চট্টগ্রামে সম্মিলিত সনাতনী জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন ঘিরে সংঘর্ষে একজন আইনজীবী হত্যার ঘটনার পর তার পক্ষে কোন আইনজীবী অংশ নেবে না বলে চট্টগ্রামের আইনজীবী সমিতি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাকে ‘প্রফেশনাল এথিকস’ বা পেশাগত নীতির এর চরম লঙ্ঘন বলে বর্ণনা করছেন আইনের শিক্ষক ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা।
চট্টগ্রামের আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক বিবিসি বাংলাকে বলেন, ” আমরা আমাদের আইনজীবী সমিতির সদস্যদেরকে অনুরোধ করেছি যাতে আমাদের সদস্যের এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে যাতে লিগ্যাল এইড অপোজিট পার্টিকে না দেয়া হয়”।
তবে ঢাকা বা চট্টগ্রাম বা অন্য জেলা থেকে আইনজীবী এসে অভিযুক্তদের আইনি সহায়তা দিতে পারবেন বলে জানান তিনি।
তবে এ ধরনের সিদ্ধান্তকে ‘পেশাগত নীতি’ এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে বর্ণনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান।
তবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আইনজীবী না পেলে বা আইনজীবী গ্রহণে অসমর্থ হলে রাষ্ট্রের তরফ থেকে আইনজীবী দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এখনো চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মামলা বা আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যা মামলা সেই পর্যায়ে যায়নি। সরকারি আইনজীবীর জন্য কোন অনুরোধও আসেনি।
কিন্তু আইনজীবীদের সমিতির পক্ষ থেকে কাউকে আইনি সহায়তা না দেয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আইনের দিক থেকে কতটা ঠিক?

চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ
‘প্রফেশনাল এথিকসের ভায়োলেশন হচ্ছে’
গত তেসরা ডিসেম্বর সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন শুনানিতে মামলা, হামলা এবং প্রাণনাশের হুমকির মুখে কোনো আইনজীবীকে তার পক্ষে আদালতে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছিল।
সেদিন মহানগর আদালতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন শুনানির তারিখ থাকলেও তার পক্ষে কোন আইনজীবী না থাকায় শুনানি হয়নি। সেদিন অবশ্য চিন্ময় দাসকে আদালতে হাজির করা হয়নি।
এমন প্রেক্ষাপটে ওইদিন জামিন আবেদনের শুনানি এক মাস (দোসরা জানুয়ারি) পিছিয়ে দেয় চট্টগ্রামের মহানগর দায়রা জজ আদালত।
এর মধ্যে সোমবার (নয়ই ডিসেম্বর ) চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির নেতারা এক সংবাদ সম্মেলনে সেখানকার কোন আইনজীবী আসামিদের পক্ষে মামলায় শুনানি না করার কথা জানান।
সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন জানান, কোর্ট আইনজীবী দিতে পারেন অথবা আসামি-পক্ষ বাইরে থেকে আইনজীবী আনতে পারেন। এতে তাদের বাধা থাকবে না।
আলিফ হত্যা মামলায় এখনো পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির কোনো আইনজীবী অংশগ্রহণ করেন নি বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
ওই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট অন্য দুইটি মামলাতে আইনজীবী ওকালতনামা দিলেও তা পরে প্রত্যাহার করেছিল বলে জানানো হয়।
এর আগে গত পাঁচই ডিসেম্বর বিবিসি বাংলাকে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন জানিয়েছিলেন, “সমিতির পক্ষ থেকে আমরা অনুরোধ করেছি আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ড ও এই সংক্রান্ত অন্য মামলাগুলোতে যেন কোনো আইনজীবী আসামিদের পক্ষে যেন না দাঁড়ান। বিশেষ করে হত্যা মামলাতে অংশ না নিতে আমরা বেশি বলছি।”
