০১:৫৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৩৮)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:১৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩ মার্চ ২০২৫
  • 15

মনাদা

শ্রীশবাবুর বাসায় থাকিতে তাঁহার দূর-সম্পর্কের ভাইপো মণীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় চাকরির উমেদারি করিতে সেখানে আসিয়া উঠিলেন। বাড়ির অন্যান্য ছেলেদের মতো তাঁকে আমিও মনাদা বলিয়া ডাকিতাম। মনাদা আমাকে বড়ই স্নেহের চক্ষে দেখিতেন। তাঁর একটু একটু লিখিবার অভ্যাস ছিল। তিনি আমার লেখাগুলি পড়িয়া আমাকে খুবই উৎসাহ দিতেন। শেষরাত্রে মনাদা উঠিয়া সেতার বাজাইতেন। খুব যে তিনি ভালো বাজাইতেন এমন নয়: কিন্তু তখনকার কিশোর-বয়সের মনে সেই সেতারের সুর অমৃত বর্ষণ করিত। মনে হইত, এমন বাজাইতে বুঝি পৃথিবীর আর কেহ পারে না। শেষরাত্রে মনাদার সেতার বাজনার ঝঙ্কারে ঘুম ভাঙিয়া যাইত। বিছানায় থাকিয়া অনেকক্ষণ সেই বাজনার সঙ্গে আধোঘুমের স্বপ্ন মিশ্রিত করিয়া চুপ করিয়া শুইয়া থাকিতাম। তারপর উঠিয়া আসিয়া মনাদার পার্শ্বে বসিতাম। মনাদা তখন সেতার বাজাইতে বাজাইতে গান ধরিতেন:

কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব তোমারি রসাল নন্দনে।

তখনকার দিনে রবীন্দ্রনাথের গান তত প্রচলিত হয় নাই। রজনী সেনই মধ্যবিত্ত বাঙালিসমাজের মন আকর্ষণ করিয়া আছেন।

মনাদার এই গানের অন্তর্নিহিত ভাব বুঝিবার বয়স তখনও আমার হয় নাই। কেবলই মনে হইত মরুভূমির মধ্যে বসিয়া একটি লোক বলিতেছে কখন আমি স্বর্গের রসাল নন্দনে যাইতে পারিব। সেখানে দুঃখ নাই, বিষাদ নাই। শুধুই আনন্দ।

প্রতিদিনই মনাদা এই একই গান গাহিতেন। এ-গান যতই শুনিতাম ততই আমার ভালো লাগিত। তার চাইতেও ভালো লাগিত মনাদার সেতার বাজনা। বাজনা শুনিতে শুনিতে আমার মনে হইত, একটি খুব সুন্দর মেয়ে সেই সেতারের বাজনার তালে তালে মহাশূন্যের উপর নাচিয়া বেড়াইতেছে। সূর্য উঠিলে মনাদা উঠিয়া যাইতেন। আমি বসিয়া বসিয়া সেই সুন্দর মেয়েটিকে ধ্যান করিতাম।

মনাদা শুধু গান গাহিয়া আর সেতার বাজাইয়াই আমার কিশোর-মনটিকে আকৃষ্ট করিয়াছিলেন না; যেখানে যাহা কিছু দেখিয়া আসিতেন তাহা তিনি সুন্দর হাস্য-রসে মিশাইয়া বলিতে পারিতেন। মাঝে মাঝে বাড়ির সকল ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে একত্রিত হইয়া সেইসব কাহিনী শুনিয়া আমরা হাসিয়া আকাশ-বাতাস ফাটাইতাম। একবার মনাদা ধীরেনের মেজদিদি মৃণালিনী দেবীর শ্বশুরবাড়িতে তিনদিনের জন্য বেড়াইতে যান। ফিরিয়া আসিলে আমরা সকলে ধরিলাম, “মনাদা। এবারের ভ্রমণে কি কি ঘটিল বলেন।” এ-কাজের ও-কাজের বাহানা করিয়া তিনি আমাদিগকে দুই-তিনদিন ঘুরাইলেন। পরে একদিন রাত্রকালে মনাদাকে বিশেষ করিয়া ধরিলাম, “আজ আপনার ভ্রমণকাহিনী না বলিলেই নয়।”

একটু কাশিয়া মনাদা তাঁর ভ্রমণকাহিনী বলিতে আরম্ভ করিলেন, মেজদি, সেজদি পাশে দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিলেন। সেই বাটকেমারী গ্রামে যাইতে কি করিয়া নৌকা ভাড়া করিলেন, নৌকার মাঝিদের সঙ্গে কিভাবে দর-দস্তুর করিলেন, তারপর বাড়ি পৌঁছিলে বাড়ির কর্তা মেজদির শ্বশুর বৈষয়িক মানুষ, মনাদাকে পরীক্ষা করিবার জন্য কিভাবে কথা বলিলেন, সবকিছু অনুকরণ করিয়া মনাদা আমাদিগকে শুনাইলেন। তারপর খাইবার সময় তিনি পিঁড়িতে বসিয়া আছেন, কিভাবে বাড়ির গৃহিণী এক-একটি জিনিস আনিয়া দিতেছেন, তখন মনাদার মনে কি ভাব জাগিতেছে, এইসব মনাদা এমনই হাস্য-কৌতুক মিশাইয়া বলিলেন যে, হাসিতে হাসিতে আমাদের পেট ব্যথা হইয়া গেল।

