০৭:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫

ব্রিটিশ রাজত্বে সুন্দরবন (পর্ব-১৫৮)

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:৫৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • 17

শশাঙ্ক মণ্ডল

ব্রিটিশ রাজত্বে আদিবাসীদের অবস্থান বৃহত্তর হিন্দু মুসলমান সমাজের বাইরে স্বতন্ত্র দ্বীপের মতো ছিল। প্রতিবেশী কৃষকদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি। তার পিছনে সামাজিক অর্থনৈতিক কারণ বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। জমি হাসিল করে জঙ্গ লাবাদী জমি যা কিছু আদিবাসীরা পেয়েছিল তা পরবর্তকালে আর্থিক দুরবস্থা ও সরলতার সুযোগ নিয়ে স্থানীয় মানুষদের হাতে চলে গেল।

আদিবাসীরা অপর সম্প্রদায়ের মানুষগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করল। স্থানীয় মানুষরা এদের ‘বুনো’ বলে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে কোন রকম সামাজিক উৎসবে এদের স্থান হয়নি। ভাষা সামাজিক আচার আচরণ স্থানীয় মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠার পক্ষে বাধা সৃষ্টি করেছিল। তবু একশ বছরের পাশাপাশি বসবাস আদিবাসী সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল তা অস্বীকার করা যাবে না। “সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম নেতা দোবরু বীরবর্দী বিভূতিভূষণের কাছে আক্ষেপ

করেছিল আমাদের বংশ সূর্য বংশ- এই পাহাড় জঙ্গল সারা পৃথিবী আমাদের রাজ্য ছিল’। লেখক প্রশ্ন করেছিলেন ‘আপনার চাষবাস আছে?’ তার উত্তরে দোবরু পান্না গর্বের সাথে বলেছিল- ‘ও সব আমাদের বংশে নেই, শিকার করার মান সকলের চেয়ে বড়’। অতীত নিয়ে আদিবাসীরা এখনও গর্বিত। পার্বনের দিনে ঘরের চার পাশে পিটুলি দিয়ে ছবি আঁকে তীর ধনুক বর্শার ছবি। প্রতিটি বাড়িতে পতাকা ওড়ায় – এসবের মধ্য দিয়ে অতীতের হারিয়ে যাওয়া সেই রাজ্য তার গৌরব গাঁথা স্মরণ করে। পৌষপার্বনের দিনে বাড়ির দেয়াল চিত্রে এসব ছবি আলপনা এখনও আদিবাসী পাড়াতে লক্ষ করা যাবে।

এখনও সামাজিক জীবনে গোষ্ঠীপতিদের অসামান্য প্রভাব ও সম্মান অটুট আছে। সুন্দরবনের আদিবাসীদের জমি হারানোর পিছনে সামাজিক অর্থনৈতিক শোষণের সাথে আর একটি বড় কারণ-আদিবাসীরা চাষকে মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি, বনের দিকে শিকারের সন্ধানে তার মনটা এখনও পড়ে আছে।

সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আদিবাসীরা দীর্ঘ কাল পর্যন্ত নিজস্ব স্বতন্ত্র বুজায় রেখেছিল – কিন্তু স্বাধীনোত্তর কালে তার বহুল পরিবর্তন আমরা লক্ষ করি। ভাষায় ক্ষেত্রে ইতি পূর্বে তারা অনেক বাংলা শব্দ গ্রহণ করে একটা মিশ্র ভাষায় জন্ম দিয়েছে। টুসু সহরই গানে বৈষ্ণব ভাবনা এসে ভিড় করছে, আজকের যুগে হিন্দু ভাবনা তাদের জীবনকে অনেক ক্ষেত্রে আলোড়িত করেছে। বিভিন্ন পূজা তারা করছে, পূজা অর্চনায় হিন্দু ভাবনা এসে যাচ্ছে, পুরোহিত ডাকছে।

শ্রাদ্ধ শান্তিতে তারা হিন্দুদের আচার আচরণ গ্রহণ করেছে এবং নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিচ্ছে মাকাল ঠাকুর থেকে শুরু করে পেঁচোপাঁচী শীতলা মনসা প্রভৃতি লৌকিক দেবদেবীর পূজায় নিজেদের নিয়োজিত করছে। দীর্ঘকাল পাশাপাশি বাস করে হিন্দু সমাজের বাইরে স্বতন্ত্র দ্বীপের মতো অবস্থান আর সম্ভব হচ্ছে না।

 

 

