০৭:০৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১২৯)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৪৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • 17

ধীরেনদের বাসায়

আমার জামাকাপড় ভালো ছিল না। পিতা খলিফাদের দোকান হইতে একটিমাত্র পকেটওয়ালা যে জামা কিনিয়া দিতেন, তাহা অন্যান্য ছাত্রদের হাল-ফ্যাশনের জামার পাশে একেবারে বেমানান দেখাইত। সেইসঙ্গে আমিও বেমানান হইয়া অন্যান্য ছাত্রদের মধ্যে একটা অবাঞ্ছিত ব্যক্তির মতো অতি জড়সড় হইয়া থাকিতাম। তাই ক্লাসের ভালো ছেলেরা দূরে থাক কোনো ছাত্রই আমার সঙ্গে মিশিত না। একমাত্র ধীরেন আমার সঙ্গে মিশিত। আমার হাতের লেখা ভালো ছিল না। আমি খুব আস্তে আস্তে লিখিতাম। ক্লাসের নোট টুকিয়া লইতে শিক্ষকেরা যে শ্রুতিলেখন দিতেন তাহাও আমি টুকিয়া লইতে পারিতাম না। ধীরেন তাহার নোটখাতাগুলি আমাকে দিত। সেই খাতা হইতে বাড়ি বসিয়া আমি নোট টুকিয়া লইতাম। এইজন্য প্রায়ই ধীরেনদের বাসায় যাওয়া উপলক্ষে কি করিয়া ধীরেনের মার সঙ্গে পরিচিত হইলাম তাহা পূর্বে বলিয়াছি।

এই ভদ্রমহিলা বড়ই স্নেহশীলা ছিলেন। একটু বেশি কথা বলিতেন। তাঁর সেই বেশি কথার আমি মনযোগী শ্রোতা ছিলাম। তাহা ছাড়া তাঁর ছেলের বন্ধু বলিয়া তিনি আমাকে ছেলের মতোই ভালোবাসিতেন। একবার গ্রীষ্মের ছুটির সময় আমি তাঁহাকে বলিলাম, “মা! বাড়ি বসিয়া আমার পড়াশুনা হয় না, আপনি যদি অনুমতি করেন, ছুটির কয়টি দিন আপনাদের এখানে থাকিয়া পড়াশুনা করিব। প্রতিদিন বাড়ি হইতেই আমি খাইয়া আসিব। সেজন্য আপনাকে কিছু করিতে হইবে না।” তিনি বলিলেন, “বেশ তো! আমার ছেলের সঙ্গে আসিয়া তুমি পড়াশুনা করিও।”

বইপত্র লইয়া ধীরেনদের বাড়িতে আসিলাম। রাত্রে এখানে থাকিয়া পড়াশুনা করিতাম। সকালে এগারোটা-বারোটার সময় বাড়ি যাইয়া খাওয়া-দাওয়া করিতাম। আবার সন্ধ্যার আগে খাইয়া এখানে আসিতাম।

আমি বালিশহীন বিছানায় শয়ন করিতাম। সুতরাং ধীরেনদের তক্তাপোশের উপর শুইয়া রাত্রে ঘুমাইতাম। আমার নিজস্ব কোনো বিছানাপত্রের প্রয়োজন হইত না।

রাত্রে শুইবার আগে আসন করিয়া বসিয়া সন্ন্যাসীর নিকট শেখা সাধন-প্রণালীগুলি অভ্যাস করিতাম। ইহাতে বাড়ির সকলেই আমার প্রতি আকৃষ্ট হইত। ধীরেনের এক খুড়াতো ভাই ছিলেন শ্রীমনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করিতেন। আমার পড়া বলিয়া দিতেন। ধীরেনদের বাসায় আসিয়া যে যে বিষয়ে আমি কাঁচা ছিলাম গ্রীষ্মের ছুটির একমাসে তাহা শিখিয়া ফেলিলাম।

চলবে…

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১২৯)

১১:০০:৪৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ধীরেনদের বাসায়

আমার জামাকাপড় ভালো ছিল না। পিতা খলিফাদের দোকান হইতে একটিমাত্র পকেটওয়ালা যে জামা কিনিয়া দিতেন, তাহা অন্যান্য ছাত্রদের হাল-ফ্যাশনের জামার পাশে একেবারে বেমানান দেখাইত। সেইসঙ্গে আমিও বেমানান হইয়া অন্যান্য ছাত্রদের মধ্যে একটা অবাঞ্ছিত ব্যক্তির মতো অতি জড়সড় হইয়া থাকিতাম। তাই ক্লাসের ভালো ছেলেরা দূরে থাক কোনো ছাত্রই আমার সঙ্গে মিশিত না। একমাত্র ধীরেন আমার সঙ্গে মিশিত। আমার হাতের লেখা ভালো ছিল না। আমি খুব আস্তে আস্তে লিখিতাম। ক্লাসের নোট টুকিয়া লইতে শিক্ষকেরা যে শ্রুতিলেখন দিতেন তাহাও আমি টুকিয়া লইতে পারিতাম না। ধীরেন তাহার নোটখাতাগুলি আমাকে দিত। সেই খাতা হইতে বাড়ি বসিয়া আমি নোট টুকিয়া লইতাম। এইজন্য প্রায়ই ধীরেনদের বাসায় যাওয়া উপলক্ষে কি করিয়া ধীরেনের মার সঙ্গে পরিচিত হইলাম তাহা পূর্বে বলিয়াছি।

এই ভদ্রমহিলা বড়ই স্নেহশীলা ছিলেন। একটু বেশি কথা বলিতেন। তাঁর সেই বেশি কথার আমি মনযোগী শ্রোতা ছিলাম। তাহা ছাড়া তাঁর ছেলের বন্ধু বলিয়া তিনি আমাকে ছেলের মতোই ভালোবাসিতেন। একবার গ্রীষ্মের ছুটির সময় আমি তাঁহাকে বলিলাম, “মা! বাড়ি বসিয়া আমার পড়াশুনা হয় না, আপনি যদি অনুমতি করেন, ছুটির কয়টি দিন আপনাদের এখানে থাকিয়া পড়াশুনা করিব। প্রতিদিন বাড়ি হইতেই আমি খাইয়া আসিব। সেজন্য আপনাকে কিছু করিতে হইবে না।” তিনি বলিলেন, “বেশ তো! আমার ছেলের সঙ্গে আসিয়া তুমি পড়াশুনা করিও।”

বইপত্র লইয়া ধীরেনদের বাড়িতে আসিলাম। রাত্রে এখানে থাকিয়া পড়াশুনা করিতাম। সকালে এগারোটা-বারোটার সময় বাড়ি যাইয়া খাওয়া-দাওয়া করিতাম। আবার সন্ধ্যার আগে খাইয়া এখানে আসিতাম।

আমি বালিশহীন বিছানায় শয়ন করিতাম। সুতরাং ধীরেনদের তক্তাপোশের উপর শুইয়া রাত্রে ঘুমাইতাম। আমার নিজস্ব কোনো বিছানাপত্রের প্রয়োজন হইত না।

রাত্রে শুইবার আগে আসন করিয়া বসিয়া সন্ন্যাসীর নিকট শেখা সাধন-প্রণালীগুলি অভ্যাস করিতাম। ইহাতে বাড়ির সকলেই আমার প্রতি আকৃষ্ট হইত। ধীরেনের এক খুড়াতো ভাই ছিলেন শ্রীমনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করিতেন। আমার পড়া বলিয়া দিতেন। ধীরেনদের বাসায় আসিয়া যে যে বিষয়ে আমি কাঁচা ছিলাম গ্রীষ্মের ছুটির একমাসে তাহা শিখিয়া ফেলিলাম।

চলবে…