সন্ন্যাসী ঠাকুর
দিদি নিজের হাতে কলাপাতার উপর ভাত, পটল-ভর্তা, আলু-ভর্তা বাড়িয়া দিতেন। এক পাশে একটু বি ডালিয়া দিতেন। একটা মুসলমান ছেলেকে বাড়ির বউঝিরা এমন করিয়া খাওয়ায়, ইহা দিদির দুই ভাশুর হলধরবাবু আর গঙ্গাপ্রসাদবাবু পছন্দ করিতেন না। একবার আমাকে শুনাইয়াই তাঁহারা দিদিকে একথা-সেকথা বলিলেন। ইহাতে দিদির সুন্দর মুখখানা ভালো হইয়া গেল। সেই হইতে দিদির ওখানে আর খাইতে চাহিতাম না। দেখা হইলে দিদি তবু আমাকে জোর করিয়া এটা-ওটা খাওয়াইতেন।
সন্ন্যাসী ঠাকুরের আর এক ভক্ত ছিলেন মালখা নগরের সুহৃদ বসু মহাশয়। তিনি ফরিদপুর সেটেলমেন্ট অফিসে বড় চাকুরি করিতেন। এই ভদ্রলোকের সাধু-সন্ন্যাসীর প্রতি ছিল অগাধ ভক্তি। হিন্দু মুসলমান যেখানে যে-কোনো সাধু দেখিতেন তাঁহাকে ডাকিয়া আনিয়া তিনি বাড়িতে রাখিতেন; আমিরি-হালে আহার করাইতেন, আর সাধুরা যখন যাহা চাহিতেন আনিয়া দিতেন। এই সুহৃদ-দার বাড়িতেও আমি মাঝে মাঝে যাইতাম। সুহৃদদার মা আদর করিয়া আমাকে খাওয়াইতেন। রানীদিদিদের বাড়ির মতো এখানে ছোঁয়াছুঁয়ির বাছবিচার ছিল না।
সুহৃদদার স্ত্রী আমাদের বৌদিদি ছিলেন উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মেয়েটি। পাতলা একহারা চেহারা। গাভরা যেন সোহাগ ঝলমল করিত। শাশুড়ির আদেশে তিনিই আমাকে খাইতে দিতেন। আমার এঁটো থালা গেলাস বৌদি নিজেই পরিষ্কার করিতেন। সুহৃদদার বোন সাধনদিদি শ্বশুরবাড়ি হইতে বেড়াইতে আসিতেন। তিনিও আমাকে বড়ই স্নেহ করিতেন। এই বাড়িটি আমার নিজের বাড়ি বলিয়া মনে হইত। সন্ন্যাসী ঠাকুরও মাঝে মাঝে এখানে আসিতেন। সেদিন সুহৃদদার বাসায় উৎসব পড়িয়া যাইত।
ফরিদপুর হইতে সেটেলমেন্ট অফিস উঠিয়া গেল। তারপর সুহৃদদারা যে কোথায় চলিয়া গেলেন সেই বয়সে খোঁজ লইতে পারি নাই। হয়তো তাঁহারা ফরিদপুর জেলা হইতে অন্য জেলায় চলিয়া গিয়াছিলেন। ইহার বহু বৎসর পর আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি তখন মালখা নগরের কোনো কোনো লোকের নিকট সুহৃদদার খবর জানিতে চেষ্টা করি। পরলোকগত নলিনী ভট্টশালী মহাশয়ের নিকট শুনিলাম সুহৃদদা সেটেলমেন্টের সেই বড় চাকরিটি ছাড়িয়া সন্ন্যাসী হইয়া নানা দেশে ঘুরিয়াছেন।
আগের সঞ্চিত টাকা-পয়সা কিছুই নাই। বর্তমানে বিবাহের ঘটকালি করিয়া সংসার চালান। একদিন আমি বাসায় আসিয়া দেখি একজন সন্ন্যাসী আমার বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। তিনি আমাকে দেখিয়া বলিলেন, “জসী। আমাকে চিনতে পার?” আমি বলিলাম, “না তো!” তিনি বলিলেন, “আমি তোমার সুহৃদদা।”
আমার দুইচোখ বাহিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। এই সেই সাহেব-বেশধারী মিঃ সুহৃদ বোস। ব্যাটবল খেলার মাঠে যাঁর সুনামে দিদিগন্ত মুখরিত হইত। যাঁর দানের অন্ত ছিল না। আজ তাঁর এই জীর্ণ ভিখারির বেশ। আমি দাদার পদধূলি লইয়া একে একে সকলের কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, “মা কেমন আছেন-বৌদি কেমন আছেন? সাধনদিদি কোথায়? আপনার ছোট বোনটি-ভজন কোথায়?” দাদা বলিলেন, “সবাই ভালো আছে। তুমি একবার চল আমার ওখানে। অনেককেই দেখিতে পাইবে।”
চলবে…