আইনজীবীরা বলছেন এ ধরনের সিদ্ধান্ত যেমন আইনের শাসনের পরিপন্থী তেমনি ‘প্রফেশনাল এথিকসের’ ও লঙ্ঘন হচ্ছে এতে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহবুব শফিক চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির এ পদক্ষেপ আইনগতভাবে সঠিক হয়েছে কিনা সে বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন।
তিনি বলেন, “এটা আইনগতভাবে কি খুব সঠিক হলো? একটা বেসিক প্রিন্সিপ্যাল হলো প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে নিজেকে আইনজীবীর মাধ্যমে ডিফেন্ড করার। আইনজীবীর দায়িত্ব হলো একজন মানুষকে ডিফেন্ড করা। এরকম সিদ্ধান্ত আইনের শাসনের পরিপন্থী”।
” শুধু তাই নয়, আমাদের প্রফেশনাল যে এথিকস আছে সেটারও কিন্তু ভায়োলেশন হচ্ছে। আমি কাউকে আটকাতে পারবো না। এটি বেসিক আইনের শাসন, ন্যাচারাল জাস্টিস যেটা বলি তার পরিপন্থী হচ্ছে বিষয়টি। এরকম জিনিস আমরা এক্সপেক্ট করি না” বলেন মি. মাহবুব।
আইনি সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আসামির মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে জানিয়ে মি. মাহবুব বলেন, “এটা নিশ্চিত করবেন একজন আইনজীবী। সেই আইনজীবী যেই এসোসিয়েশনের সদস্য, সেই এসোসিয়েশন আইনি সহায়তা দেয়া থেকে আটকাবে এটা আইনের পরিপন্থী একটা সিদ্ধান্ত হলো।”
মি. মাহবুব মনে করেন বাহির থেকে অন্য আইনজীবী গেলেও তারা নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
আইনজীবীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি আদালতের দায়িত্ব বলে জানান তিনি।
“এটা কোর্টের দায়িত্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আসামির যেমন নিরাপত্তার ব্যাপার আছে, আইনজীবী অফিসার অব দ্যা কোর্ট। কোর্টের ডিউটি আইনজীবীর সুরক্ষা করা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সে কাকে ডিফেন্ড করছে সেটা কোন বিষয় না। একজন খুনিও যদি আমার কাছে আসে আমার রাইট আছে তাকে ডিফেন্ড করার। আইনজীবী হিসেবেও নিরাপত্তা পাওয়ার আমার অধিকার আছে” বলেন মি. মাহবুব।
বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে প্রধান বিচারপতি এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আইনানুযায়ী কোন আসামির পক্ষে কোন আইনজীবী কাজ করবেন না এমন হলে সরকার নিজ খরচে তাকে আইনজীবী দিতে বাধ্য বলে জানান মি. মাহবুব।
আইনজীবী হিসেবে মি. মাহবুব মনে করেন, “একজন আইনজীবী মারা গেছেন সে কারণে হত্যা মামলা হবে, অভিযুক্ত কাউকে পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু তাই বলে ল’ইয়ার একজন মারা গেছেন দেখে আসামি পক্ষে কোন আইনজীবী দাঁড়াতে পারবে না এটা আইনের পরিপন্থী”।
তবে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মফিজুল হক ভুঁইয়া বিবিসিকে জানান, “মামলা বিচার পর্যায়ে গেলে স্টেট ডিফেন্স দেয়া হয়। এসব মামলাগুলো এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এখন কোন আসামি চাইলে নিশ্চয়ই লিগ্যাল এইড দেয়া হবে”।

আইনজীবী হত্যার বিচার দাবিতে বিক্ষোভ করে চট্টগ্রামের আইনজীবীরা
‘সাংবিধানিক অধিকারের লঙ্ঘন’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান বলছেন, বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক সময় ন্যায় বিচার বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ ওঠে।
বিবিসি বাংলাকে অধ্যাপক রহমান বলেন, “যদি কোন সেনসিটিভ মামলা হয়, রাষ্ট্রের ভেতরে যে প্রবণতা- সরকার যদি কোন ব্যাপারে বৈরি হয়, তখন দেখা যায় বিচারক, আইনজীবীরা সরকারের ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য এমন কিছু করেন যেটা মানবাধিকার ও আইনের লঙ্ঘন।”
