০১:০৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

সাইবার হামলার আশঙ্কায় ইউরোপের সতর্কতা ও প্রস্তুতি

  • Sarakhon Report
  • ১২:১৪:৫৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫
  • 31

সারাক্ষণ রিপোর্ট

জার্মানির কৃষিপ্রধান শহর ভারেলের মেয়র গার্ড-ক্রিশ্চিয়ান ওয়াগনার ভয় পাচ্ছেন, তার শহরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা যদি সাইবার হামলার শিকার হয়, তবে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে। পানি সরবরাহ বন্ধ হবে, গরুগুলো মারা যাবে, খামারের শূকর মারা পড়বে, এবং সুপারমার্কেটে লুটপাট শুরু হবে।

এই ভয় একেবারে ভিত্তিহীন নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মার্চের শেষে নাগরিকদের প্রতি একটি সতর্কতা জারি করে বলেছে—তাদের তিন দিনের খাদ্য ও পানি মজুদ রাখতে হবে।

“CRINK” জোট ও চীনের উদ্বেগজনক ভূমিকা

ইউক্রেন যুদ্ধের পর ইউরোপে সাইবার হুমকির আশঙ্কা বেড়েছে। বিশেষত চীন, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে গঠিত “CRINK” জোটকে ইউরোপীয় নেতারা বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখছেন।

সাবেক ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিস্তোর মতে, চীন এখন আর দূরের হুমকি নয়, বরং ইউরোপের অবকাঠামোয় সরাসরি হামলার সক্ষমতা রাখে।

ভারেল শহরের প্রস্তুতি ও সীমাবদ্ধতা

মেয়র ওয়াগনার জানান, তার শহরের বড় খামারগুলোর দুধ দোয়ানোর যন্ত্র এবং অন্যান্য সুবিধা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। বিদ্যুৎ চলে গেলে এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এমনকি পানির পাম্প বন্ধ হয়ে গেলে পানিও মিলবে না।

জার্মানির কঠোর নিরাপত্তা বিধির কারণে ডিজেল মজুদ রাখাও সহজ নয়। তাই মেয়র নাগরিকদের রেইনওয়াটার ট্যাংক ও পাওয়ার ব্যাংক কেনার পরামর্শ দিয়েছেন।

ইউরোপে চীনা প্রযুক্তির গভীর প্রভাব

চীনা প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ের মাধ্যমে চীন এখনও ইউরোপের ৫জি অবকাঠামোর বড় একটি অংশ দখল করে আছে। ডেনিশ প্রতিষ্ঠান স্ট্র্যান্ড কনসাল্টের মতে, জার্মানির ৫৯% এবং চেক প্রজাতন্ত্র ও অস্ট্রিয়ার ৬৭% ৫জি সিস্টেম চীন-নির্ভর।

৫জি শুধু ফোনে কথা বলার জন্য নয়, বরং পানি, বিদ্যুৎ ও পরিবহন ব্যবস্থাও এর উপর নির্ভরশীল। বিশেষজ্ঞ জন স্ট্র্যান্ড বলেন, চীনের সফটওয়্যার আপডেট বন্ধ করেই একটি ‘কিল সুইচ’ তৈরি করা সম্ভব, যা পুরো অবকাঠামো বন্ধ করে দিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হটা ও ইউরোপের দুর্বলতা

মার্চের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে সাইবার প্রতিরোধ কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়ায়, যা ইউরোপীয় নিরাপত্তার জন্য একটি বড় ধাক্কা।

জার্মানির সাবেক সামরিক কর্মকর্তা রোডেরিক কিজেভেটার বলেন, এখন ইউরোপকে নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিজেই গড়ে তুলতে হবে, কারণ চীন চাইলে তাইওয়ান আক্রমণের পর ইউরোপের উপর নিষেধাজ্ঞা না দিতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

ইউরোপীয় কৌশলের ঘাটতি ও সুপারিশ

ইউরোপীয় কমিশনের সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষক ক্রিস্টিনা ভ্যানবার্গেন মনে করেন, বর্তমান কৌশল যথেষ্ট নয়। চীনের ‘কৌশলগত ধোঁয়াশা’ এবং ‘দেশপ্রেমিক হ্যাকারদের’ ব্যবহার বিবেচনায় এনে আরও কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।

তার প্রস্তাবনায় রয়েছে—

  • ৭২ ঘণ্টার মধ্যে চীনের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানির ওপর স্বয়ংক্রিয় নিষেধাজ্ঞা
  • PLA-সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সকল চুক্তি বাতিল
  • চীনা আইপি চুরির ক্ষতিপূরণ আদায়ে মামলা ও ফান্ড গঠন

নাগরিকদের সচেতনতার প্রয়োজন

মেয়র ওয়াগনার শেষ পর্যন্ত একটি বিষয় নিশ্চিত করতে চান—তার শহরের মানুষ যেন ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হয়। তিনি বলেন, “ড্রোনের মাধ্যমে সবকিছুর ছবি নেওয়া হয়, তাই কেউ না কেউ জানে কোথায় তার আছে, কোথায় পাইপ। কিন্তু সাধারণ মানুষ এখনো ঝুঁকির গুরুত্ব বোঝে না।”

এই প্রতিবেদনটি ইউরোপের বর্তমান সাইবার হুমকি ও প্রস্তুতি সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে, যা শুধু প্রযুক্তিগত নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়ার দিক থেকেও গভীরভাবে চিন্তার বিষয়।