১৪ জুলাই অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল

ব্রিটিশ রাজত্বে সুন্দরবন (পর্ব-১৫৮)

১২:০০:৫৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

শশাঙ্ক মণ্ডল

ব্রিটিশ রাজত্বে আদিবাসীদের অবস্থান বৃহত্তর হিন্দু মুসলমান সমাজের বাইরে স্বতন্ত্র দ্বীপের মতো ছিল। প্রতিবেশী কৃষকদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি। তার পিছনে সামাজিক অর্থনৈতিক কারণ বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। জমি হাসিল করে জঙ্গ লাবাদী জমি যা কিছু আদিবাসীরা পেয়েছিল তা পরবর্তকালে আর্থিক দুরবস্থা ও সরলতার সুযোগ নিয়ে স্থানীয় মানুষদের হাতে চলে গেল।

আদিবাসীরা অপর সম্প্রদায়ের মানুষগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করল। স্থানীয় মানুষরা এদের ‘বুনো’ বলে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে কোন রকম সামাজিক উৎসবে এদের স্থান হয়নি। ভাষা সামাজিক আচার আচরণ স্থানীয় মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠার পক্ষে বাধা সৃষ্টি করেছিল। তবু একশ বছরের পাশাপাশি বসবাস আদিবাসী সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল তা অস্বীকার করা যাবে না। “সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম নেতা দোবরু বীরবর্দী বিভূতিভূষণের কাছে আক্ষেপ

করেছিল আমাদের বংশ সূর্য বংশ- এই পাহাড় জঙ্গল সারা পৃথিবী আমাদের রাজ্য ছিল’। লেখক প্রশ্ন করেছিলেন ‘আপনার চাষবাস আছে?’ তার উত্তরে দোবরু পান্না গর্বের সাথে বলেছিল- ‘ও সব আমাদের বংশে নেই, শিকার করার মান সকলের চেয়ে বড়’। অতীত নিয়ে আদিবাসীরা এখনও গর্বিত। পার্বনের দিনে ঘরের চার পাশে পিটুলি দিয়ে ছবি আঁকে তীর ধনুক বর্শার ছবি। প্রতিটি বাড়িতে পতাকা ওড়ায় – এসবের মধ্য দিয়ে অতীতের হারিয়ে যাওয়া সেই রাজ্য তার গৌরব গাঁথা স্মরণ করে। পৌষপার্বনের দিনে বাড়ির দেয়াল চিত্রে এসব ছবি আলপনা এখনও আদিবাসী পাড়াতে লক্ষ করা যাবে।

এখনও সামাজিক জীবনে গোষ্ঠীপতিদের অসামান্য প্রভাব ও সম্মান অটুট আছে। সুন্দরবনের আদিবাসীদের জমি হারানোর পিছনে সামাজিক অর্থনৈতিক শোষণের সাথে আর একটি বড় কারণ-আদিবাসীরা চাষকে মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি, বনের দিকে শিকারের সন্ধানে তার মনটা এখনও পড়ে আছে।

সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আদিবাসীরা দীর্ঘ কাল পর্যন্ত নিজস্ব স্বতন্ত্র বুজায় রেখেছিল – কিন্তু স্বাধীনোত্তর কালে তার বহুল পরিবর্তন আমরা লক্ষ করি। ভাষায় ক্ষেত্রে ইতি পূর্বে তারা অনেক বাংলা শব্দ গ্রহণ করে একটা মিশ্র ভাষায় জন্ম দিয়েছে। টুসু সহরই গানে বৈষ্ণব ভাবনা এসে ভিড় করছে, আজকের যুগে হিন্দু ভাবনা তাদের জীবনকে অনেক ক্ষেত্রে আলোড়িত করেছে। বিভিন্ন পূজা তারা করছে, পূজা অর্চনায় হিন্দু ভাবনা এসে যাচ্ছে, পুরোহিত ডাকছে।

শ্রাদ্ধ শান্তিতে তারা হিন্দুদের আচার আচরণ গ্রহণ করেছে এবং নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দিচ্ছে মাকাল ঠাকুর থেকে শুরু করে পেঁচোপাঁচী শীতলা মনসা প্রভৃতি লৌকিক দেবদেবীর পূজায় নিজেদের নিয়োজিত করছে। দীর্ঘকাল পাশাপাশি বাস করে হিন্দু সমাজের বাইরে স্বতন্ত্র দ্বীপের মতো অবস্থান আর সম্ভব হচ্ছে না।