০৫:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১২২)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫
  • 16

ফরিদপুর জেলা স্কুলে

বিকাল হইলে তাঁহার সঙ্গে মাঠে বেড়াইতে বাহির হইতাম। আলীপুরের মোড়ে ছোট গাঙের তীরে বসিয়া দুইজনে অস্তগামী সূর্যের শোভা নিরীক্ষণ করিতাম। ছোট্ট নদীটির ওপারে মেঘে মেঘে নানা রঙের নকশা আঁকিয়া সূর্য অস্ত যাইত। তারপর রং আর রং, অর্ধেক আকাশ ভরিয়া রঙের উপর রঙের ঢেউ খেলিত। তারই কিছুটা নদীর জলে পড়িত। চাহিয়া চাহিয়া বুকের ভিতরে কি যেন উদাসীনতা অনুভব করিতাম।

ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়িতে ধীরেন আমাকে খুব সাহায্য করিত। স্কুলে বাড়ির কাজ করিয়া না আনিলে তাহার খাতা হইতে টুকিয়া লইতে দিত। কিন্তু সপ্তম শ্রেণীতে উঠিয়া আমরা দুই সেক্শনে পৃথক হইয়া গেলাম। ধীরেন গেল ‘বি’ সেশনে, আমি রহিলাম ‘এ’ সেশনে। আমি বহু চেষ্টা করিলাম ‘বি’ সেশনে যাইতে। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষেরা আমাকে ‘বি’ সেশনে বদলি করিলেন না। ইহাতে আমার পড়াশুনা খুবই খারাপ হইয়া পড়িল।

সপ্তম শ্রেণীতে উঠিয়া মৌলবি সাহেবের হাত হইতে উদ্ধার পাইতে আমি আরবির পরিবর্তে সংস্কৃত লইলাম। সংস্কৃত পড়িলে ভালো বাংলা লিখিতে পারিব ইহাই ছিল আমার সংস্কৃত পড়ার অন্যতম কারণ। আরবি অথবা পারসি লইলে মুসলিম সংস্কৃতির যেটুকুর সঙ্গে সেই বয়সে আমার পরিচিতি হইত সংস্কৃত লইয়া তাহা হইতে বঞ্চিত হইলাম। ইহার জন্য সেই মৌলবি সাহেবই দায়ী। এই ক্লাসে উঠিলে বাবু বসন্তকুমার দাস নামে একজন শিক্ষক আসিলেন। তিনি আমাদিগকে ভূগোল, ইতিহাস ও ইংরেজি পড়াইতেন। তিনি ঢাকা Teacher’s Training College হইতে বি টি পাশ করিয়া আসিয়াছিলেন। সেই প্রতিষ্ঠান হইতে আধুনিক শিক্ষার বিষয়ে যাহা যাহা শিখিয়া আসিয়াছিলেন তাহা তিনি প্রতিদিনের শিক্ষকতায় প্রয়োগ করিতেন। এতদিন আমরা ইতিহাস, ভূগোল বাংলায় পড়িতাম। এবার হইতে ইংরেজিতে পড়িতে আরম্ভ করিলাম।

আমরা যাহাতে মুখে-মুখে ইংরেজি বানাইয়া বলিতে পারি, প্রথমে তিনি আমাদিগকে সেই শিক্ষা দিলেন। ক্লাসে আমিই ছিলাম সবচাইতে ইংরেজিতে কাঁচা। তাই তিনি আমাকেই সবচাইতে বেশি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেন। তিনি বলিতেন, “জসীম উদ্‌দীনকে যদি শিখাইতে পারি তবে ক্লাসে সব ছেলেকে শেখানো যাইবে।”

