বড়ু
আহা। এই স্বপ্ন কি আমার জীবনে সফল হইবে কখনও? একদিন বস্তু বলিয়াছিল, “ভাই ওসব কথা বলিবেন না। ওসব শুনিলে গুনা হয়।” সেই কথার প্রতিধ্বনি আসিয়া আমার মনের সকল কল্পনা ভাঙিয়া দেয়।
বড়ুর কোলে একটি ফুটফুটে ছেলে হইল। কি সুন্দর হাসিখুশি মুখ। বস্তুর কোল হইতে তাকে কোলে লইতে তাহার গায়ের সঙ্গে আমার হাত লাগিয়া যাইত। তার উষ্ণ দেহের তাপ বহুক্ষণ ধরিয়া মনে মনে অনুভব করিতাম। এই ছেলেটিকে বড়ু কতই না ভালোবাসিত। ছেলে তো নয়, যেন তার মনের মতো একটি খেলনা। শিশুর মতো এই খেলনাটিকে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া তার মায়েলি বুকের যত স্নেহ আছে সব যেন কথার ফুলে ভরিয়া চারিদিকে ছড়াইয়া দিত। আমি চাহিয়া চাহিয়া তার ছেলেকে আদর করা দেখিতাম। বস্তু বলিত, “ভাই! ও বড় হইয়া আপনার সঙ্গে লেখাপড়া করিতে যাইবে। এই পথে কলিকাতার গাড়ি আসিবে। আমার যাদু সেই গাড়িতে চড়িয়া যাইবে।” বড়ু এই কথা বলিত আর খল খল করিয়া হাসিত।
এবার বস্তুর চেহারা আরও সুন্দর হইয়াছে। সারা গায়ে যেন তার রূপ ধরে না। এত যে অভাব, এত যে অনটন, বস্তুর মনে আর দেহে তার এতটুকুও দাগ কাটে নাই। দিঘির পদ্মফুলটির গায়ে যেমন কোনো জলের দাগ লাগে না, দু’এক ফোঁটা জল তার এখানে-সেখানে শোভা পায়, তেমনি তার ছিন্ন শাড়িতে অবিন্যস্ত কেশপাশে অভাব যেন মুক্তাবিন্দু হইয়া শোভা পাইতেছে। বড়ুকে কোনোদিন এমন সুন্দর দেখি নাই।
সেবার কলিকাতায় অনেকদিন কাটাইলাম। নির্জন গৃহকোণে বসিয়া বড়ুর চেহারা কল্পনা করিতে চেষ্টা করিতাম। একটি ভালো গান শুনিলে যেমন তার পদগুলি মনে থাকে না, সুরের একটুমাত্র রেশ কন্ঠে আসিয়া মন-প্রাণ আকুলি-বিকুলি করিতে থাকে তেমনি বস্তুর চেহারা ভাবিয়া ভাবিয়া কিছুতেই স্পষ্ট করিয়া ভাবিতে পারিতাম না। আবছা আবছা ভাসাভাসা তার চেহারা মনের পর্দায় আঁকিতে যতই চেষ্টা করিতাম ততই তাহা ভাঙিয়া ভাঙিয়া যাইত। আবার নতুন করিয়া তাহাকে সেই অদৃশ্য পটে আঁকিতে চেষ্টা করিতাম। মনে মনে ভাবিতাম, এবার দেশে যাইয়া বড়ুকে বলিব, “বড়ু! তুমি আমার বোনটি হইয়াই রহিও। এই যে তোমাকে দেখিয়া আমার ভালো লাগে, এটাই কি কম লাভ? জীবনে ভালো লাগিবার লোক কোটিতে গুটিক মেলে। সুন্দর বলিয়াই তুমি আমার এত আপনার নও। ভালো বলিয়াই তোমাকে এত ভালোবাসি। আমি যেন জীবনে এমন কোনো কাজ না করি যাহাতে তোমার এই সুন্দর জীবনে এতটুকুও অকল্যাণ আনিয়া দেয়।”
বস্তুর জন্য এটা-ওটা কিনি। ছোটখাটো জিনিস যা গোপনে তাকে দিয়া আসা যায়। ছেলের দুধ খাইবার চামচ-সিন্দুরের কৌটা, চিরুনি, রঙিন পাথরের মালা-আরও কত কি!
বস্তুদের বাড়ির পুবদিক দিয়া বাড়ি যাইবার রাস্তা। হদা মল্লিকের তালগাছ ছাড়াইতে পিছন ফিরিয়া চাই। ওই ঘন আমবাগানের ছায়ে লেপা-পোঁছা উঠানের ধারে বড়ু হয়তো ঘরের ছোটখাটো কাজকর্ম করিতেছে। ঘুরিয়া ঘুরিয়া লাল, নীল সুতা লইয়া উঠানে তেনা কাড়াইতেছে। মনে বলে, এখনই যাইয়া তাহাকে দেখিয়া আসি। তার জন্য যাহা যাহা আনিয়াছি তাহা পাইয়া সে কত সুখী হয়, দেখিয়া চক্ষু জুড়াইয়া আসি। কিন্তু পা চলে না। ছোট গ্রাম। দেশে আসিয়া এখনই যদি ওদের বাড়ি যাই পাড়ার লোকে একথা সেকথা বলিতে পারে।
চলবে…..
Leave a Reply