সৌমিত্র শুভ্র
পহেলা এপ্রিল দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে বাংলাদেশকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন ঘিরে দেশটির সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে প্রতিক্রিয়া এসেছে। সাথে রাজনৈতিক অঙ্গনেও প্রতিবেদন ও এর বিষয়বস্তু ঘিরে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘অ্যাজ বাংলাদেশ রিইনভেন্টস ইটসেলফ্, ইসলামিস্ট হার্ড লাইনারস্ সি অ্যান ওপেনিং’, অর্থাৎ বাংলাদেশ যখন নতুন রূপে গড়ে উঠছে, তখন ইসলামী কট্টরপন্থিরা নতুন সুযোগ দেখছে।
প্রতিবেদনে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে গত কয়েক মাসের বেশ কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হয়।
এতে নারীদের প্রতি বিদ্বেষ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ইসলামী গোষ্ঠী আহমদিয়াদের ওপর হামলার মত বিষয়ে উদ্বেগ ও অভিযোগ উঠে আসে।
এছাড়া, ইসলামী রাজনৈতিক দল ও কট্টরপন্থি সংগঠন এবং স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ভাবনা ও কর্মকাণ্ড বর্ণনা করে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
এসব গোষ্ঠীর তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিরুদ্ধে নমনীয়তার অভিযোগের কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এদিকে, প্রতিবেদন প্রকাশের দিনেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবেদনটিকে ‘বিভ্রান্তিকর এবং একপেশে’ বলে উল্লেখ করে বিবৃতি দেয়া হয়।
পরদিন মানে দোসরা এপ্রিল অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ‘উগ্রবাদের উত্থানের’ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন।
একই দিনে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও বলেছেন, বাংলাদেশে উগ্রবাদের উত্থানের যেকোন চেষ্টা প্রতিহত করবে সরকার।
তবে, বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা বলছেন, গত কয়েক মাসে ঘটা বেশ কয়েকটি ঘটনায় একদিকে সরকারের নমনীয়তা বারবার দৃশ্যমান হয়েছে, আবার সরকারের কাজের সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে সেগুলোর বিরোধিতাও করতে দেখা গেছে সরকারকে।
গত কয়েক মাসে নারী নিপীড়ন ও মব সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সরব হতে দেখা গেছে অনেককে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেছেন, “উগ্রপন্থার উত্থান, নারীবিদ্বেষ ও প্রতিক্রিয়াশীলতার ঘটনা যতটা ঘটেছে, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে তার সবই বরং প্রতিফলিত হয়নি। এসব ক্ষেত্রে সরকারের নমনীয়তাও বারবার দৃশ্যমান হয়েছে।”
আর, সরকারের পক্ষ থেকে একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদকে কোনো ‘গ্রাউন্ড’ (ভিত্তি) ছাড়া ‘মিসলিডিং’ (বিভ্রান্তিকর) বলে অপবাদ দেয়ার এখতিয়ার সরকারের নেই বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী।
“এতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বহির্বিশ্বে নেতিবাচক ধারণা যায়,” বলেন তিনি।
আলোচিত ঘটনাসমূহ
নিউইয়র্ক টাইমসে যেসব ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে সেগুলোর কোনো কোনোটি বিবিসি বাংলাসহ বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও শিরোনাম হয়েছে এর আগে।
গত ছয়ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে ‘ওড়না পরা’ নিয়ে হেনস্তার অভিযোগে আলোচনা সৃষ্টি হলে গ্রেফতার করা হয় মোস্তফা আসিফ অর্ণব নামের এক ব্যক্তিকে।
পরদিন ওই ব্যক্তিকে আদালতে পাঠানো হলে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর মোস্তফা আসিফ অর্ণবকে সমর্থন করা একদল লোক তাকে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন হাতে দিয়ে এবং মাথায় পাগড়ি ও গলায় ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করেন।
গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকেই নারীদের হেনস্তা, লঞ্চিত হওয়ার নানারকম অভিযোগ উঠেছে।
এমনকি নারী তারকাদের শোরুম উদ্বোধনের করতে না দেয়া, অনুষ্ঠানে বাধা দেয়ার মতো একাধিক ঘটনা ঘটেছে।
কিন্তু, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকর ভূমিকা দেখা যায়নি বলে সমালোচনা করতে দেখা গিয়েছে অনেককে।
গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন নারী বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অবস্থার মাঝে তারা নিরাপদ বোধ করছেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে ‘ওড়না পরা’ নিয়ে হেনস্তার অভিযোগ ওঠা অর্ণব জামিন পেলে তাকে ফুলের মালা পরানো হয়।
চলতি বছরের ৩০শে জানুয়ারি ‘তৌহিদী জনতা’ তথা ‘বিক্ষুব্ধ মুসল্লিদের’ দাবির মুখে বাংলাদেশের দিনাজপুর এবং জয়পুরহাটে নারীদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বিষয়টা শুধু খেলা বন্ধতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। খেলাকে কেন্দ্র করে এক জেলায় তৌহিদী জনতা ও আয়োজকদের মধ্যে সংঘর্ষও হয়।
এই দুটো ঘটনাতেই কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছিল স্থানীয় প্রশাসন।
পরবর্তীতে সরকারের উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া ফুটবল ম্যাচগুলো পুনরায় আয়োজন করা হয়েছিল।
পাঁচই অগাস্টের পর থেকে দেখা গেছে তৌহিদী জনতা বা বিক্ষুব্ধ মুসল্লিদের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই এরকম ঘটনা ঘটছে।
তার মাঝে কখনো আছে বিভিন্ন নারীকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান পণ্ড করা, কখনো বা মাজারে ভাঙচুর।
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোয় অনেক সময় মাজার কেন্দ্রিক ব্যবসা, প্রতারণা, মাদক ব্যবহার বা অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যবহারেরও অভিযোগ রয়েছে।
তবে এভাবে হামলা করা গ্রহণযোগ্য নয় বলে ইসলামিক স্কলাররা বলছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এসব ঘটনা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানানো হলেও, কার্যত তার প্রভাব দৃশ্যমান হয়নি।
বরং সদ্য শেষ হওয়া রমজান মাসেও মাজারে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এর বাইরে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের প্রকাশ্য কর্মসূচিকে উগ্রবাদের উত্থানের একটি ইঙ্গিত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে।
সর্বশেষ সাতই মার্চ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাকায় তাদের একটি মিছিল টিয়ারশেল ও সাউন্ডগ্রেনেড ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ।
আদর্শগতভাবে হিযবুত তাহ্রীরের লক্ষ্য বিশ্বজুড়ে ‘ইসলামি খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা করা।
গত কয়েক মাসে বিভিন্ন জায়গায় মাজার ভাঙার ঘটনা ঘটেছে।
সরকার কী বলছে?
নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট প্রকাশের দিনেই প্রতিবেদনটিকে ‘মিসলিডিং’ (বিভ্রান্তিকর) লেবেল দিয়ে তুলে ধরা হয় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে।
বিবৃতিতে প্রতিবেদনটিকে ‘বিভ্রান্তিকর এবং একপেশে’ বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রেস উইংয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ‘বিভ্রান্তিকর ও একপেশে’ বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে, যেন বাংলাদেশ ধর্মীয় চরমপন্থিদের দখলে চলে যাওয়ার কাছাকাছি অবস্থায় রয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিপ্রকৃতিকে অতিসরলীকরণ করা হয়েছে এবং ১৮ কোটি মানুষের এই দেশকে অন্যায়ভাবে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয় সরকারের বিবৃতিতে।
এতে, নারী উন্নয়নে সরকারের গত কয়েক মাসের উদ্যোগ তুলে ধরা হয়। বলা হয়, রাজনৈতিক বা সাধারণ সহিংসতাকে ধর্মীয় বাতাবরণ দেয়ার প্রবণতার কথা।
বুধবার এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দুইজন উপদেষ্টাও কথা বলেন।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দেশে কোনো ধরনের জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেনি এবং এ ধরনের কোনো সম্ভাবনা নেই।
“বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক যা আরও উন্নতির অবকাশ রয়েছে। এটাকে আস্তে আস্তে আরও ভালোর দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।
আর, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, “নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চরমপন্থার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের অবস্থান হচ্ছে, এই সুযোগ কাউকে নিতে দেওয়া হবে না।
“আমরা চেষ্টা করব বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উগ্রপন্থা যেন মাথাচাড়া দিতে না পারে,” বলেন মি. আলম।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দাবি, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দেশে কোনো ধরনের জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেনি।
‘বাস্তব চিত্র কম এসেছে গণমাধ্যমে’
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর তা নিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রতিবেদনের তথ্যগুলোর সাথে একমত পোষণ করে কেউ কেউ মন্তব্য করেন, সরকার উগ্রপন্থা সামাল দিতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি। যার প্রতিফলন ঘটেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে।
অন্যদিকে, প্রতিবেদনের তথ্যগুলোতে সার্বিক চিত্র আসেনি বলে কাউকে কাউকে অভিমত প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বাংলাদেশে তিনটি প্রবণতা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে – মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা, নারীর প্রতি বিদ্বেষ এবং ডানপন্থার উত্থান।
“এই তিনটি প্রবণতা আগেও ছিল। কিন্তু, অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েক মাসে সেগুলো আগের চেয়ে অনেক স্পষ্টভাবে দেখা দিয়েছে,” বলেন অধ্যাপক কার্জন।
ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর আঘাত করার চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “বেশ কয়েকটা উগ্রপন্থি পক্ষ শক্তিশালী হচ্ছে। তারা শুধু আপত্তিকর বক্তব্যই দিচ্ছে না, বরং সরাসরি আক্রমণ করছে।”
কয়েক মাসে অনেকগুলো ঘটনা পাশাপাশি ঘটে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “একটা-দুইটা ঘটনা হলে বলা যেত বিচ্ছিন্ন ঘটনা।”
সরকারের বিরুদ্ধে নমনীয়তার অভিযোগ ‘অমূলক নয়’ বলে মনে করেন অধ্যাপক কার্জন।
“এই সরকারের কাছ থেকে এমন ভূমিকা প্রত্যাশিত নয়,” বলেন তিনি।
এদিকে, দীর্ঘদিন ধরে ‘ফ্যাক্ট চেকিং’ নিয়ে কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “শিরোনাম বা ছবিতে যদি এমন কোনো তথ্য থাকে, যা টেক্সটে নেই বা ভিন্ন কনটেক্সটে যদি উপস্থাপন করা হয় সেটাকে মিসলিডিং বলা হয়।”
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে ‘মিসলিডিং কিছু চোখে পড়েনি’ বলে জানান মি. চৌধুরী।
তার মতে, “সরকারে থাকলে একটা রিপোর্ট পছন্দ নাও হতে পারে। যদি তেমন কোনো গ্রাউন্ড থাকে, তাহলে প্রতিবাদপত্র পাঠানো যেতে পারে। কিন্তু, সংবাদমাধ্যমকে ম্যালাইন করার কোনো এখতিয়ার নেই।”
“এর আগেও প্রেস উইং এর পক্ষ থেকে একই ধরনের কাজ করা হয়েছিল। যার পুনরাবৃত্তি তারা আবার করলো,” যোগ করেন মি. চৌধুরী।
“এতে আন্তর্জাতিকভাবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা যায়,” বলে মনে করে সাংবাদিকতার এই শিক্ষক।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply