ঠাকুরের আর-আর শিষ্যেরা এরূপ সাধনা করিতে করিতে কত বিভূতি দেখিতে পাইতেন। বহুদূরে বসিয়া তাঁহারা যখন সাধনা করিতেন তখন অশরীরী হইয়া সন্ন্যাসী ঠাকুর তাঁহাদের দর্শন দিতেন। মাঝে মাঝে কালী দেবী আসিয়াও তাঁহাদের ধ্যানে উদয় হইতেন। তাঁহারা সুযোগ পাইলেই এইসব গল্প বলিতেন। আমি কিন্তু এত করিয়াও কিছুই দেখিতে পাইতাম না। মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছা হইত, বানাইয়া আমিও এরূপ দু’একটি গল্প ইহাদের কাছে বলি। কিন্তু শৈশব হইতেই আমার অন্ধ-দাদা দানু মোল্লার কাছে সত্য-ভাষণের যে শিক্ষা পাইয়াছিলাম তাহাই আমাকে এরূপ বানাইয়া বলা হইতে নিরস্ত করিল।

আমি পায়ে জুতা পরিতাম না। শীতকালে গরম জামাকাপড় কিনিয়া দেওয়ার যোগ্যতাও আমার পিতার ছিল না। স্কুলে যাওয়ার সময় একটি শার্ট বা পাঞ্জাবি আর শীতকালে সূতার একটি লাল আলোয়ান বাজান কিনিয়া দিতেন। সেই আলোয়ানও আমি বর্জন করিলাম। এরূপ কৃষ্ণ সাধনা করিতে করিতে আমার প্রায়ই সর্দি কাশি হইতে লাগিল। গলার টনসিল ফুলিয়া গেল কিন্তু কিছুই আমাকে এই কৃষ্ণ-সাধনা হইতে টলাইতে পারিল না।

সন্ন্যাসী ঠাকুরের আশ্রমে আসিলে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট যেন আমার মন হইতে মুছিয়া যাইত। তিনি আমার কৃচ্ছু-সাধনার কাহিনী আরও ফেনাইয়া-ফাঁপাইয়া তাঁহার শিষ্য-ভক্তমণ্ডলীকে বলিতেন। তাঁহারাও কেহ কেহ আমার বড়ই অনুরক্ত হইয়া পড়িলেন। একজন শিষ্য একদিন আমাকে এক বনের মধ্যে লইয়া গিয়া আমার পা ধরিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। আমি বিহ্বল হইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলাম। পরে তিনি আমার হাত দুইটি ধরিয়া বলিলেন, “জসীম। তুমি বল, যখন স্বর্গে যাইবে, আমাকে সঙ্গে না লইয়া যাইবে না।” তাঁহার সেই কান্না দেখিয়া আগেই আমি কিছুটা ভয় পাইয়াছিলাম। আমি সহজেই বলিলাম, “আমি আপনাকে সঙ্গে না লইয়া স্বর্গে যাইব না।” ভদ্রলোক আমাকে লইয়া বনের বাহির হইয়া আসিলেন। আরও একদিন সন্ন্যাসী ঠাকুর তাঁহার ভক্তমণ্ডলীকে বলিলেন, “আমার যা কিছু সাধন-প্রণালী, এই জসীমকে শিখাইয়া দিয়াছি। সে সাধনা করিবার সময় তোমাদের চাইতে আরও অনেক ভালো ভালো বিভূতি দেখিতে পায়।”

সন্ন্যাসী ঠাকুরের শিষ্যদের মধ্যে জলধর চক্রবর্তী নামে একজন মোক্তার ছিলেন। একদিন তিনি আমাকে তাঁর বাসায় ডাকিয়া লইয়া গিয়া বৈঠকখানার জানালা দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া বলিলেন, “বল্ জসীম। বাবা তোকে কি কি সাধন-প্রণালী শিখাইয়াছেন?” আসন করিয়া নাভিমূলে চাহিয়া থাকা, একটি কালো ফোঁটার দিকে একদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকা, আর কাকের মতো ঠোঁট সরু করিয়া নিশ্বাস লইয়া নাক দিয়া ছাড়িয়া দেওয়া প্রভৃতি আমি সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে যাহা যাহা শিখিয়াছিলাম তাঁহাকে বলিলাম। তিনি জেরা করিতে লাগিলেন, “আর কি কি শিখিয়াছিস আমাকে বল্।” আমি উত্তর করিলাম, “সন্ন্যাসী ঠাকুর আমাকে আর কিছুই শেখান নাই।”

তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুই সাধনা করিবার সময় কি কি বিভূতি দেখিয়াছিস আমাকে বল?” বিভূতি মানে সাধন-অবস্থায় সাধক নানা জিনিস দেখিতে পান। তিনি মাঝে মাঝে অনেক ঐন্দ্রজালিক শক্তির অধিকারীও হন।

 

চলবে…

 

 

জনপ্রিয় সংবাদ

খরচ ও নিয়ন্ত্রণের চাপে ছোট ও দক্ষ এআই মডেলের দিকে ঝুঁকছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৯১)

