০৫:৩২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১২৩)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৩২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫
  • 15

ফরিদপুর জেলা স্কুলে

প্রায়ই মাস্টার মহাশয়ের বাড়ি যাইতাম। বই-এর নাম অনুসারে ফুলের মতো ফুটফুটে তাঁহার দু’টি মেয়ের নাম রাখিয়াছিলেন উমা আর বনলতা। একজন চার বৎসরের আর একজন ছয় বৎসরের। এই মেয়ে দুইটি আসিয়া পিতার সঙ্গে নানা আবদার করিয়া এটা-ওটা চাহিত। আমার খুব ভালো লাগিত। বসন্তবাবুর স্ত্রী শিল্পকার্যে সুদক্ষ ছিলেন। নারকেল কাটিয়া নানারকম ছবির মতো করিয়া চিনির রসে ভিজাইয়া তিনি একরকম খাবার তৈরি করতেন। একবার মাস্টার মহাশয় আমাকে এই খাবার খাওয়াইয়াছিলেন। তাহার স্বাদ আজও মনে করিতে পারিতেছি। বসন্তবাবু ‘নবীন আলোক’ নামে একখানা গ্রন্থের বই লিখিয়াছিলেন। তাহা ছাড়া তিনি রঘুনাথ গোস্বামী কৃত ‘হংস-দূত’ নামক পুস্তকখানি বাংলায় কবিতাকারে অনুবাদ করিয়াছিলেন। তাহার একটি লাইন আজও আমার মনে আছে:

হরিতাল-দ্যুতিহর রূপ-মনোহর জবা-পুষ্পসম-রম্য তল চরণের।

তাঁহার আদেশে এই বই আমি ট্রেনের যাত্রীদের মধ্যে বিক্রি করিয়া দিতাম। মাঝে মাঝে তাঁহার বাসায় যাইয়া পড়া বুঝিয়া লইতাম; আর কল্পনা করিতাম, কবে আমি বসন্তবাবুর মতো লেখক হইতে পারিব। নির্জন স্থানে বসিয়া মনে মনে তাঁহাকে ধ্যান করিতাম আর ভাবিতাম এরূপ করিতে করিতে একদিন তাঁহার সমস্ত গুণপনা আমার মধ্যে প্রবর্তিত হইবে। বসন্তবাবু ছিলেন জাতিতে খৌরকার। সেইজন্য বর্ণহিন্দু ছাত্ররা তাঁহাকে লইয়া নানারূপ ঠাট্টা-বিদ্রূপ করিত। পরীক্ষার হলে তিনি ছাত্রদের পকেট অনুসন্ধান করিয়া নকল ধরাইয়া দিতেন। একবার তিনি একটি হিন্দু-ছাত্রের পকেট অনুসন্ধান করিতে গিয়াছেন, তাহার পকেট হইতে এক টুকরা কাগজ বাহির হইল। তাহাতে লেখা ছিল বাজারে নাপিত খরচ এক আনা। ইহা লইয়া হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে কিছুদিন নানা-রকমের ঠাট্টা-বিদ্রূপ চলিল। আমরা মুসলমান ছাত্রেরা বড়ই মনঃক্ষুণ্ণ হইলাম। আমাদের মধ্যে তো জাতিভেদ নাই। একজন শিক্ষককে এইভাবে অপদস্থ করা হিন্দু ছেলেদের পক্ষে খুবই অন্যায় হইয়াছিল।

