ফরিদপুর জেলা স্কুলে
পরদিন সমস্ত ক্লাসের সামনে তিনি বলিলেন, “এই ছেলেটি সাধুর শিষ্য। আমরাও তাহাকে সাধু বলিয়া জানিতাম। তোমরা শুনিয়া রাখ এই সাধুর কীর্তি। কাল সে ফোর্থ ক্লাসের টিকেট লইয়া সেকেন্ড ক্লাসে ঢুকিতে গিয়াছিল।” আমি মরমে মরিয়া গেলাম। এটিও আমার জীবনে নিরপরাধে শাস্তি পাওয়ার আর একটি দৃষ্টান্ত।
ইহার বহু বৎসর পরে আবার বসন্তবাবুর সঙ্গে দেখা হইয়াছিল। তিনি তখন দিনাজপুর জেলা স্কুলের হেডমাস্টার। আমি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ হইতে দিনাজপুরে গ্রাম্যগান সংগ্রহ করিতে গিয়াছি। তখন আমার কবিতা নানা মাসিকপত্রে ছাপা হয়। আমাকে দেখিয়া তিনি বড়ই খুশি হইলেন। একদিন বাসায় নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইলেন। তাঁহার ছোট দুইটি মেয়ে সেই বনলতা আর উমার কথা জিজ্ঞাসা করিলাম।
তিনি বলিলেন, “তাহারা এখন এতটুকু নাই। বিবাহিতা হইয়া তাহারা এখন শ্বশুরবাড়িতে।” তিনি আমাকে একদিন তাঁর ছাত্রদের সামনে আমার জীবনের বিষয়ে বক্তৃতা করিতে বলিলেন। কি কারণে যেন বক্তৃতা দেওয়া হইল না।
ইহার বহু বৎসর পরে একবার তিনি তাঁহার ছেলেকে আমার কাছে পাঠাইয়াছিলেন।
পত্রে তিনি আমাকে লিখিয়াছিলেন, আমি যেন চেষ্টাতদ্বির করিয়া তাহার জন্য একটি চাকরির বন্দোবস্ত করিয়া দেই। তাহাকে সঙ্গে লইয়া এ-আফিসে সে-আফিসে কত ঘুরিলাম। কিন্তু আমার মতো সামান্য ব্যক্তির অনুরোধে কে তাহাকে চাকরি দিবে? কয়েকদিন কলিকাতায় থাকিয়া ছেলেটি চলিয়া গেল। আজ মাস্টার মহাশয়ের কথা মনে পড়িয়া আমার চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইতেছে। তিনি আমাকে ভুল বুঝিয়া যে শাস্তি দিয়াছেন, সেজন্য তো তাঁর কোনো দোষ নাই।
আর সেসব কথা তো কবেই ভুলিয়া গিয়াছি। তাঁর ক্লাসে তিনি এমন সুন্দর করিয়া পড়াইতেন, তাঁর কাছে যে অযাচিত স্নেহ-মমতা পাইয়াছি, আমার সেকালের লেখাগুলি পড়িয়া তিনি যে উৎসাহ দিতেন, এসব কথা ভাবিয়া আমার চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়। আবার যদি তাঁর ক্লাসে যাইয়া বসিতে পারিতাম; আবার যদি তাঁর সেই ছোট্ট বাড়িখানায় যাইয়া তাঁহার সামনে আমার সেকালের কবিতার খাতাখানি মেলিয়া ধরিতে পারিতাম, তাঁর সেই ফুটফুটে ছোট্ট মেয়ে দুইটি বনলতা আর উমা আসিয়া আবার যদি তাঁর কোল ঘেঁষিয়া এটা-ওটা আব্দার করিত, তবে যে কতই ভালো লাগিত!
কিন্তু সব ভালো লাগাই তো জীবনে চিরস্থায়ী হইয়া থাকে না। শুধুমাত্র কল্পনার জগতে সেইসব ঘটনাকে মেলিয়া ধরিয়া কিঞ্চিৎ সুখ অনুভব করা যায়। ইহাই কি কম সৌভাগ্য!
চলবে…