সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাংশ
১। ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব ও নেটফ্লিক্স দেশের বিজ্ঞাপন বাজারের এক-তৃতীয়াংশ দখল করেছে, যা প্রতি বছর ১৫-২০% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২। টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও অনলাইন মিডিয়ার বিজ্ঞাপন শেয়ার কমছে, ফলে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।
৩। ডিজিটাল মাধ্যমগুলোর বাংলাদেশে অফিস না থাকায় কর ও ভ্যাট আদায় কম হচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
ডিজিটাল মিডিয়ার উত্থান ও বিজ্ঞাপন বাজারের পরিবর্তন
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব ও নেটফ্লিক্স দেশের বিজ্ঞাপন বাজারে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। বর্তমানে প্রায় ৪০ বিলিয়ন টাকার বিজ্ঞাপন বাজারের এক-তৃতীয়াংশ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম দখল করেছে, যেখানে টেলিভিশন চ্যানেল, সংবাদপত্র ও অনলাইন মিডিয়া বাকি অংশের জন্য প্রতিযোগিতা করছে।
দেশের প্রতিষ্ঠিত একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের অংশীদারিত্ব প্রতি বছর ১৫-২০% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে এই প্রবণতা আরও তীব্র হয়েছে।
প্রচলিত মিডিয়ার বিজ্ঞাপন শেয়ার কমছে
এক গবেষণা অনুযায়ী:
- টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপন শেয়ার প্রতি বছর ২-৩% হারে কমছে।
- সংবাদপত্র ও অনলাইন মিডিয়া সংস্থাগুলো বছরে ১০% হারে শেয়ার হারাচ্ছে।
তবে টেলিভিশন এখনও বিজ্ঞাপন বাজারের ৫০% ধরে রেখেছে।
বহুজাতিক কোম্পানি ও বিজ্ঞাপন খাতের পরিবর্তন
বহুজাতিক কোম্পানি ও দেশীয় সংস্থাগুলো বিজ্ঞাপন সংস্থার সাথে অংশীদারিত্ব করলেও মোট বিজ্ঞাপন ব্যয়ের ৩৬% কোম্পানির নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বিজ্ঞাপন বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়।
স্ট্যাটিস্টার পূর্বাভাস দিয়েছে যে,
- ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন বাজারের আকার হবে ৬৬৯.১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
- ২০২৯ সালের মধ্যে দেশের মোট বিজ্ঞাপন ব্যয়ের ৭৮% ডিজিটাল উৎস থেকে আসবে।
সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের বিস্তার ও সরকারের রাজস্ব ক্ষতি
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিজ্ঞাপন বাজার দখল করার ফলে সরকার পর্যাপ্ত কর ও ভ্যাট সংগ্রহ করতে পারছে না। কারণ,
- এই মাধ্যমগুলোর বাংলাদেশে অফিস নেই।
- তাদের কার্যক্রমের উপর পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ নেই।
বাংলাদেশি কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের উপার্জন আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় কম। উদাহরণস্বরূপ,
- ভারতীয় কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের তুলনায় তাদের উপার্জন এক-তৃতীয়াংশ।
- দর কষাকষির সুযোগ না থাকায় কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের আয় বাড়ছে না।
বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন শিল্পের চ্যালেঞ্জ
- বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলো সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপন সরবরাহ করলেও বিদেশি মুদ্রায় অর্থ প্রদান করতে হয়।
- বাংলাদেশে কোনো সামাজিক মাধ্যমের অফিস নেই, ফলে বিদেশ থেকে ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে।
- সরকার নীতিগত পদক্ষেপ নিলে রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব।
তার মতে– “যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর অফিস বাংলাদেশে থাকত, তবে সরকার এই খাত থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে পারত।”
টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ
একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্মকতা সারাক্ষনকে বলেন,
- সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপন জনপ্রিয় হচ্ছে কারণ এটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু দর্শকদের কাছে সহজেই পৌঁছানোর সুযোগ দেয়।
- টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্রের জন্য নির্ভরযোগ্য ডেটার অভাব তাদের বিজ্ঞাপন বাজারে প্রতিযোগিতা দুর্বল করছে।
সমাধান:
- টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের জন্য একটি নিরীক্ষা ব্যুরো গঠন করা।
- সাবস্ক্রিপশন মডেল চালু করা।
- সামাজিক মাধ্যমে কনটেন্ট প্রকাশ করে বিজ্ঞাপন আয় বৃদ্ধি করা।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের ক্ষতি
একটি বেসরকারি টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন বিভাগের প্রধান বলেন,
- বাংলাদেশে ৪০টি টেলিভিশন চ্যানেলকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা কঠিন।
- বাংলাদেশি চলচ্চিত্র শিল্পও ক্ষতির মুখে, কারণ খুব কম চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে পৌঁছাতে পারছে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন,
- মাত্র তিনটি বাংলাদেশি চলচ্চিত্র – ‘এতি তোমারই ঢাকা’, ‘কমলা রকেট’ ও ‘পিপড়া বিদ্যা’ নেটফ্লিক্সে স্থান পেয়েছে।
- নেটফ্লিক্সে তালিকাভুক্ত হতে ভারতীয় এজেন্টের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।
তিনি বলেন, “যদি নেটফ্লিক্সের অফিস বাংলাদেশে থাকত, তাহলে আরও বেশি বাংলাদেশি চলচ্চিত্র বিশ্বব্যাপী প্রদর্শিত হতে পারত।”
সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ ও ডিজিটাল রূপান্তর
এক শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন ও বিপণন প্রধান জানান,
- কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে সংবাদপত্রের পাঠকসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।
- বেশিরভাগ পাঠক বর্তমানে অনলাইনে সংবাদ পড়ছেন।
- বেসরকারি বিজ্ঞাপন প্রবাহও কমছে।
তিনি বলেন, “সংবাদপত্রের টিকে থাকার জন্য ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তর অপরিহার্য।”
উপসংহার: ডিজিটাল বিপ্লবের সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রয়োজন
বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন শিল্প দ্রুত ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তরিত হচ্ছে।
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আধিপত্য বাড়ছে।
- প্রচলিত মিডিয়া সংকটে পড়েছে।
- সরকার নীতিগত পদক্ষেপ নিলে রাজস্ব আয় বাড়তে পারে।
- টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও চলচ্চিত্র শিল্পকে ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে টিকে থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নীতিগত পরিবর্তন এবং প্রযুক্তির সাথে খাপ খাওয়ানোই এই খাতের টিকে থাকার একমাত্র উপায়।