সাইবার হামলার আশঙ্কায় ইউরোপের সতর্কতা ও প্রস্তুতি

১২:১৪:৫৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫

সারাক্ষণ রিপোর্ট

জার্মানির কৃষিপ্রধান শহর ভারেলের মেয়র গার্ড-ক্রিশ্চিয়ান ওয়াগনার ভয় পাচ্ছেন, তার শহরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা যদি সাইবার হামলার শিকার হয়, তবে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে। পানি সরবরাহ বন্ধ হবে, গরুগুলো মারা যাবে, খামারের শূকর মারা পড়বে, এবং সুপারমার্কেটে লুটপাট শুরু হবে।

এই ভয় একেবারে ভিত্তিহীন নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মার্চের শেষে নাগরিকদের প্রতি একটি সতর্কতা জারি করে বলেছে—তাদের তিন দিনের খাদ্য ও পানি মজুদ রাখতে হবে।

“CRINK” জোট ও চীনের উদ্বেগজনক ভূমিকা

ইউক্রেন যুদ্ধের পর ইউরোপে সাইবার হুমকির আশঙ্কা বেড়েছে। বিশেষত চীন, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে গঠিত “CRINK” জোটকে ইউরোপীয় নেতারা বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখছেন।

সাবেক ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিস্তোর মতে, চীন এখন আর দূরের হুমকি নয়, বরং ইউরোপের অবকাঠামোয় সরাসরি হামলার সক্ষমতা রাখে।

ভারেল শহরের প্রস্তুতি ও সীমাবদ্ধতা

মেয়র ওয়াগনার জানান, তার শহরের বড় খামারগুলোর দুধ দোয়ানোর যন্ত্র এবং অন্যান্য সুবিধা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। বিদ্যুৎ চলে গেলে এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এমনকি পানির পাম্প বন্ধ হয়ে গেলে পানিও মিলবে না।

জার্মানির কঠোর নিরাপত্তা বিধির কারণে ডিজেল মজুদ রাখাও সহজ নয়। তাই মেয়র নাগরিকদের রেইনওয়াটার ট্যাংক ও পাওয়ার ব্যাংক কেনার পরামর্শ দিয়েছেন।

ইউরোপে চীনা প্রযুক্তির গভীর প্রভাব

চীনা প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ের মাধ্যমে চীন এখনও ইউরোপের ৫জি অবকাঠামোর বড় একটি অংশ দখল করে আছে। ডেনিশ প্রতিষ্ঠান স্ট্র্যান্ড কনসাল্টের মতে, জার্মানির ৫৯% এবং চেক প্রজাতন্ত্র ও অস্ট্রিয়ার ৬৭% ৫জি সিস্টেম চীন-নির্ভর।

৫জি শুধু ফোনে কথা বলার জন্য নয়, বরং পানি, বিদ্যুৎ ও পরিবহন ব্যবস্থাও এর উপর নির্ভরশীল। বিশেষজ্ঞ জন স্ট্র্যান্ড বলেন, চীনের সফটওয়্যার আপডেট বন্ধ করেই একটি ‘কিল সুইচ’ তৈরি করা সম্ভব, যা পুরো অবকাঠামো বন্ধ করে দিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হটা ও ইউরোপের দুর্বলতা

মার্চের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে সাইবার প্রতিরোধ কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়ায়, যা ইউরোপীয় নিরাপত্তার জন্য একটি বড় ধাক্কা।

জার্মানির সাবেক সামরিক কর্মকর্তা রোডেরিক কিজেভেটার বলেন, এখন ইউরোপকে নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিজেই গড়ে তুলতে হবে, কারণ চীন চাইলে তাইওয়ান আক্রমণের পর ইউরোপের উপর নিষেধাজ্ঞা না দিতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

ইউরোপীয় কৌশলের ঘাটতি ও সুপারিশ

ইউরোপীয় কমিশনের সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষক ক্রিস্টিনা ভ্যানবার্গেন মনে করেন, বর্তমান কৌশল যথেষ্ট নয়। চীনের ‘কৌশলগত ধোঁয়াশা’ এবং ‘দেশপ্রেমিক হ্যাকারদের’ ব্যবহার বিবেচনায় এনে আরও কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।

তার প্রস্তাবনায় রয়েছে—

  • ৭২ ঘণ্টার মধ্যে চীনের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানির ওপর স্বয়ংক্রিয় নিষেধাজ্ঞা
  • PLA-সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সকল চুক্তি বাতিল
  • চীনা আইপি চুরির ক্ষতিপূরণ আদায়ে মামলা ও ফান্ড গঠন

নাগরিকদের সচেতনতার প্রয়োজন

মেয়র ওয়াগনার শেষ পর্যন্ত একটি বিষয় নিশ্চিত করতে চান—তার শহরের মানুষ যেন ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হয়। তিনি বলেন, “ড্রোনের মাধ্যমে সবকিছুর ছবি নেওয়া হয়, তাই কেউ না কেউ জানে কোথায় তার আছে, কোথায় পাইপ। কিন্তু সাধারণ মানুষ এখনো ঝুঁকির গুরুত্ব বোঝে না।”

এই প্রতিবেদনটি ইউরোপের বর্তমান সাইবার হুমকি ও প্রস্তুতি সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে, যা শুধু প্রযুক্তিগত নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়ার দিক থেকেও গভীরভাবে চিন্তার বিষয়।