প্রতিদিন ক্লাসে আসিয়াই যে ঘণ্টায় যাহা শিক্ষণীয় তাহার point-গুলি তিনি বোর্ডে লিখিয়া দিতেন। সেই point-গুলি বিস্তৃত করিয়া দুই-তিনবার আমাদিগকে বলিয়া দিতেন। তারপর আরম্ভ হইত প্রশ্ন করিবার পালা। আমাকেই বেশি উত্তর দিতে হইত। ভালোমতো উত্তর না দিতে পারিলেও তিনি অসন্তুষ্ট হইতেন না। আমি যাহাতে সঠিক উত্তর দিতে পারি সেজন্য তিনি আমাকে সাহায্য করিতেন। আমার ইংরেজি ভুল হইলে তাহা সংশোধন করিয়া সেই কথা আমাকে দিয়া আবার বলাইতেন। তিনি ছোটদের জন্য উমা, বনলতা প্রভৃতি দুই-তিনখানা বই লিখিয়াছিলেন। তাহা কলিকাতার সিটি লাইব্রেরী হইতে প্রকাশিত হইয়াছিল।

যোগেনবাবু পণ্ডিত মহাশয়ের সঙ্গে তাঁহার কি যেন রেষারেষি ভাব ছিল। একদিন তিনি আমাকে বলিলেন, “ওই যোগেন পণ্ডিত আমাকে ঈর্ষা করে। জান ভারতবর্ষ, প্রবাসীতে আমার বই-এর বিজ্ঞাপন বাহির হয়। এইসব পত্রিকা ইংলন্ড, আমেরিকা প্রভৃতি নানা দেশে যায়। সেই দেশের লোক আমার সাহিত্য-খ্যাতি জানিতে পারে। এই যোগেন পণ্ডিতের চৌদ্দপুরুষেরও ভাগ্য নাই এমন খ্যাতি লাভ করে।” যোগেনবাবু পণ্ডিত মহাশয়কেও আমি ভক্তি করিতাম। সেজন্য তাঁহার সঙ্গে বসন্তবাবু মাস্টার মহাশয়ের গুণের তারতম্য কতটা করিয়াছিলাম মনে নাই। কিন্তু ইংলন্ড, আমেরিকায় যাঁহার সাহিত্য-খ্যাতি ছড়াইয়া পড়িয়াছে, সেই নররূপী শিক্ষক-দেবতাটির প্রতি আমার মনের কল্পনা সেই লন্ডন, আমেরিকা ছাড়াইয়াও অনেক দূরে ব্যাপ্ত হইত।

 

চলবে…

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১২২)

১১:০০:২৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫

ফরিদপুর জেলা স্কুলে

বিকাল হইলে তাঁহার সঙ্গে মাঠে বেড়াইতে বাহির হইতাম। আলীপুরের মোড়ে ছোট গাঙের তীরে বসিয়া দুইজনে অস্তগামী সূর্যের শোভা নিরীক্ষণ করিতাম। ছোট্ট নদীটির ওপারে মেঘে মেঘে নানা রঙের নকশা আঁকিয়া সূর্য অস্ত যাইত। তারপর রং আর রং, অর্ধেক আকাশ ভরিয়া রঙের উপর রঙের ঢেউ খেলিত। তারই কিছুটা নদীর জলে পড়িত। চাহিয়া চাহিয়া বুকের ভিতরে কি যেন উদাসীনতা অনুভব করিতাম।

ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়িতে ধীরেন আমাকে খুব সাহায্য করিত। স্কুলে বাড়ির কাজ করিয়া না আনিলে তাহার খাতা হইতে টুকিয়া লইতে দিত। কিন্তু সপ্তম শ্রেণীতে উঠিয়া আমরা দুই সেক্শনে পৃথক হইয়া গেলাম। ধীরেন গেল ‘বি’ সেশনে, আমি রহিলাম ‘এ’ সেশনে। আমি বহু চেষ্টা করিলাম ‘বি’ সেশনে যাইতে। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষেরা আমাকে ‘বি’ সেশনে বদলি করিলেন না। ইহাতে আমার পড়াশুনা খুবই খারাপ হইয়া পড়িল।

