মনাদা
আমি যেমন মনাদাকে ভালোবাসিতাম, শ্রদ্ধা করিতাম, মনাদাও আমাকে তেমনি ভালোবাসিতেন ও শ্রদ্ধা করিতেন। তিনি আমার সেই বয়সের কবিতাগুলি আমার সাহিত্য-জীবনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ মনে মনে পোষণ করিতেন। সেকথা তিনি আমার অগোচরে বাড়ির অন্যান্য লোকদের নিকটেও বলিতেন।
সেবার পদ্মা নদীতে ভীষণ ভাঙন ধরিল। আমাদের গ্রামের মরা নদীর ওপারে চরকেষ্টপুর-তারপর সালদার চর-তারও অনেক দূরে ছিল পদ্মা নদী। সেই পদ্মা নদীর কত কাহিনী আমরা শুনিতাম মুরুব্বিদের মুখে। আমার পিতা একবার নটা-ঘাস আনিতে পদ্মা নদীর ওপারে গিয়াছিলেন। তারপর মাঝনদীতে আসিয়া নৌকা ডুবিয়া গেল। ভাসিতে ভাসিতে তাঁহারা যাইয়া উঠিলেন নটাখোলার চরে। সেখানে পরনের কাপড় ছিঁড়িয়া নটা-ঘাসের ডাঁটার সঙ্গে ফরা বাঁধিলেন, দূর হইতে কোনো নৌকার মাঝি এই বিপদসংকেত দেখিয়া যদি তাঁহাদের সাহায্য করিতে আসে। এই কাহিনী আগেই বলিয়াছি।
সেই পদ্মা নদীতে এবার ভাঙন ধরিল। নটাখোলা, সালতার চর ভাঙিয়া এবার পদ্মা নদী চরকেষ্টপুর আসিয়া পৌঁছিল। আমাদের বাড়ি হইতে বড় বড় স্টিমারের শিঙা দেখা যাইতে লাগিল। মাঝে মাঝে আমরা জলি পাইঙ্গার বিল পার হইয়া পদ্মা নদী দেখিতে যাইতাম। পরের বর্ষায় মাধবদিয়া ভাঙিয়া চরকেষ্টপুর গ্রাম পার হইয়া পদ্মা নদী বাড়ির সামনের মরা নদীতে আসিয়া মিশিল। পদ্মার সে কি শুষানি! রাত্রে ঘুম হইতে জাগিয়া শুনিতাম ঢেউ-এর পর ঢেউ কূলে আসিয়া আঘাত করিতেছে-আর শোঁ শোঁ শোঁ শব্দ হইতেছে।
সকালে নদীর ধারে আসিয়া দাঁড়াই। ঘূর্ণিগুলি গোল চক্র হইয়া পারে আসিয়া আঘাত করে। প্রপারের নিচের মাটি ধুইয়া যায়। তারপর একটি ভীষণ শব্দ করিয়া গাছগাছালিসহ অনেকখানি জমি নদীতে হুমড়ি খাইয়া ভাঙিয়া পড়ে। দলে দলে নদী-তীরের বাসিন্দারা ঘরবাড়ি ভাঙিয়া দূরবর্তী স্থানে বাঁশের পেলা দিয়া চালাগুলি আটকাইয়া রাখিতেছে। তাহারই তলায় ছেলে-মেয়ে-পরিবার লইয়া তাহারা ঘর-সংসার পাতিয়াছে। সেখানে বসিয়া বসিয়া তাহারা কোনো অজানা চরের নতুন বসতি বিস্তারের স্বপ্ন দেখিতেছে। দূরে-বহুদুরে কোথায় নতুন চর পড়িবে। সেখানে যাইয়া আবার তাহারা গ্রাম রচনা করিবে। আবার বালুর উপর শ্যামল শষ্যক্ষেতের আল্পনা রচনা করিবে। পদ্মার ভাঙনের কাছে পরাজিত হইলে চলিবে না। কোথায় কোন দূরে উড়ানীর চর, তাহাও ছাড়াইয়া সাড়ার চর-যেখানে সাড়ার পুল।
বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের পরম তেলেসমাতি, এই বড় পদ্মার উপরে বাঁধ গড়িয়াছে। মোড়ল আসিয়া খবর বলিয়াছে-সেইখানে যাইয়া তাহারা নতুন গ্রাম গড়িবে। পেটে ভাত নাই-পরনে কাপড় নাই-তবু তাহারা আশাশূন্য হয় না। ভাই-ভাস্তে, বন্ধু-স্বজন, প্রতিবেশী, আত্মীয় সকলে মিলিয়া জল্পনা-কল্পনা করে।
পদ্মা কিন্তু চুপ করিয়া থাকে না। মরা গাঙের ওপারে চরকেষ্টপুর ভাঙিয়া সতর খাদা, আলীপুর, গোবিন্দপুর পর্যন্ত বহু গ্রাম পদ্মার জলে ভাসিয়া গেল। গ্রামের শত বৎসরের বটগাছটি-কত কালের কত ঘটনার সাক্ষ্য হইয়া উন্নত শিরে দাঁড়াইয়া ছিল, যার তলে আসিয়া শ্রান্ত পথিকেরা শীতল বাতাসে বিশ্রাম করিত, যাহার শাখায় নানারকমের পাখিরা আসিয়া আশ্রয় লইত; সেই বটগাছটিও একদিন হুমড়ি খাইয়া পদ্মার বুকে ভাঙিয়া পড়িল। ভাঙন এখন এতই দ্রুত আরম্ভ হইল যে, গ্রামবাসীরা অনেকেই যার যার ঘরবাড়ি সরাইয়া লইবার অবসর পাইল না। সাধারণত এরূপ অবস্থায় তাহারা একে অপরের সাহায্যে আগাইয়া আসে। কিন্তু সকলেরই আজ এক অবস্থা। কাহার সাহায্য কে করে। কাহার ঘরবাড়ি কে সরাইয়া দেয়। যাহাদের পয়সা আছে তাহারা অধিক মূল্যে জন খাটাইয়া ঘরবাড়ি সরাইয়া লয়। গরিব লোকদের ঘরবাড়ি নদীর জলে ভাসিয়া যায়। দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া তাহারা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে।