বড়ু
আমি তো বউ মানুষ। এই আম কোথায় বসিয়া খাইব। করিলাম কি জঙ্গলের মধ্যে যাইয়া আমগুলি খাইয়া হাত-মুখ গাছের পাতায় মুছিয়া তবে বাড়ি আসিলাম। একবার হাট হইতে আসিয়া তোমার দাদা আমাকে বলে, ‘এদিকে আইস।’ আমি এদিক ওদিক চাহিয়া দেখি শাশুড়ি-ননদিরা কেহ কোথাও নাই। কাছে যাইতেই তোমার দাদা আমার হাতে আট-দশখানা বাতাসা দিল। আমি তো সেই বাতাসা মুখে দিয়াছি, অমনি ছোট ননদি আসিয়া আমাকে একথা-সেকথা জিজ্ঞাসা করে। আমি তো কথা বলতে পারি না। মুখে বাতাসা। সে শাশুড়িকে ডাকিতে গেল, ‘মা দেখ দেখ, ভাবী কথা বলে না কেন?’
আমি তখন তাড়াতাড়ি এক গ্লাস পানি আনিয়া মুখে দিলাম। শাশুড়ি আসিয়া জিজ্ঞাসা করে, ‘বউ কি হইয়াছে?’ আমি বলি, ‘কিছু হয় নাই তো আম্মাজান।'”
দাদির এইসব কথা শুনিতে শুনিতে বস্তু হাসিয়া কুটি কুটি হয়। তার মুখখানি খুশিতে আরও সুন্দর দেখায়।
ছুটি ফুরাইলে কলিকাতা চলিয়া আসি। হোস্টেলের নির্জন কক্ষে বসিয়া বড়ুর কথা মনে হয়। আহা! এমন সুন্দর মেয়েটি। আর এমন তার সুরেলা গলা। ওকে গান শিখাইলে সে কত ভালো গান গাহিতে পারিত। মনে মনে কল্পনা করি। ছোট খড়ের দুইখানা ঘর। নলখাগড়ার বেড়া দেওয়া। চারিদিকে আঁধার করিয়া কলাবন। কলার পাতাগুলি সেই ঘরের চালার উপর নুইয়া পড়িয়াছে। ঘর দু’খানার মাঝখানে ছোট্ট উঠান। সেখানে লাল নটের কেয়ারি, জাঙলা ভরিয়া লাউ কুমড়া দোল খাইতেছে। তারই এক পাশে বস্তু গৃহ-কাজে রত। সামান্য তার অভাব। ঘরে ডোলভরা ধান। মেঝেয় কলসিভরা শীতল পানি। পাথালে দুগ্ধবতী গাভী। বড়ুর জীবনে কি মাটির এই ক্ষুদ্র বেহেস্ত কখনও নামিয়া আসিবে? আহা।
এই মেয়েটিকে যদি গান শিখাইতে পারিতাম; পাড়াগাঁয়ের যেসব গান সে জানে সেই গানগুলির মধ্যে যদি আরও একটু প্রাণ-রস ঢালিয়া দিতে পারিতাম? তারই জানা-অজানা যেসব কেচ্ছা-কাহিনী গ্রামদেশে প্রচলিত, সেগুলির এখানে ঘুরাইয়া সেখানে ফিরাইয়া যদি তার মধ্যে আরও একটু মধু ঢালিয়া তাকে শিখাইতে পারিতাম, সমস্ত পল্লীবাংলার রূপ তার মধ্যে মূর্ত হইয়া উঠিত। সেই গৃহ-পরিবেশের মধ্যে সে ধরিয়া রাখিত বিস্মৃত-প্রায় পল্লীবাংলার শিক্ষা, দীক্ষা, তার আদর্শবাদ-তার শত সহস্র বর্ষের সাধনায় পাওয়া ভাবপ্রবণতা। দেশ-দেশান্তর হইতে লোক আসিয়া সেই ভাবপ্রবণতার উত্তরাধিকারী হইয়া যাইত। ভাবিতে ভাবিতে কোথাকার লজ্জায় যেন রাঙা হইয়া উঠিতাম। আহা। এই মেয়েটি যদি আমার ঘরের ঘরনী হইত। ওইখান দিয়া কাঁখে কলসি লইয়া নদীতে জল আনিতে যাইত। আঁকাবাঁকা গাঁয়ের পথ। দু’ধার হইতে বড় বড় গাছগুলি শাখাবাহু বিস্তার করিয়া দিত। চলিতে চলিতে কণ্টক গাছে তাহার শাড়ির আঁচল জড়াইত। কাঁখের শূন্য কলসি মাটিতে নামাইয়া গাছের শাখা হইতে আঁচল ছাড়াইত-এমন সময় দূর হইতে পাখিটি ডাকিয়া উঠিত-“বউ কথা কও। বউ কথা কও।” আঁচল ছাড়াইয়া হাসিতে হাসিতে সে নদীর ঘাটে যাইত।
জোছনা ধবধব রাত্রি। শিশিরভেজা কলার পাতার উপর চাঁদের আলোর ঝিকিমিকি। বারান্দায় বসিয়া বউটি রংবেরঙের সুতা দিয়া সিকা বুনাইতেছে আর গুনগুন করিয়া গান
গাহিতেছে। আমি এক পাশে দাঁড়াইয়া দেখিতেছি।
চলবে…..
Leave a Reply