 

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৩৮)

১১:০০:১৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩ মার্চ ২০২৫

মনাদা

শ্রীশবাবুর বাসায় থাকিতে তাঁহার দূর-সম্পর্কের ভাইপো মণীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় চাকরির উমেদারি করিতে সেখানে আসিয়া উঠিলেন। বাড়ির অন্যান্য ছেলেদের মতো তাঁকে আমিও মনাদা বলিয়া ডাকিতাম। মনাদা আমাকে বড়ই স্নেহের চক্ষে দেখিতেন। তাঁর একটু একটু লিখিবার অভ্যাস ছিল। তিনি আমার লেখাগুলি পড়িয়া আমাকে খুবই উৎসাহ দিতেন। শেষরাত্রে মনাদা উঠিয়া সেতার বাজাইতেন। খুব যে তিনি ভালো বাজাইতেন এমন নয়: কিন্তু তখনকার কিশোর-বয়সের মনে সেই সেতারের সুর অমৃত বর্ষণ করিত। মনে হইত, এমন বাজাইতে বুঝি পৃথিবীর আর কেহ পারে না। শেষরাত্রে মনাদার সেতার বাজনার ঝঙ্কারে ঘুম ভাঙিয়া যাইত। বিছানায় থাকিয়া অনেকক্ষণ সেই বাজনার সঙ্গে আধোঘুমের স্বপ্ন মিশ্রিত করিয়া চুপ করিয়া শুইয়া থাকিতাম। তারপর উঠিয়া আসিয়া মনাদার পার্শ্বে বসিতাম। মনাদা তখন সেতার বাজাইতে বাজাইতে গান ধরিতেন:

কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব তোমারি রসাল নন্দনে।

তখনকার দিনে রবীন্দ্রনাথের গান তত প্রচলিত হয় নাই। রজনী সেনই মধ্যবিত্ত বাঙালিসমাজের মন আকর্ষণ করিয়া আছেন।

মনাদার এই গানের অন্তর্নিহিত ভাব বুঝিবার বয়স তখনও আমার হয় নাই। কেবলই মনে হইত মরুভূমির মধ্যে বসিয়া একটি লোক বলিতেছে কখন আমি স্বর্গের রসাল নন্দনে যাইতে পারিব। সেখানে দুঃখ নাই, বিষাদ নাই। শুধুই আনন্দ।

প্রতিদিনই মনাদা এই একই গান গাহিতেন। এ-গান যতই শুনিতাম ততই আমার ভালো লাগিত। তার চাইতেও ভালো লাগিত মনাদার সেতার বাজনা। বাজনা শুনিতে শুনিতে আমার মনে হইত, একটি খুব সুন্দর মেয়ে সেই সেতারের বাজনার তালে তালে মহাশূন্যের উপর নাচিয়া বেড়াইতেছে। সূর্য উঠিলে মনাদা উঠিয়া যাইতেন। আমি বসিয়া বসিয়া সেই সুন্দর মেয়েটিকে ধ্যান করিতাম।

মনাদা শুধু গান গাহিয়া আর সেতার বাজাইয়াই আমার কিশোর-মনটিকে আকৃষ্ট করিয়াছিলেন না; যেখানে যাহা কিছু দেখিয়া আসিতেন তাহা তিনি সুন্দর হাস্য-রসে মিশাইয়া বলিতে পারিতেন। মাঝে মাঝে বাড়ির সকল ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে একত্রিত হইয়া সেইসব কাহিনী শুনিয়া আমরা হাসিয়া আকাশ-বাতাস ফাটাইতাম। একবার মনাদা ধীরেনের মেজদিদি মৃণালিনী দেবীর শ্বশুরবাড়িতে তিনদিনের জন্য বেড়াইতে যান। ফিরিয়া আসিলে আমরা সকলে ধরিলাম, “মনাদা। এবারের ভ্রমণে কি কি ঘটিল বলেন।” এ-কাজের ও-কাজের বাহানা করিয়া তিনি আমাদিগকে দুই-তিনদিন ঘুরাইলেন। পরে একদিন রাত্রকালে মনাদাকে বিশেষ করিয়া ধরিলাম, “আজ আপনার ভ্রমণকাহিনী না বলিলেই নয়।”

একটু কাশিয়া মনাদা তাঁর ভ্রমণকাহিনী বলিতে আরম্ভ করিলেন, মেজদি, সেজদি পাশে দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিলেন। সেই বাটকেমারী গ্রামে যাইতে কি করিয়া নৌকা ভাড়া করিলেন, নৌকার মাঝিদের সঙ্গে কিভাবে দর-দস্তুর করিলেন, তারপর বাড়ি পৌঁছিলে বাড়ির কর্তা মেজদির শ্বশুর বৈষয়িক মানুষ, মনাদাকে পরীক্ষা করিবার জন্য কিভাবে কথা বলিলেন, সবকিছু অনুকরণ করিয়া মনাদা আমাদিগকে শুনাইলেন। তারপর খাইবার সময় তিনি পিঁড়িতে বসিয়া আছেন, কিভাবে বাড়ির গৃহিণী এক-একটি জিনিস আনিয়া দিতেছেন, তখন মনাদার মনে কি ভাব জাগিতেছে, এইসব মনাদা এমনই হাস্য-কৌতুক মিশাইয়া বলিলেন যে, হাসিতে হাসিতে আমাদের পেট ব্যথা হইয়া গেল।