০৯:০৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
ট্রাম্পের বিপরীতে, প্রাচীন চীন এর শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানানোর ঐতিহ্য রণক্ষেত্রে (পর্ব-৭৭) সমুদ্রের ওপার থেকে নতুন স্বপ্ন: তাইওয়ান তরুণদের ফুচিয়ানে নতুন জীবনগাঁথা ব্যর্থ কলম্বো, গলের লড়াই -এ বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ঘরে জয় কেন ? ‘আকাশ হয়ে যাই’ মিউজিক ভিডিতে প্রশংসিত পূর্ণিমা বৃষ্টি সাউথ চায়নান মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন: ইরান আক্রমনে লাভ ক্ষতি ইউক্রেন দাবি করেছে বাংলাদেশের কিছু সংস্থার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিক ইইউ কলকাতার কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রীকে গণধর্ষণ, গ্রেফতার তিন ‘চুরির গম’ আমদানি: বাংলাদেশের ওপর ইইউ নিষেধাজ্ঞা চায় ইউক্রেন চীনের বৃহত্তম গভীর সমুদ্র গ্যাসক্ষেত্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের উৎপাদন শুরু

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১২৬)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৫২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • 10

স্কুলের পথে

স্কুল হইতে আমার বাড়ি ছিল আড়াই মাইল দূরে। সেখান হইতে নয়টার সময় খাইয়া স্কুলে রওয়ানা হইতাম। স্কুলের ছুটি হইত চারিটার সময়। দারুণ ক্ষুধায় তখন পেটে আগুন জ্বলিতে থাকিত। বইপত্র বগলে করিয়া বাড়ির পথে রওয়ানা হইতাম। আমার ক্লাসের সহপাঠীদের প্রায় সকলেরই বাড়ি শহরে। তাহারা পাঁচ-দশ মিনিটে বাড়ি যাইয়া নাস্তা খাইয়া স্কুলের মাঠে খেলিতে আসিত। যেদিন খেলার মাঠে বড় খেলা থাকিত তাহারা সেখানে যাইয়া খেলা দেখিত। সেই খেলা দেখার কি অপূর্ব মাদকতা। যেদিন ঈশান স্কুলের সাথে আমাদের জেলা স্কুলের খেলা হইত সেদিন আমি স্কুলের ছুটির পর বইপত্র বগলে করিয়া খেলা দেখিতে যাইতাম। খেলার উত্তেজনায় ক্ষুধার কথা মনে থাকিত না। কিন্তু খেলার শেষে যখন সেই আড়াই মাইল পথ হাঁটিয়া বাড়ি ফিরিতাম তখন দারুণ ক্ষুধায় নিজের মাংস নিজে চিবাইয়া খাইতে ইচ্ছা করিত।

বাড়ি যাইবার পথে কতদিন দেখিয়াছি রাস্তার পাশে কোথাও ছুতোরমিস্ত্রি নৌকা গড়াইতেছে। বাটালের আঘাতে নানা মাপের কাঠ কাটিয়া নৌকার সঙ্গে লাগাইতেছে। বাইশ দিয়া কাঠ চাঁছিয়া সমান করিতেছে। বাইশের আগায় চাঁছিগুলি নাচিতে নাচিতে মিস্ত্রির পায়ের কাছে আসিয়া জড় হইতেছে। সেই মসৃণ কাঠের উপর মিস্ত্রি বাটাল দিয়া নানা নকশা আঁকিতেছে। মিস্ত্রির হাতের অস্ত্রগুলির সঙ্গে যেন কাঠের কতকালের পরিচিতি। মিস্ত্রি যেরূপে কাঠকে রূপ দিতে চায় আপন ইচ্ছায় কাঠ সেই রূপে রূপান্তরিত হয়। ইহা দেখিতে আমার বড়ই ভালো লাগিত। দারুণ ক্ষুধার কথা ভুলিয়া যাইতাম। পথের পাশে দাঁড়াইয়া মিস্ত্রির কাজ দেখিতাম। কাঠ যে রেন্দার আঘাতে ঘষিয়া ঘষিয়া কাটিতেছে, সেই ঘষা যেন আমি

আমার বুকে অনুভব করিতাম। বাটালের সাহায্যে কাঠ কাটিবার সময় আমার বুকের ভিতর যেন কেমন স্পন্দন অনুভব করিতাম। আজও কোথাও কোনো মিস্ত্রির কাঠকাটা দেখিলে আমি সেই স্পন্দন অনুভব করি।

এমনি করিয়া বহুক্ষণ দেরি করিয়া আবার বাড়ির পথে রওয়ানা হইতাম। কোনো কোনো দিন পথের মধ্যে কোনো দোকানের সামনে বান্দরওয়ালা বান্দর নাচায়, বৈরাগী বৈষ্টমী একতারা বাজাইয়া গান করে। এমনি কতরকমের আকর্ষণ। শহরে মাঝে মাঝে বড় রকমের খেলা হয়। ঢাকা হইতে খেলার দল আসিয়া ফরিদপুরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। কলিকাতা হইতে বড় বড় বক্তারা আসিয়া বক্তৃতা করেন। শহরের ছেলেরা বাড়ি হইতে খাইয়া আসিয়া ম্যাচ খেলা দেখে, বক্তৃতা শোনে। আমি অভুক্ত অবস্থায় বই-খাতা বগলে করিয়া খেলার মাঠে যাই। বক্তৃতা শুনি। তারপর বাড়ি ফিরিবার পথে ক্ষুধায় পেট জ্বলিতে থাকে। অনেক বলিয়া-কহিয়া কালেভদ্রে যেদিন পিতার নিকট হইতে একটি পয়সা আনিতে পারিতাম, তাই দিয়া মুদির দোকান হইতে এক পয়সার চিড়া আর একটু ফাউ চিনি লইয়া খাইতে খাইতে বাড়ির পথে রওয়ানা হইতাম। যেদিন মুদি চিড়ার সঙ্গে একটু ফাউ চিনি দিত না সেদিন এক পয়সায় ছোলা ভাজা কিনিয়া চিবাইতে চিবাইতে বাড়ি যাইতাম। ছোলা ভাজা বা চিড়া খাইতে অনেকক্ষণ লাগিত। ততক্ষণে বাড়ি আসিয়া পৌঁছিয়া যাইতাম।

চলবে…

ট্রাম্পের বিপরীতে, প্রাচীন চীন এর শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানানোর ঐতিহ্য

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১২৬)

১১:০০:৫২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

স্কুলের পথে

স্কুল হইতে আমার বাড়ি ছিল আড়াই মাইল দূরে। সেখান হইতে নয়টার সময় খাইয়া স্কুলে রওয়ানা হইতাম। স্কুলের ছুটি হইত চারিটার সময়। দারুণ ক্ষুধায় তখন পেটে আগুন জ্বলিতে থাকিত। বইপত্র বগলে করিয়া বাড়ির পথে রওয়ানা হইতাম। আমার ক্লাসের সহপাঠীদের প্রায় সকলেরই বাড়ি শহরে। তাহারা পাঁচ-দশ মিনিটে বাড়ি যাইয়া নাস্তা খাইয়া স্কুলের মাঠে খেলিতে আসিত। যেদিন খেলার মাঠে বড় খেলা থাকিত তাহারা সেখানে যাইয়া খেলা দেখিত। সেই খেলা দেখার কি অপূর্ব মাদকতা। যেদিন ঈশান স্কুলের সাথে আমাদের জেলা স্কুলের খেলা হইত সেদিন আমি স্কুলের ছুটির পর বইপত্র বগলে করিয়া খেলা দেখিতে যাইতাম। খেলার উত্তেজনায় ক্ষুধার কথা মনে থাকিত না। কিন্তু খেলার শেষে যখন সেই আড়াই মাইল পথ হাঁটিয়া বাড়ি ফিরিতাম তখন দারুণ ক্ষুধায় নিজের মাংস নিজে চিবাইয়া খাইতে ইচ্ছা করিত।