১১:০০:৫৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

সন্ন্যাসী ঠাকুর

সেই চির-বন্ধুর হিমাচল পথে ভীষণ শীত। তাই আমাকে শীত জয় করিতে হইবে। শীতকালে কোনোরকম লেপ-কাঁথা গায়ে দেওয়া ত্যাগ করিলাম। শুইলে বেশি শীত করে বলিয়া কোঁচার খোঁট গায়ে দিয়া একটা তক্তায় হেলান দিয়া সারারাত আধঘুমে কাটাইতাম। সকাল হইলেই নদীতে যাইয়া স্নান করিয়া শীতে ঠির ঠির করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে আমার ঘরের আসনে বসিয়া নাভিমূলে চাহিয়া থাকিতাম। কিন্তু কোনোদিনই নাভিমূলে একটুকুও আলোকরশ্মি দেখিতে পাইলাম না। সন্ন্যাসী ঠাকুরের আর-আর শিষ্যেরা এরূপ সাধনা করিতে করিতে কত বিভূতি দেখিতে পাইতেন। বহুদূরে বসিয়া তাঁহারা যখন সাধনা করিতেন তখন অশরীরী হইয়া সন্ন্যাসী ঠাকুর তাঁহাদের দর্শন দিতেন। মাঝে মাঝে কালী দেবী আসিয়াও তাঁহাদের ধ্যানে উদয় হইতেন। তাঁহারা সুযোগ পাইলেই এইসব গল্প বলিতেন। আমি কিন্তু এত করিয়াও কিছুই দেখিতে পাইতাম না। মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছা হইত, বানাইয়া আমিও এরূপ দু’একটি গল্প ইহাদের কাছে বলি। কিন্তু শৈশব হইতেই আমার অন্ধ-দাদা দানু মোল্লার কাছে সত্য-ভাষণের যে শিক্ষা পাইয়াছিলাম তাহাই আমাকে এরূপ বানাইয়া বলা হইতে নিরস্ত করিল।

আমি পায়ে জুতা পরিতাম না। শীতকালে গরম জামাকাপড় কিনিয়া দেওয়ার যোগ্যতাও আমার পিতার ছিল না। স্কুলে যাওয়ার সময় একটি শার্ট বা পাঞ্জাবি আর শীতকালে সূতার একটি লাল আলোয়ান বাজান কিনিয়া দিতেন। সেই আলোয়ানও আমি বর্জন করিলাম। এরূপ কৃষ্ণ সাধনা করিতে করিতে আমার প্রায়ই সর্দি কাশি হইতে লাগিল। গলার টনসিল ফুলিয়া গেল কিন্তু কিছুই আমাকে এই কৃষ্ণ-সাধনা হইতে টলাইতে পারিল না।

সন্ন্যাসী ঠাকুরের আশ্রমে আসিলে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট যেন আমার মন হইতে মুছিয়া যাইত। তিনি আমার কৃচ্ছু-সাধনার কাহিনী আরও ফেনাইয়া-ফাঁপাইয়া তাঁহার শিষ্য-ভক্তমণ্ডলীকে বলিতেন। তাঁহারাও কেহ কেহ আমার বড়ই অনুরক্ত হইয়া পড়িলেন। একজন শিষ্য একদিন আমাকে এক বনের মধ্যে লইয়া গিয়া আমার পা ধরিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। আমি বিহ্বল হইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলাম। পরে তিনি আমার হাত দুইটি ধরিয়া বলিলেন, “জসীম। তুমি বল, যখন স্বর্গে যাইবে, আমাকে সঙ্গে না লইয়া যাইবে না।” তাঁহার সেই কান্না দেখিয়া আগেই আমি কিছুটা ভয় পাইয়াছিলাম। আমি সহজেই বলিলাম, “আমি আপনাকে সঙ্গে না লইয়া স্বর্গে যাইব না।” ভদ্রলোক আমাকে লইয়া বনের বাহির হইয়া আসিলেন। আরও একদিন সন্ন্যাসী ঠাকুর তাঁহার ভক্তমণ্ডলীকে বলিলেন, “আমার যা কিছু সাধন-প্রণালী, এই জসীমকে শিখাইয়া দিয়াছি। সে সাধনা করিবার সময় তোমাদের চাইতে আরও অনেক ভালো ভালো বিভূতি দেখিতে পায়।”

সন্ন্যাসী ঠাকুরের শিষ্যদের মধ্যে জলধর চক্রবর্তী নামে একজন মোক্তার ছিলেন। একদিন তিনি আমাকে তাঁর বাসায় ডাকিয়া লইয়া গিয়া বৈঠকখানার জানালা দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া বলিলেন, “বল্ জসীম। বাবা তোকে কি কি সাধন-প্রণালী শিখাইয়াছেন?” আসন করিয়া নাভিমূলে চাহিয়া থাকা, একটি কালো ফোঁটার দিকে একদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকা, আর কাকের মতো ঠোঁট সরু করিয়া নিশ্বাস লইয়া নাক দিয়া ছাড়িয়া দেওয়া প্রভৃতি আমি সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে যাহা যাহা শিখিয়াছিলাম তাঁহাকে বলিলাম। তিনি জেরা করিতে লাগিলেন, “আর কি কি শিখিয়াছিস আমাকে বল্।” আমি উত্তর করিলাম, “সন্ন্যাসী ঠাকুর আমাকে আর কিছুই শেখান নাই।”

তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুই সাধনা করিবার সময় কি কি বিভূতি দেখিয়াছিস আমাকে বল?” বিভূতি মানে সাধন-অবস্থায় সাধক নানা জিনিস দেখিতে পান। তিনি মাঝে মাঝে অনেক ঐন্দ্রজালিক শক্তির অধিকারীও হন।

 

চলবে…