বড়ু
সেদিন তাহারা আরও কি কি গান গাহিয়াছিল মনে নাই। বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে কেবলই মনে হইতেছিল, এই অভাগিনী ভানু নামের মেয়েটি যেন বস্তু। অপরিণত বয়সে তাহার বিবাহ হইল। বিবাহের পাশা খেলিতে খেলিতে মেয়েটিকে বাপ ভাই তার বরের সঙ্গে পালকিতে তুলিয়া দিল। পালকির দোলনিতে মেয়েটি জাগিয়া উঠিয়া কাঁদিতে লাগিল। সাধু সওদাগর বর মেয়েটিকে তাহার কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করিল। মেয়েটি বলিল, ‘এত যে দরদের-এত যে আদরের আমার মা ধন কোথায় রহিল-আমার বাপজন কোথায় রহিল?’ ছেলেটি তখন বলিল, ‘তুমি এত উচ্চৈস্বরে কান্না করিতেছ। বাড়িতে লইয়া গিয়া তোমার এই উচ্চ গলা ভাঙিয়া দিব।’ কত শত বৎসরের গ্রাম্য-জীবনের এই খণ্ড-কাহিনীটি ঘিরিয়া সরু সুরের অপূর্ব কারু-নৈপুণ্যের মধ্যে বড়ু যেন ইনাইয়া বিনাইয়া কাঁদিতেছিল।
আজ যেন আমি অমূল্য সম্পদের অধিকারী হইলাম। ঘরে আসিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। বড়ুর গানের সুর-তার দুই হাতের নানা রঙের কাচের চুড়িগুলি, তার শাড়ির পাড়ের নকশা, সব মিলিয়া আমার ঘরে যেন রাশি রাশি মণি-মাণিক্য ছড়াইয়া দিতেছিল।
তখন আমি ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ পুস্তক রচনা করিতেছিলাম। এই রচনার মধ্যে আমি এই মণি-মাণিক্যগুলি কুড়াইয়া আনিয়া সেই বিলম্বিত কাহিনীটিকে নানা নকশায় ভরিয়া তুলিতে লাগিলাম।
এই সুদীর্ঘ বই লিখিতে যখনই শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছি তখনই আমি বড়ুদের বাড়ি যাইতাম, কোনোদিন হয়তো লাল, সাদা, নীল নানারকমের সুতার নাছি নাটায়ের সঙ্গে ফেলিয়া বড়ু দুই পা মেলিয়া বসিয়া চরকা ঘুরাইয়া নলি ভরিত। বাম হাতে নাটায়ের সুতা ধরিয়া ডান হাতে চরকা ঘুরাইত। নাটাই ঘুরিয়া ঘুরিয়া তার হাতের মধ্যে সুতা ছাড়িয়া দিত। চরকার ঘুরনে সেই সুতা যাইয়া নলির গায়ে জড়াইত। কোনো সুতা ছিঁড়িয়া গেলে সে কৃত্রিম কোপ প্রকাশ করিয়া সুতাকে শাসাইত। তারপর চরকা থামাইয়া দুইহাতে সেই সুতাটি জোড়া দিয়া আবার চরকা ঘুরাইত। মাঝে মাঝে গুনগুন করিয়া গান গাহিত। আমার মনে হইত, যে-রূপ তাহার অঙ্গে ধরে না তাহাই যেন সে সুতায় ধরিয়া নলির মধ্যে জড়াইয়া লইতেছে। তাহার স্বামী কাল তাহাই রঙিন শাড়ির নকশায় মেলিয়া ধরিবে। আমি একান্তে বসিয়া এই দৃশ্য উপভোগ করিতাম।
কোনো কোনোদিন সে উঠানের মাঝখানে ছোট ছোট কাঠি গাড়িয়া তাহার উপর তেনা কাড়াইত। বাম হাতে নাটাই লইয়া ডান হাতে আর একটি কাঠির আগায় নাটায়ের সুতা আটকাইয়া সারা উঠান হাঁটিয়া হাঁটিয়া কাঠিগুলির সঙ্গে সুতা জড়াইয়া দিত। কখনও সাদা, কখনও নীল, কখনও হলদে আবার কখনও লাল। লালে-নীলে-সাদায়-হলুদে মিলিয়া সুতাগুলি যেন তারই গায়ের বর্ণের সঙ্গে আড়াআড়ি করিয়া সেই তেনার গায়ে যাইয়া জড়াইয়া পড়িত। তাহাদের বাড়ির উঠানে একটি প্রকাণ্ড কাঁঠালগাছ। চারিধারে বড় বড় আমগাছ আর নানা-রকম আগাছার জঙ্গল। সেই জঙ্গলে কানাকুয়া কুব কুব করিয়া ডাকিত। ‘বউ কথা কও’ পাখি ডাকিত। মাঝে মাঝে ঝাঁকে ঝাঁকে শালিক আসিয়া তাহাদের টিনের ঘরের চালায় বসিত। সমস্ত মিলিয়া যে অপূর্ব পরিবেশ তৈরি হইত, আমি অলক্ষ্যে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিতাম আর মেয়েটির মতোই কল্পনার সূত্র লইয়া মনে মনে জাল বুনিতাম। মেয়েটি আমাকে দেখিতে পাইয়া তার তেনা কাড়ানো রাখিয়া হাসিয়া বলিত, “ভাই। কখন আসিলেন?” তাড়াতাড়ি সে ঘর হইতে একখানা পিঁড়ি আনিয়া আঁচল দিয়া মুছিয়া আমাকে বসিতে দিত। তারপর আবার সে তাহার কাজে মনোনিবেশ করিত। আমি বসিয়া বসিয়া তাহার তেনা কাড়ানো দেখিতাম। সে ঘুরিয়া ঘুরিয়া তেনা কাড়াইতে কাড়াইতে আমার সঙ্গে গল্প করিত।
চলবে…..