আর্কাদি গাইদার
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সন্ন্যাসী ছাড়া কাছাকাছি কয়েকজন চাষী মেয়েও বসে ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল দুধের খালি পাত্র কয়েকটা। আর ছিল দু-জন সামরিক অফিসার আর জনাচারেক রক্ষী-বাহিনীর লোক। ওদের ওপাশে-বসা হাতে লাল কাপড়ের পট্টি-বাঁধা একজন বেসামরিক নাগরিকের থেকে ওরা কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসেছিল।
স্টিমারের যাত্রীদের বাকি সবাই ছিলেন শ্রমিক। দলে দলে ভাগ হয়ে এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে তাঁরা নিজেদের মধ্যে জোরে-জোরে আলাপ করছিলেন। তর্ক, দিব্যিগালা, হাসিঠাট্টা আর খবরের কাগজ থেকে কিছু কিছু অংশ পড়ে শুনিয়ে আসর মাত করে রেখেছিলেন তাঁরা। মনে হচ্ছিল, ওঁরা সকলেই সকলের পরিচিত। যেভাবে অন্যের তর্কে’র মধ্যে মাথা গলিয়ে একেক জন মতামত দিচ্ছিলেন, তাতে এইরকমই মনে হওয়া স্বাভাবিক ছিল। স্টিমারের এমুড়ো থেকে ওমুড়ো পর্যন্ত ওঁদের মধ্যে টিপ্পনী আর রসিকতা নিয়ে লোফালুফি চলছিল।
সামনে সরমোভো দেখা দিল। বাতাস-চলাচল-বন্ধ গুমোট ওই সকালবেলাটায় সরমোভোর কলকারখানার ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। স্টিমার থেকে মনে হচ্ছিল যেন প্রকান্ড-প্রকাণ্ড চিমনির পাথরের গাছের গুড়ির মাথায় কালো ধোঁয়ার ডালপালা ছড়ানো।
‘এই!’ পেছন থেকে আমার নতুন বন্ধুর চেনা গলা শোনা গেল।
ওকে দেখে খুশি হলুম। কারণ, সরমোভোতে নেমে ইস্তাহারগুলো নিয়ে যে কী করব ভেবে পাচ্ছিলুম না।
আমার পাশে শেকলগুলোর ওপর বসে ও পকেট থেকে একটা আপেল বের করে আমায় দিল।
‘আরে, ধরো, ইয়ার! মজুররা আমারে এক টুপি-ভরতি করে দিয়েছিল। যখনই কোনো নতুন ইস্তেহার কি খবরকাগজ বেরোয় আমি ওদের কাছেই পেরথম যাই কিনা, তাই। গতকাল তো ওরা আমায় পুরা এক থোলো ভোবলা* দিয়েছিল। আরে, ওদের আবার পয়সা লাগে নাকি? সোজা বস্তায় হাত পুরি তুলে আনলেই হল। তা, তিনটে মাছ তো আমি লিজেই খেয়ে লিলাম আর বাকি দুটো বাড়ি লিয়ে গেলাম আন্কা-মাক্বার জন্যি।’ পরে মাতব্বরির ঢঙে বুঝিয়ে বলল: ‘আমার দুটো বোন। আন্কা-মাকা। বোকা, পুঁচকে দুটো ব্যাঙ। সব সময়ে খালি খাইখাই করে।’
ওর একনাগাড়ে কথা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। দেখলুম, লাল পট্টিধারী বেসামরিক লোকটি রক্ষী-বাহিনীর লোকজন সঙ্গে নিয়ে হঠাৎ যাত্রীদের কাগজপত্র পরীক্ষা করতে শুরু করেছে। শ্রমিকরা নিঃশব্দে নিজের-নিজের দোমড়ানো কোঁচকানো তেলচিটে কাগজগুলো বের করে দেখাতে লাগলেন, সঙ্গে সঙ্গে নানারকম বিরুদ্ধ মন্তব্যও করতে লাগলেন।