বাড়ি যাইবার পথে কতদিন দেখিয়াছি রাস্তার পাশে কোথাও ছুতোরমিস্ত্রি নৌকা গড়াইতেছে। বাটালের আঘাতে নানা মাপের কাঠ কাটিয়া নৌকার সঙ্গে লাগাইতেছে। বাইশ দিয়া কাঠ চাঁছিয়া সমান করিতেছে। বাইশের আগায় চাঁছিগুলি নাচিতে নাচিতে মিস্ত্রির পায়ের কাছে আসিয়া জড় হইতেছে। সেই মসৃণ কাঠের উপর মিস্ত্রি বাটাল দিয়া নানা নকশা আঁকিতেছে। মিস্ত্রির হাতের অস্ত্রগুলির সঙ্গে যেন কাঠের কতকালের পরিচিতি। মিস্ত্রি যেরূপে কাঠকে রূপ দিতে চায় আপন ইচ্ছায় কাঠ সেই রূপে রূপান্তরিত হয়। ইহা দেখিতে আমার বড়ই ভালো লাগিত। দারুণ ক্ষুধার কথা ভুলিয়া যাইতাম। পথের পাশে দাঁড়াইয়া মিস্ত্রির কাজ দেখিতাম। কাঠ যে রেন্দার আঘাতে ঘষিয়া ঘষিয়া কাটিতেছে, সেই ঘষা যেন আমি

আমার বুকে অনুভব করিতাম। বাটালের সাহায্যে কাঠ কাটিবার সময় আমার বুকের ভিতর যেন কেমন স্পন্দন অনুভব করিতাম। আজও কোথাও কোনো মিস্ত্রির কাঠকাটা দেখিলে আমি সেই স্পন্দন অনুভব করি।

এমনি করিয়া বহুক্ষণ দেরি করিয়া আবার বাড়ির পথে রওয়ানা হইতাম। কোনো কোনো দিন পথের মধ্যে কোনো দোকানের সামনে বান্দরওয়ালা বান্দর নাচায়, বৈরাগী বৈষ্টমী একতারা বাজাইয়া গান করে। এমনি কতরকমের আকর্ষণ। শহরে মাঝে মাঝে বড় রকমের খেলা হয়। ঢাকা হইতে খেলার দল আসিয়া ফরিদপুরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। কলিকাতা হইতে বড় বড় বক্তারা আসিয়া বক্তৃতা করেন। শহরের ছেলেরা বাড়ি হইতে খাইয়া আসিয়া ম্যাচ খেলা দেখে, বক্তৃতা শোনে। আমি অভুক্ত অবস্থায় বই-খাতা বগলে করিয়া খেলার মাঠে যাই। বক্তৃতা শুনি। তারপর বাড়ি ফিরিবার পথে ক্ষুধায় পেট জ্বলিতে থাকে। অনেক বলিয়া-কহিয়া কালেভদ্রে যেদিন পিতার নিকট হইতে একটি পয়সা আনিতে পারিতাম, তাই দিয়া মুদির দোকান হইতে এক পয়সার চিড়া আর একটু ফাউ চিনি লইয়া খাইতে খাইতে বাড়ির পথে রওয়ানা হইতাম। যেদিন মুদি চিড়ার সঙ্গে একটু ফাউ চিনি দিত না সেদিন এক পয়সায় ছোলা ভাজা কিনিয়া চিবাইতে চিবাইতে বাড়ি যাইতাম। ছোলা ভাজা বা চিড়া খাইতে অনেকক্ষণ লাগিত। ততক্ষণে বাড়ি আসিয়া পৌঁছিয়া যাইতাম।

চলবে…