ধীরেনদের বাসায়
মা সংসারের খরচ হইতে বাঁচাইয়া অনেক টাকা জমাইয়াছিলেন। কিন্তু তিনি খুবই সরলপ্রাণা মহিলা ছিলেন। কেহ আসিয়া মা বলিয়া ডাকিলে তিনি গলিয়া যাইতেন। আনন্দী নামে এক গাড়োয়ান মার নিকট হইতে গাড়ি ও ঘোড়া কিনিবার জন্য ছয়শত টাকা ধার লয়। সেই টাকা মা আর ফিরিয়া পান নাই। এরূপ বহু সন্তানের অত্যাচারে মায়ের সঞ্চিত অর্থ সবই ফুরাইয়া যাইত। মা কয়েকদিন তাহাদের গালমন্দ করিতেন। তাহারা এ-পাড়ার ধার দিয়াও যাইত না। মা আবার কঠোরতরভাবে সংসারের খরচ কমাইয়া টাকা সঞ্চয় করিতেন। এই মা’টি আমাকে বড়ই ভালোবাসিতেন। সামান্য সামান্য কয়েকটি ঘটনা মনে পড়িতেছে। তাহাতেই বুঝা যাইবে তিনি এই পরের ছেলেটিকে কতই ভালোবাসিতেন। বাড়িতে পূজা-পার্বণে যে বিশেষ খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হইত এমন নয়। তবুও সেখানে সামান্য কিছু উপচারের ব্যবস্থা হইলে মা আমাকে তাহার ভাগ দিতেন। সেবার কি একটা পূজার সময় বাজার হইতে কয়েকটি রসগোল্লা আনা হইয়াছিল। ছেলেমেয়েরা প্রত্যেকেই একটা করিয়া রসগোল্লা পাইল। আমার রসগোল্লাটি আমাকে দিবার জন্য মায়ের মনে ছিল না।
আমি তখন শুইয়া আধঘুমে। বাতি জ্বালাইয়া রাসমোহন দাদা পড়িতেছেন। মা আসিয়া রাসমোহন দাদাকে বলিলেন, “সবাইকে মিষ্টি দেওয়া হইয়াছে, সাধুকে দিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম। ওকে ডাক দিয়া দাও।” ঘুমন্ত কাউকে ডাক দেওয়া পাপ। নিজে সেই পাপ না করিয়া মা রাসমোহন দাদাকে দিয়া সেই পাপ করাইতে চাহিলেন। রাসমোহন দাদা বলিলেন, “ও ঘুমাইয়া আছে। ওকে ডাক দিয়া ঘুম ভাঙাইয়া কাজ নাই।” মা বলিলেন, “না। না। রাসমোহন। এই মিষ্টিটা ওকে না দিলে আমার সারারাত ঘুম হইবে না।” আমি শুইয়া শুইয়া সবই শুনিতেছিলাম। রাসমোহন দাদা দুই-এক ডাক দিতেই আমি উঠিয়া বসিলাম। মা অতি স্নেহের সঙ্গে একটি রসগোল্লা আমার হাতে দিলেন।
মিষ্টিটি খাইয়া শুইয়া শুইয়া কত কথাই ভাবিতে লাগিলাম। সেই সামান্য একটি রসগোল্লার কিইবা দাম। কিন্তু ইহার ভিতর দিয়া মায়ের যে মমতাবোধের পরিচয় পাইলাম তাহা আমাকে আকুল করিয়া তুলিল। মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, এই মায়ের যে-কোনো আদেশের জন্য আমি জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারি। প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে বাড়ি হইতে খাইয়া আসিতাম। যেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হইত, বাড়ি যাইতে পারিতাম না; মা আমাকে ডাকিয়া বলিতেন, “সাধু! আজ তুমি আমাদের এখানে খাইবে।”
আমি কোনোদিনই রোগীর সেবা-শুশ্রূষা করি নাই। একবার মায়ের এক মেয়ের কলেরা হইল। মেয়েটির বয়স ছয়-সাত বৎসর। খুব সম্ভব তার নাম ছিল বেলা। সেবা-সমিতির রেবতীদাদা, অমিয়দাদা আসিলেন রোগীর সেবা-শুশ্রূষা করিতে। আমিও তাহাদের সঙ্গে লাগিয়া গেলাম! কাহারও বাড়িতে কোনো লোকের সেবা-শুশ্রূষা করিতে মেথরের কাজ হইতে আরম্ভ করিয়া রোগীর ঔষধ-পথ্য খাওয়ানো পর্যন্ত সব সেবা-সমিতির সভ্যদিগকেই করিতে হইত। কলেরা রোগী দশ-পনেরো মিনিট অন্তর পায়খানা করে, বমি করে। তাহা কখনও নেকড়ায় ধরিয়া কখনও হাতে ধরিয়া আমরা সাফ করিয়া দিতাম। মাঝে মাঝে পার-রেকটাল সেলাইন দিতে হইত। এই কাজে রেবতীদাদা খুবই পারদর্শী ছিলেন। সেবা-সমিতির কাজ করিতে করিতে পরে তিনি হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার হইয়াছিলেন। তখনকার দিনে কুলীন হিন্দুসমাজে মেয়ের প্রতি তত দরদ ছিল না।
চলবে…