সপ্তম শ্রেণীতে উঠিয়া মৌলবি সাহেবের হাত হইতে উদ্ধার পাইতে আমি আরবির পরিবর্তে সংস্কৃত লইলাম। সংস্কৃত পড়িলে ভালো বাংলা লিখিতে পারিব ইহাই ছিল আমার সংস্কৃত পড়ার অন্যতম কারণ। আরবি অথবা পারসি লইলে মুসলিম সংস্কৃতির যেটুকুর সঙ্গে সেই বয়সে আমার পরিচিতি হইত সংস্কৃত লইয়া তাহা হইতে বঞ্চিত হইলাম। ইহার জন্য সেই মৌলবি সাহেবই দায়ী। এই ক্লাসে উঠিলে বাবু বসন্তকুমার দাস নামে একজন শিক্ষক আসিলেন। তিনি আমাদিগকে ভূগোল, ইতিহাস ও ইংরেজি পড়াইতেন। তিনি ঢাকা Teacher’s Training College হইতে বি টি পাশ করিয়া আসিয়াছিলেন। সেই প্রতিষ্ঠান হইতে আধুনিক শিক্ষার বিষয়ে যাহা যাহা শিখিয়া আসিয়াছিলেন তাহা তিনি প্রতিদিনের শিক্ষকতায় প্রয়োগ করিতেন। এতদিন আমরা ইতিহাস, ভূগোল বাংলায় পড়িতাম। এবার হইতে ইংরেজিতে পড়িতে আরম্ভ করিলাম।

আমরা যাহাতে মুখে-মুখে ইংরেজি বানাইয়া বলিতে পারি, প্রথমে তিনি আমাদিগকে সেই শিক্ষা দিলেন। ক্লাসে আমিই ছিলাম সবচাইতে ইংরেজিতে কাঁচা। তাই তিনি আমাকেই সবচাইতে বেশি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেন। তিনি বলিতেন, “জসীম উদ্‌দীনকে যদি শিখাইতে পারি তবে ক্লাসে সব ছেলেকে শেখানো যাইবে।”

প্রতিদিন ক্লাসে আসিয়াই যে ঘণ্টায় যাহা শিক্ষণীয় তাহার point-গুলি তিনি বোর্ডে লিখিয়া দিতেন। সেই point-গুলি বিস্তৃত করিয়া দুই-তিনবার আমাদিগকে বলিয়া দিতেন। তারপর আরম্ভ হইত প্রশ্ন করিবার পালা। আমাকেই বেশি উত্তর দিতে হইত। ভালোমতো উত্তর না দিতে পারিলেও তিনি অসন্তুষ্ট হইতেন না। আমি যাহাতে সঠিক উত্তর দিতে পারি সেজন্য তিনি আমাকে সাহায্য করিতেন। আমার ইংরেজি ভুল হইলে তাহা সংশোধন করিয়া সেই কথা আমাকে দিয়া আবার বলাইতেন। তিনি ছোটদের জন্য উমা, বনলতা প্রভৃতি দুই-তিনখানা বই লিখিয়াছিলেন। তাহা কলিকাতার সিটি লাইব্রেরী হইতে প্রকাশিত হইয়াছিল।

যোগেনবাবু পণ্ডিত মহাশয়ের সঙ্গে তাঁহার কি যেন রেষারেষি ভাব ছিল। একদিন তিনি আমাকে বলিলেন, “ওই যোগেন পণ্ডিত আমাকে ঈর্ষা করে। জান ভারতবর্ষ, প্রবাসীতে আমার বই-এর বিজ্ঞাপন বাহির হয়। এইসব পত্রিকা ইংলন্ড, আমেরিকা প্রভৃতি নানা দেশে যায়। সেই দেশের লোক আমার সাহিত্য-খ্যাতি জানিতে পারে। এই যোগেন পণ্ডিতের চৌদ্দপুরুষেরও ভাগ্য নাই এমন খ্যাতি লাভ করে।” যোগেনবাবু পণ্ডিত মহাশয়কেও আমি ভক্তি করিতাম। সেজন্য তাঁহার সঙ্গে বসন্তবাবু মাস্টার মহাশয়ের গুণের তারতম্য কতটা করিয়াছিলাম মনে নাই। কিন্তু ইংলন্ড, আমেরিকায় যাঁহার সাহিত্য-খ্যাতি ছড়াইয়া পড়িয়াছে, সেই নররূপী শিক্ষক-দেবতাটির প্রতি আমার মনের কল্পনা সেই লন্ডন, আমেরিকা ছাড়াইয়াও অনেক দূরে ব্যাপ্ত হইত।

 

চলবে…