তিনি ২০১৯ সালে বরগুনায় রিফাত হত্যার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, সেই সময় সেখানকার আইনজীবীরা এভাবে ঘোষণা দিয়েছিল যে, তারা অভিযুক্ত নারীকে কোন আইনি সহায়তা দেবে না। পরে ঢাকা থেকে আইনজীবীদের একটি দল সেখানে গিয়ে তাকে সহায়তা দেন।
চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির এ পদক্ষেপে তারা শপথ ভঙ্গ করেছেন বলেও মনে করেন আইনের এই শিক্ষক।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “মানুষকে আইনি প্রতিকার দেয়ার জন্য তিনি বার কাউন্সিলের সনদ নিয়েছেন। যদি ব্যক্তিগতভাবে কাউকে আইনি প্রতিকার না দেন তবে তিনি বিরত থাকবেন”।
“কিন্তু প্রকাশ্যে আইনজীবী সমিতি কিংবা কোন আইনজীবী এটা বলতে পারেন না। যদি সমিতি এটা করে থাকে তাহলে রীতিমত আইন লঙ্ঘন করেছে। সেই সাথে যাদের জামিনকে তারা বাধাগ্রস্ত করছে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং তাদের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে” বলছেন অধ্যাপক রহমান।
এই শিক্ষকের মতে, যারা চট্টগ্রামে আইন বিষয়ে প্রাকটিস করছেন তাদের জন্য যতটা সহজ অন্য জায়গা থেকে কোন আইনজীবী যেতে পারলেও বিষয়টি তাদের জন্য ঝামেলা পূর্ণ হতে পারে।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন আইন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সিদ্ধান্তকে অবৈধ হিসেবে অভিহিত করেন।
“এবসলিউটলি ইল্লিগ্যাল (একেবারেই অবৈধ)। সংবিধানেই বলা আছে সবার আইনি অধিকার আছে। আইনজীবী সমিতিগুলো কিভাবে এ সিদ্ধান্ত নেয় এটাই ভাবার বিষয়” বলেন তিনি।
বাইরে থেকে আইনজীবী আনলেও তাকে সেখানে কোন আসামির পক্ষে শুনানি করতে দেয়া হবে কি না সে বিষয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।

মামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি
সম্মিলিত সনাতনী জোটের মুখপাত্র চিন্ময় দাসের জামিনকে ঘিরে সংঘর্ষ ও আইনজীবী হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচটি মামলা হয়েছে।
এর মধ্যে ৩০শে নভেম্বর রাতে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় নিহত আইনজীবীর পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা করা হয়েছে।
আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
আইনজীবী ও বিচার প্রার্থীদের ওপর হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ এবং গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে ১১৬ জনের বিরুদ্ধে হয়েছে একটি মামলা। এ মামলায় আসামিদের মধ্যে ৭০ জন আইনজীবী এবং দুজন সাংবাদিকও রয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে সনাতনী সম্মিলিত জাগরণ জোট।
বিস্ফোরক আইনের এ মামলায় চিন্ময় দাসের জামিন আবেদনকারী আইনজীবী শুভাশীষ শর্মাসহ জ্যেষ্ঠ অনেক হিন্দু আইনজীবীকে আসামি করা হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেছে।
এছাড়া পুলিশের কাজে বাধাদান, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় হয়েছে তিনটি মামলা।
মঙ্গলবার পুলিশের ওপর হামলার মামলায় গ্রেফতার আটজনের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
পুলিশ জানিয়েছে, এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১২/১২ জনের নাম উল্লেখ করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন গ্রেফতারকৃতদের একজন।
হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আসামি নিজেকে জড়িত করে ১০-১২ জনের নাম দিয়েছে। এসব তথ্য আমরা যাচাই বাছাই করছি। আরও তিন জনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।”
বিবিসি নিউজ বাংলা
Sarakhon Report 


