বসন্তবাবু পরীক্ষার হলে ছাত্রদের নকল ধরাইয়া দিতেন বলিয়া একদল ছাত্র তাঁহার প্রতি বড়ই বিরূপ হইয়া উঠিল। তাহারা বসন্তবাবুর নামে যা-তা লিখিয়া দেয়ালে টাঙাইয়া দিতে লাগিল। একবার আমি এরূপ একটি লেখা কাছারির কাছে জেলখানার দেয়ালে টাঙানো দেখিতে পাইলাম। মনে মনে চিন্তা করিলাম, এই লেখা পড়িয়া সকলে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে কতই না খারাপ মনে করিবে। তাই অতি সাবধানে সেই কাগজখানা তুলিয়া আনিয়া বসন্তবাবুকে দিলাম। ভাবিয়াছিলাম, এই লেখাটি পাইয়া তিনি আমার গুরুভক্তি দেখিয়া আমাকে কতই না তারিফ করিবেন। কিন্তু লেখাটি হাতে লইয়া তিনি কেমন গম্ভীর হইয়া গেলেন। স্কুলের টিফিনের সময় অপর শিক্ষক রমণীবাবু আমাকে একটি নির্জন ঘরে ডাকাইয়া লইয়া ধমকের সুরে নানারকম প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। আমিই যে উহা কাউকে দিয়া লেখাইয়া আনিয়া বসন্তবাবুকে দিয়াছি তাহাই তিনি বিশ্বাস করিলেন এবং ইহার পরিণাম যে কি ভয়ঙ্কর তাহাও তিনি আমাকে সমঝাইয়া দিলেন।

সেদিন রাত্রে আর ঘুম আসিল না। যে-শিক্ষককে আমি এত করিয়া ভক্তি করি সেই বসন্তবাবুই কিনা আমাকে এমন গর্হিত কাজে সন্দেহ করিলেন। নিজে প্রশ্ন করিতে সঙ্কোচ বোধ করিয়াছেন বলিয়া অপরকে দিয়া আমাকে প্রশ্ন করাইয়াছেন। সমস্ত পৃথিবীর উপর আমার অবিশ্বাস হইতে লাগিল। আমার অন্তরের শিক্ষক-দেবতা আজ ধূলিতে নামিয়া গেলেন।

ইহার পরে এখানে-ওখানে আরও বহু প্রকার দেয়াল-লিপি প্রকাশিত হইতে লাগিল। তাহাতে লেখা ছিল বসন্তবাবু ক্লাসের সুন্দর ছেলেদের বেশি নম্বর দেন, বড়লোকের ছেলেদের বেশি খাতির করেন ইত্যাদি, ইত্যাদি।

 

চলবে…

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১২৩)

১১:০০:৩২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫

ফরিদপুর জেলা স্কুলে

প্রায়ই মাস্টার মহাশয়ের বাড়ি যাইতাম। বই-এর নাম অনুসারে ফুলের মতো ফুটফুটে তাঁহার দু’টি মেয়ের নাম রাখিয়াছিলেন উমা আর বনলতা। একজন চার বৎসরের আর একজন ছয় বৎসরের। এই মেয়ে দুইটি আসিয়া পিতার সঙ্গে নানা আবদার করিয়া এটা-ওটা চাহিত। আমার খুব ভালো লাগিত। বসন্তবাবুর স্ত্রী শিল্পকার্যে সুদক্ষ ছিলেন। নারকেল কাটিয়া নানারকম ছবির মতো করিয়া চিনির রসে ভিজাইয়া তিনি একরকম খাবার তৈরি করতেন। একবার মাস্টার মহাশয় আমাকে এই খাবার খাওয়াইয়াছিলেন। তাহার স্বাদ আজও মনে করিতে পারিতেছি। বসন্তবাবু ‘নবীন আলোক’ নামে একখানা গ্রন্থের বই লিখিয়াছিলেন। তাহা ছাড়া তিনি রঘুনাথ গোস্বামী কৃত ‘হংস-দূত’ নামক পুস্তকখানি বাংলায় কবিতাকারে অনুবাদ করিয়াছিলেন। তাহার একটি লাইন আজও আমার মনে আছে:

