সারাক্ষণ রিপোর্ট
সম্প্রতি ইউরোপে কট্টর ডানপন্থী রাজনীতি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কিন্তু উদারপন্থীরা এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় কার্যকর অবস্থান নিতে পারছে না। বিষয়টি নিয়ে মতভেদ রয়েছে:
- কেউ মনে করেন, কট্টর ডানদের সঙ্গে কোনো জোট নয়—এটাই নিরাপদ পথ।
- আবার ইউরোপীয় পিপলস পার্টির নেতা মানফ্রেড ওয়েবারের মতো অনেকে বিশ্বাস করেন, ডানপন্থী নেতাদের ক্ষমতায় আনলে তারা ‘মধ্যপন্থী’ হয়ে উঠবে।
- তৃতীয় মত হলো, ক্ষমতার বাস্তবতা এই নেতাদের মাঝামাঝি পথে আসতে বাধ্য করবে।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এই আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।
প্রথমে আশার আলো, পরে ফিরে আসা পুরনো শঙ্কায়
২০২২ সালে মেলোনি ক্ষমতায় আসার সময় অনেকেই আতঙ্কিত হন, কারণ একসময় তিনি নিজেকে ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনির অনুসারী বলেছিলেন।
তবে ন্যাটো ও ইউক্রেনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তিনি অনেককে আশ্বস্ত করেন।
অনেকে ভাবেন, তিনি ‘নরম ডানপন্থী’।
কিন্তু ২০২৪ সালের দিকে দেখা যায়, এটা ছিল সাময়িক মুখোশ। তিনি আবার স্পষ্টভাবে কট্টর ডান নীতির দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নরম, ঘরোয়া নীতিতে কঠোর অবস্থান
বিদেশ নীতিতে মেলোনি নমনীয় থাকলেও দেশের ভেতরে তার অবস্থান ছিল কট্টর। উদাহরণ:
- সমলিঙ্গ দম্পতির সন্তানের জন্মনিবন্ধন বন্ধ করে দেওয়া
- বিচার বিভাগে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা
- সাংবাদিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি
- রাষ্ট্রীয় টিভিতে দলীয় লোক নিয়োগ
এই নীতিগুলো থেকেই বোঝা যায়, মেলোনি ‘ইতালীয় মডেল’-এর মাধ্যমে ইউরোপের অন্য ডানপন্থীদের অনুপ্রাণিত করছেন।
বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া ও সুইডেনেও একই ধারা দেখা যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে ডানদিকে সরে যাওয়ার কৌশল
২০২৪ সালে জি-৭ সম্মেলনে ইতালি যৌনতা ও গর্ভপাত সংক্রান্ত শব্দ বাদ দিতে চায়—এটা ছিল বড় ইঙ্গিত।
এরপর তিনি CPAC-এ গিয়ে আমেরিকার গণমাধ্যম, ‘ওক সংস্কৃতি’ এবং গ্লোবাল এলিটদের কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন।
এসবই দেখায়, মেলোনি পরিকল্পিতভাবে আরও কট্টর অবস্থানের দিকে এগোচ্ছেন।
ইউক্রেন ইস্যুতে অবস্থানের পরিবর্তন
শুরুতে ইউক্রেনের প্রতি জোরালো সমর্থন থাকলেও এখন তার ভাষা অনেকটা পাল্টে গেছে:
- ইউক্রেনের নাম উল্লেখ না করে শুধু ‘নিরাপত্তা গ্যারান্টি’র কথা বলেন
- ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ইউক্রেনপন্থী প্রস্তাবে ভোট দেননি
- জাতিসংঘ অনুমোদন ছাড়া সেনা না পাঠানোর কথা বলেন
- শান্তিপ্রক্রিয়ায় রাশিয়াকেও রাখার দাবি জানান
সবকিছুতেই তিনি ইউরোপের প্রতিক্রিয়া বুঝে ধাপে ধাপে এগোচ্ছেন।
ইউরোপে কট্টর ডান জোটের বিস্তার
২০১৩ সালে মেলোনির একমাত্র ডানপন্থী মিত্র ছিলেন হাঙ্গেরির ভিক্টর অরবান।
কিন্তু এখন আটটি দেশে কট্টর ডান সরকারে এবং আরও দুটি দেশে তারা ক্ষমতায় আসার পথে।
২০২৪ সালে ইউরোপীয় নির্বাচনে মেলোনির জোট লিবারেল ও গ্রিন দলগুলোকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়।
ফলে তার ইউরোপপন্থী ভাবমূর্তির আর দরকার পড়ছে না।
যদিও ইতালি ইইউ থেকে কোভিড-পরবর্তী সহায়তা হিসেবে ২২০ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে, তবুও তিনি ইইউ নেতৃত্বের পুনর্নির্বাচনের বিরোধিতা করছেন এবং ইউরোপ-বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন।
‘মধ্যপন্থী’ ভাবা ছিল বড় ভুল
মেলোনিকে ‘নরম’ ডানপন্থী ভাবাটা ছিল বড় রকমের ভুল।
ইতিহাস বলছে, এই ভুলই কট্টর ডানদের আরও ক্ষমতাশালী করেছে।
ইতালিতে এখন মেলোনির দল ডানপন্থার মূল শক্তি।
অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসেও একই ধারা দেখা যাচ্ছে।
মেলোনির আদর্শ—‘শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান পশ্চিমা’ ঐক্য গড়ে তোলা।
কিন্তু এই ভাবনা একধরনের স্ববিরোধী জাতীয়তাবাদ, যা ইউরোপীয় ঐক্যের জন্য হুমকি।
ট্রাম্পের প্রভাব ও ইউরোপের ঝুঁকি
ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় এলে ইউরোপের জন্য বড় হুমকি তৈরি হতে পারে।
তিনি ইউরোপীয় দেশগুলোকে জিডিপির ৫% প্রতিরক্ষা খাতে খরচের চাপ দিচ্ছেন—যেখানে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করছে ৩.৪% এবং ইতালি মাত্র ১.৫%।
ইতোমধ্যে ইউরোপীয় পণ্যে শুল্ক আরোপ শুরু করেছেন, যার প্রভাব ইতালির ওপর পড়বে।
মেলোনি ট্রাম্পের মতাদর্শে বিশ্বাসী হলেও, তার নীতিই ইউরোপ ও ইতালির জন্য বিপজ্জনক।
বাস্তব বোঝার সময় এখন
উদারপন্থীদের এখন মেলোনিদের ‘মধ্যপন্থী’ ভাবার বিভ্রান্তি কাটাতে হবে।
এই কট্টর ডানপন্থীরা নিজেদের ‘জনগণের প্রতিনিধি’ বললেও, তারা ইউরোপের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য হুমকি।
এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই ভবিষ্যতের কৌশল গড়ে তুলতে হবে।
ভুল বোঝাবুঝি না করে এখন সময় সত্যকে স্বীকার করার।