০৯:০৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১১৮)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৫
  • 17

ফরিদপুর জেলা স্কুলে

গনি মিঞা সাহেব অনড়। তিনি বলিলেন, “ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ছয়টি মুসলমান ছাত্রকেই ভর্তি করিতে আদেশ দিয়াছেন। আপনার যদি সাহস থাকে তাঁহার আদেশ অমান্য করুন।”

“কি বলেন খানবাহাদুর। আদেশ অমান্যের কথা তো আমি বলিতেছি না। আমরা একটি আপোসে আসিতে চাহিয়াছিলাম। তা আপনি যখন বলিতেছেন, ছয়জনকেই লইব।” গনি মিঞা সাহেব চলিয়া গেলেন। হেডমাস্টার মহাশয় আমাকে আর আমার ভাই

নেহাজউদ্দীনকে কয়েকটি প্রশ্ন করিয়া একটি খাতায় উত্তর লিখিতে বলিলেন। খারাপ হাতের লেখার জন্য আজ পর্যন্তও আমি প্রসিদ্ধ। প্রশ্নের উত্তর লেখা হইলে হেডমাস্টার নেহাজউদ্দীনের খাতা পড়িয়া তাহাকে ভর্তির উপযুক্ত বলিয়া স্থির করিলেন। আমার খাতাখানায় একটু নজর দিয়াই তিনি ছুড়িয়া ফেলিয়া দিলেন। আমার পিতাকে বলিলেন, “আপনার কোনো ছেলেই পড়াশুনায় কাজের না।

একে ফিরাইয়া লইয়া যান। ভর্তি করিতে পারিব না।” ইতিপূর্বে আমার বড় ভাই এই স্কুলে ভর্তি হইয়া সপ্তম শ্রেণীতে উঠিয়াই পড়াশুনা ছাড়িয়া দিয়াছিলেন, হেডমাস্টারের তাহা মনে আছে। আমার পিতা কত অনুনয়-বিনয় করিলেন। হেডমাস্টার মহাশয়ের মতের পরিবর্তন হইল না। তারপর অনেকক্ষণ পরে হয়তো ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের হুকুমের কথা তাঁহার মনে পড়িল। তিনি আমাকে আবার কতকগুলি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি তাহার যথাযথ উত্তর দিতে পারিলাম। তিনি আমাকে ভর্তি করিয়া লইলেন।

পরদিন ক্লাসে আসিয়া বসিলাম। সন্ন্যাসীর ভক্ত হইয়া আমি পায়ে জুতা পরিতাম না। পাড়হীন সাদা কাপড় করিতাম। ক্লাসের ছাত্ররা প্রায় সকলেই শহরবাসী। অনেকেরই পিতার অবস্থা ভালো। রংবেরঙের জামা পরিয়া, নানা রকমের জুতা পায়ে দিয়া তাহারা স্কুলে আসিত।

আমাকে তাহারা গ্রামা-ভূতের মতোই মনে করিল। আমি কাহারও কাছে যাইয়া বসিলে সে অন্যত্র যাইয়া বসে। শত চেষ্টা করিয়াও কাহারও সঙ্গে ভাব জমাইতে পারি না। আমার ইচ্ছা হইত ক্লাসে যে ফার্স্ট হয় তাহার সঙ্গে ভাব করি। তাহার সঙ্গে ভাব হইলে তাহার নিকট হইতে ক্লাসের পড়াটা ভালো করিয়া শিখিয়া লইব। ছুটির পর কতদিন তাহার বাড়ি পর্যন্ত গিয়াছি। সে আমার সঙ্গে একটিও কথা বলে নাই।

ক্লাসের বন্ধুদের অবহেলায় নিজের প্রতিও আমার মনে একটি অবহেলার ভাব আসিল। ক্লাসের অন্যান্য ছেলেরা যেমন সদাচঞ্চল হইয়া ঘুরিত ফিরিত, আমি অতি সঙ্কোচে পিছনের বেঞ্চে আমার চাচাতো ভাই নেহাজউদ্দীনের সঙ্গে জড়সড় হইয়া বসিয়া থাকিতাম। শিক্ষকেরা অন্যান্য ছাত্রদের লইয়া কত হাসি-তামাশা করিতেন। এটা-ওটা প্রশ্ন করিতেন। আমাদিগকে কিছুই জিজ্ঞাসা করিতেন না।

কিছুদিন পরে জোরের সঙ্গে ক্লাসের পড়াশুনা আরম্ভ হইল। শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সঙ্গে উপর-নিচ হওয়ার প্রথা প্রবর্তিত হইল। অঙ্কে, বাংলায়, ইতিহাসে, ভূগোলে আমি ভালো পড়া বলিতে পারিতাম। ধীরে ধীরে আমি সামনের বেঞ্চের দিকে আসিতে লাগিলাম। ইংরেজির ক্লাসে আবার নামিয়া যাইতে লাগিলাম। অঙ্কের ক্লাসে কোনো কোনো দিন প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিতাম। আমার দুই পাশের ভাগ্যবানদের ছেলেরা আমার ছোঁয়া বাঁচাইয়া যথেষ্ট ফাঁক রাখিয়া সরিয়া বসিত।

 

চলবে…

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১১৮)

১১:০০:২২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৫

ফরিদপুর জেলা স্কুলে

গনি মিঞা সাহেব অনড়। তিনি বলিলেন, “ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ছয়টি মুসলমান ছাত্রকেই ভর্তি করিতে আদেশ দিয়াছেন। আপনার যদি সাহস থাকে তাঁহার আদেশ অমান্য করুন।”

“কি বলেন খানবাহাদুর। আদেশ অমান্যের কথা তো আমি বলিতেছি না। আমরা একটি আপোসে আসিতে চাহিয়াছিলাম। তা আপনি যখন বলিতেছেন, ছয়জনকেই লইব।” গনি মিঞা সাহেব চলিয়া গেলেন। হেডমাস্টার মহাশয় আমাকে আর আমার ভাই

নেহাজউদ্দীনকে কয়েকটি প্রশ্ন করিয়া একটি খাতায় উত্তর লিখিতে বলিলেন। খারাপ হাতের লেখার জন্য আজ পর্যন্তও আমি প্রসিদ্ধ। প্রশ্নের উত্তর লেখা হইলে হেডমাস্টার নেহাজউদ্দীনের খাতা পড়িয়া তাহাকে ভর্তির উপযুক্ত বলিয়া স্থির করিলেন। আমার খাতাখানায় একটু নজর দিয়াই তিনি ছুড়িয়া ফেলিয়া দিলেন। আমার পিতাকে বলিলেন, “আপনার কোনো ছেলেই পড়াশুনায় কাজের না।

একে ফিরাইয়া লইয়া যান। ভর্তি করিতে পারিব না।” ইতিপূর্বে আমার বড় ভাই এই স্কুলে ভর্তি হইয়া সপ্তম শ্রেণীতে উঠিয়াই পড়াশুনা ছাড়িয়া দিয়াছিলেন, হেডমাস্টারের তাহা মনে আছে। আমার পিতা কত অনুনয়-বিনয় করিলেন। হেডমাস্টার মহাশয়ের মতের পরিবর্তন হইল না। তারপর অনেকক্ষণ পরে হয়তো ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের হুকুমের কথা তাঁহার মনে পড়িল। তিনি আমাকে আবার কতকগুলি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি তাহার যথাযথ উত্তর দিতে পারিলাম। তিনি আমাকে ভর্তি করিয়া লইলেন।

পরদিন ক্লাসে আসিয়া বসিলাম। সন্ন্যাসীর ভক্ত হইয়া আমি পায়ে জুতা পরিতাম না। পাড়হীন সাদা কাপড় করিতাম। ক্লাসের ছাত্ররা প্রায় সকলেই শহরবাসী। অনেকেরই পিতার অবস্থা ভালো। রংবেরঙের জামা পরিয়া, নানা রকমের জুতা পায়ে দিয়া তাহারা স্কুলে আসিত।

আমাকে তাহারা গ্রামা-ভূতের মতোই মনে করিল। আমি কাহারও কাছে যাইয়া বসিলে সে অন্যত্র যাইয়া বসে। শত চেষ্টা করিয়াও কাহারও সঙ্গে ভাব জমাইতে পারি না। আমার ইচ্ছা হইত ক্লাসে যে ফার্স্ট হয় তাহার সঙ্গে ভাব করি। তাহার সঙ্গে ভাব হইলে তাহার নিকট হইতে ক্লাসের পড়াটা ভালো করিয়া শিখিয়া লইব। ছুটির পর কতদিন তাহার বাড়ি পর্যন্ত গিয়াছি। সে আমার সঙ্গে একটিও কথা বলে নাই।

ক্লাসের বন্ধুদের অবহেলায় নিজের প্রতিও আমার মনে একটি অবহেলার ভাব আসিল। ক্লাসের অন্যান্য ছেলেরা যেমন সদাচঞ্চল হইয়া ঘুরিত ফিরিত, আমি অতি সঙ্কোচে পিছনের বেঞ্চে আমার চাচাতো ভাই নেহাজউদ্দীনের সঙ্গে জড়সড় হইয়া বসিয়া থাকিতাম। শিক্ষকেরা অন্যান্য ছাত্রদের লইয়া কত হাসি-তামাশা করিতেন। এটা-ওটা প্রশ্ন করিতেন। আমাদিগকে কিছুই জিজ্ঞাসা করিতেন না।

কিছুদিন পরে জোরের সঙ্গে ক্লাসের পড়াশুনা আরম্ভ হইল। শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সঙ্গে উপর-নিচ হওয়ার প্রথা প্রবর্তিত হইল। অঙ্কে, বাংলায়, ইতিহাসে, ভূগোলে আমি ভালো পড়া বলিতে পারিতাম। ধীরে ধীরে আমি সামনের বেঞ্চের দিকে আসিতে লাগিলাম। ইংরেজির ক্লাসে আবার নামিয়া যাইতে লাগিলাম। অঙ্কের ক্লাসে কোনো কোনো দিন প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিতাম। আমার দুই পাশের ভাগ্যবানদের ছেলেরা আমার ছোঁয়া বাঁচাইয়া যথেষ্ট ফাঁক রাখিয়া সরিয়া বসিত।

 

চলবে…