হরিতাল-দ্যুতিহর রূপ-মনোহর জবা-পুষ্পসম-রম্য তল চরণের।

তাঁহার আদেশে এই বই আমি ট্রেনের যাত্রীদের মধ্যে বিক্রি করিয়া দিতাম। মাঝে মাঝে তাঁহার বাসায় যাইয়া পড়া বুঝিয়া লইতাম; আর কল্পনা করিতাম, কবে আমি বসন্তবাবুর মতো লেখক হইতে পারিব। নির্জন স্থানে বসিয়া মনে মনে তাঁহাকে ধ্যান করিতাম আর ভাবিতাম এরূপ করিতে করিতে একদিন তাঁহার সমস্ত গুণপনা আমার মধ্যে প্রবর্তিত হইবে। বসন্তবাবু ছিলেন জাতিতে খৌরকার। সেইজন্য বর্ণহিন্দু ছাত্ররা তাঁহাকে লইয়া নানারূপ ঠাট্টা-বিদ্রূপ করিত। পরীক্ষার হলে তিনি ছাত্রদের পকেট অনুসন্ধান করিয়া নকল ধরাইয়া দিতেন। একবার তিনি একটি হিন্দু-ছাত্রের পকেট অনুসন্ধান করিতে গিয়াছেন, তাহার পকেট হইতে এক টুকরা কাগজ বাহির হইল। তাহাতে লেখা ছিল বাজারে নাপিত খরচ এক আনা। ইহা লইয়া হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে কিছুদিন নানা-রকমের ঠাট্টা-বিদ্রূপ চলিল। আমরা মুসলমান ছাত্রেরা বড়ই মনঃক্ষুণ্ণ হইলাম। আমাদের মধ্যে তো জাতিভেদ নাই। একজন শিক্ষককে এইভাবে অপদস্থ করা হিন্দু ছেলেদের পক্ষে খুবই অন্যায় হইয়াছিল।

বসন্তবাবু পরীক্ষার হলে ছাত্রদের নকল ধরাইয়া দিতেন বলিয়া একদল ছাত্র তাঁহার প্রতি বড়ই বিরূপ হইয়া উঠিল। তাহারা বসন্তবাবুর নামে যা-তা লিখিয়া দেয়ালে টাঙাইয়া দিতে লাগিল। একবার আমি এরূপ একটি লেখা কাছারির কাছে জেলখানার দেয়ালে টাঙানো দেখিতে পাইলাম। মনে মনে চিন্তা করিলাম, এই লেখা পড়িয়া সকলে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে কতই না খারাপ মনে করিবে। তাই অতি সাবধানে সেই কাগজখানা তুলিয়া আনিয়া বসন্তবাবুকে দিলাম। ভাবিয়াছিলাম, এই লেখাটি পাইয়া তিনি আমার গুরুভক্তি দেখিয়া আমাকে কতই না তারিফ করিবেন। কিন্তু লেখাটি হাতে লইয়া তিনি কেমন গম্ভীর হইয়া গেলেন। স্কুলের টিফিনের সময় অপর শিক্ষক রমণীবাবু আমাকে একটি নির্জন ঘরে ডাকাইয়া লইয়া ধমকের সুরে নানারকম প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। আমিই যে উহা কাউকে দিয়া লেখাইয়া আনিয়া বসন্তবাবুকে দিয়াছি তাহাই তিনি বিশ্বাস করিলেন এবং ইহার পরিণাম যে কি ভয়ঙ্কর তাহাও তিনি আমাকে সমঝাইয়া দিলেন।

সেদিন রাত্রে আর ঘুম আসিল না। যে-শিক্ষককে আমি এত করিয়া ভক্তি করি সেই বসন্তবাবুই কিনা আমাকে এমন গর্হিত কাজে সন্দেহ করিলেন। নিজে প্রশ্ন করিতে সঙ্কোচ বোধ করিয়াছেন বলিয়া অপরকে দিয়া আমাকে প্রশ্ন করাইয়াছেন। সমস্ত পৃথিবীর উপর আমার অবিশ্বাস হইতে লাগিল। আমার অন্তরের শিক্ষক-দেবতা আজ ধূলিতে নামিয়া গেলেন।

ইহার পরে এখানে-ওখানে আরও বহু প্রকার দেয়াল-লিপি প্রকাশিত হইতে লাগিল। তাহাতে লেখা ছিল বসন্তবাবু ক্লাসের সুন্দর ছেলেদের বেশি নম্বর দেন, বড়লোকের ছেলেদের বেশি খাতির করেন ইত্যাদি, ইত্যাদি।

 

চলবে…