সারাক্ষণ রিপোর্ট
গত অর্থবছর (২০২৩-২৪) দেশের চিংড়ি রপ্তানি ছিল পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে চলতি অর্থবছর (২০২৪-২৫) আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়ায় রপ্তানি আবার ঊর্ধ্বমুখী। তবু কাঁচামাল সরবরাহের সঙ্কট দীর্ঘমেয়াদে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বাধা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
রপ্তানিতে ইতিবাচক গতি
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মধ্যে সামুদ্রিক ও মিঠাপানির বিভিন্ন ফ্রোজেন ও লাইভ ফিশ (চিংড়ি সহ) রপ্তানিতে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৪.৪৫% প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ খাতে বৈদেশিক আয় দাঁড়িয়েছে ৩১৬.২ মিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে এককভাবে চিংড়ি রপ্তানি ১৭.০৬% বেড়ে ২১৫.৯ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই চিংড়ি রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ২৩.২৫% ছিল।
কাঁচামালের অভাবে স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয়
শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা এখন বাড়লেও কাঁচা চিংড়ির ঘাটতি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। অনেক প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। এর পেছনে কাঁচামালের অপ্রতুলতা, আর্থিক জটিলতা ও উচ্চ উৎপাদন ব্যয়ের মতো কারণগুলোকে দায়ী করা হচ্ছে।
প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার চিত্র
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) জানিয়েছে, চিংড়ি ও মাছ রপ্তানি খাতের প্রায় ২০০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ২৫% চালু আছে, বাকি ৭৫% কারখানা বন্ধ বা কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে। খুলনা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিস্থিতি প্রায় একই রকম।
খাতসংশ্লিষ্টদের অভিমত
- আছিয়া সি ফুডস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিএফএফইএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি: “বাজারে চাহিদা বাড়লেও কাঁচা চিংড়ির স্বল্পতার কারণে স্থায়ীভাবে এই বাড়তি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কঠিন।”
- বিএফএফইএ’র সহ-সভাপতি ও রূপালী সি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক: আগের সরকারের নীতিগত ত্রুটির কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তবে বর্তমানে কিছুটা গতি ফিরেছে, যার ফলে আগামীর উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা আছে।
বাড়তি চাহিদা, উৎপাদনে বাধা
বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু পর্যাপ্ত কাঁচা চিংড়ি না থাকায় রপ্তানিকারকরা অনেক (অর্ডার) পূরণ করতে পারছেন না। অন্যদিকে, চাষিরা উচ্চ উৎপাদন ব্যয় ও সীমিত আর্থিক সহায়তার কারণে চাষে পিছিয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং স্থানীয়ভাবে ব্যাপক পর্যায়ে চিংড়ি চাষ পুনরায় শুরু না হলে রপ্তানির এই উত্থান দীর্ঘস্থায়ী করা কঠিন হবে।
সরকারি সহায়তার প্রত্যাশা
খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, চিংড়ির বর্তমান ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখতে হলে সঠিক নীতি সহায়তা, অর্থপ্রণোদনা এবং অবকাঠামো উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের চিংড়ির একটি স্থায়ী বাজার রয়েছে, কিন্তু কাঁচামালের সঙ্কট দূর করা না গেলে এই বাজারের পূর্ণ সুযোগ নেওয়া সম্ভব হবে না।
ভেনামি চিংড়ির উজ্জ্বল সম্ভাবনা
বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যার মধ্যেও ভেনামি জাতের চিংড়ির চাষের সম্ভাবনা ব্যাপক। দুই বছর আগে সরকারিভাবে অনুমোদনের পর ভেনামি চাষ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এই চিংড়ি থেকে এক হেক্টর জমিতে ৮,০০০–১০,০০০ কিলোগ্রাম উৎপাদন করা যায়, যেখানে বাগদা চিংড়িতে মাত্র ১,০০০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ফলন হয়।
অর্থায়ন ও ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি
নতুনভাবে তহবিল বিনিয়োগ করা গেলে উৎপাদন বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব হবে বলে অনেকের মত। বিশেষ করে ভেনামি চিংড়ির চাষ সম্প্রসারণ করে রপ্তানি আয়কে আরও উঁচুতে নেওয়া যেতে পারে।
বিএসই তালিকাভুক্ত কোম্পানির পারফরম্যান্স
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মূল বোর্ডে তালিকাভুক্ত বড় দুইটি চিংড়ি রপ্তানি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে অ্যাপেক্স ফুডস ও জেমিনি সি ফুডস।
- অ্যাপেক্স ফুডস: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আয় ২% কমে দাঁড়িয়েছে ১০৯.৪৫ কোটি টাকায়। শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ১.৭৯ টাকা থেকে কমে ১.৪৩ টাকায় নেমে আসে। শুধু অক্টোবর-ডিসেম্বরে আয় ২৪% কমেছে এবং মুনাফা ৬৪% হ্রাস পেয়েছে।
- জেমিনি সি ফুডস: একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে ৩.৯৪ টাকায়, যেখানে আগের বছর ছিল ৪.২৮ টাকা। অক্টোবর-ডিসেম্বরে লোকসান আরও বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আয় ও গ্রস প্রফিট মার্জিন কমে যাওয়াকে লোকসানের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
উপসংহার
চলতি অর্থবছরে চিংড়ি রপ্তানির ঊর্ধ্বমুখী ধারা সামগ্রিক রপ্তানির জন্য স্বস্তি দিলেও কাঁচা চিংড়ির স্বল্পতা ও উৎপাদন-সংক্রান্ত সমস্যার কারণে দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধিতে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। তবে সঠিক নীতি সহায়তা ও সকল পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগ থাকলে এই বাধাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে বিশ্লেষকরা আশা প্রকাশ করেছেন।