স্বদেশ রায়
ভারতের কাশ্মীরে ভয়াবহ মৌলবাদী সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে নিরীহ ভ্রমণপিপাসু মানুষের ওপর। তার থেকেও ভয়াবহ, এই সন্ত্রাসবাদীরা ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী। কোনো সন্ত্রাসী যখন ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী হয়, সে সময়ে তারা জাতীয়তা, বর্ণ, গোত্র বা অন্য যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসীদের চেয়ে আরও বেশি ভয়াবহ হয়। তারা মনে করে, এখানে তাদের পরকালের লাভ-লোকসান কাজ করে।
ভারতের কাশ্মীরের এই মৌলবাদী সন্ত্রাসী হামলার পরপরই সে দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিদেশ সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরেছেন। দেশের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা সারাক্ষণ যোগাযোগ রক্ষা করছেন সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। এই লেখা যখন লিখছি, তখনও তারা এ ঘটনার পরিপূর্ণ কোনো নিশানা দিতে পারেনি। আর এত দ্রুত সম্ভবও নয়। তবে পাকিস্তানভিত্তিক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ধর্মীয় মৌলবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপ লস্কর-ই-তৈয়বা ঘটনার দায় স্বীকার করেছে। যাহোক, এত বড় সন্ত্রাসী হামলা শুধু যে গোটা বিশ্বের নজর কাড়বে তা নয়, পৃথিবীর সকল বড় দেশগুলো তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য দক্ষিণ এশিয়াকে নিয়ে নতুন করে ভাববে—তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক টেররিজম বিশেষজ্ঞদের টেবিলে।
দক্ষিণ এশিয়ায় এ মুহূর্তে সন্ত্রাসবাদের জন্য আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অর্থনীতি। ভারতে যেদিন সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, তার পরদিন অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক তাদের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক রিপোর্টে বলেছে, এই এলাকায় ২০২৫ সালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে কম হবে আফগানিস্তানে—মাত্র ২.২ শতাংশ, এরপর পাকিস্তান ২.৭ এবং তারপর বাংলাদেশ ৩.৩। এই তালিকায় বাংলাদেশের চলে যাওয়া অনেকটাই দ্রুত ঘটেছে। কারণ এক বছরেরও কম সময় আগে বাংলাদেশ ছিল ৬-এর ওপরের ক্লাবে। যাহোক, অতীতে কী ছিল তা বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বর্তমানকে নিয়েই ভবিষ্যতের বিচার করতে হবে।
যে কোনো ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের অন্যতম বড় উপাদান অন্ধত্ব। এই অন্ধত্বকে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগানো যায়, যখন কোনো দেশ, ভূখণ্ড বা জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে যায়। দরিদ্রকে যে কোনো সময়ে ধর্মীয় মৌলবাদী সন্ত্রাসীতে রূপান্তর করা যায়। আর ওই মৌলবাদী সন্ত্রাসী গোটা পৃথিবীর জন্য হুমকি।
দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তান এ মুহূর্তে সবচেয়ে দরিদ্র; তেমনি তাদের সেই অর্থে কোনো বৈধ সরকার নেই। তাছাড়া যারা সরকারে আছে, তারা আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত। তারা শুধু নিজ দেশে নয়, পশ্চিমা বিশ্ব থেকে শুরু করে তাদের সাহায্যকারী দেশ পাকিস্তানেও বারবার সন্ত্রাসী হামলা ঘটায়। এমনকি চীনের একটি প্রদেশেও তাদের সন্ত্রাস রফতানির সত্যতাও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। এই দেশটিতে এতদিন বিদেশি সাহায্য চলমান ছিল। কিন্তু বর্তমান মার্কিন নীতির ফলে বিদেশি সাহায্য বা দারিদ্র্য পালনের কর্মসূচি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
এরপর আসে পাকিস্তান। পাকিস্তানে “পাকিস্তানি তালেবান” ছাড়া ৪৮টির বেশি সন্ত্রাসী সংগঠন এখনও সক্রিয়। এর একটি হলো লস্কর-ই-তৈয়বা। তাছাড়া, যদিও বলা হয় ইনঅ্যাকটিভ আছে আরও প্রায় একশোর মতো ধর্মীয় সন্ত্রাসী সংগঠন, বাস্তবে তারা কতটা নিষ্ক্রিয়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অন্যদিকে দেশটি শুধু রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল নয়, বর্তমানে সেখানে যে রাজনৈতিক সরকার রয়েছে তা খুবই দুর্বল। তাদের মাথার ওপর রয়েছে মার্কিন কংগ্রেসে উত্থাপিত অর্থনৈতিক বিল, যা যে কোনো মুহূর্তে পাকিস্তানে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও নানা স্যাংশন পাস করতে পারে। তাছাড়া, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ সেখানে কর সংস্কারসহ অনেক প্রশ্ন তুলে তাদের সাহায্যের হাত অনেকটাই সরিয়ে রেখেছে। তাই দেশটি ভবিষ্যতে আরও বেশি দারিদ্র্যের মধ্যে পড়বে—এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও বাড়ছে। দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দুর্বল সরকার—এই তিনটি মূলত ধর্মীয় মৌলবাদী সন্ত্রাসবাদসহ সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশে নেমে যাওয়ার যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, সেখানে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট। বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক সংকট থেকে দ্রুত বের হয়ে আসার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কিন্তু বর্তমানের অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা গত ৮ মাসে সে পথে এগোয়নি। তাই বিষয়টি এখনও সব রাজনৈতিক দলের কাছে অস্পষ্ট। অন্যদিকে সরকার পরিবর্তনের ৮ মাস পর বিশ্বব্যাংকের এই প্রবৃদ্ধির হিসাবের পূর্বাভাস এসেছে। তাছাড়া, এই সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের সময় দেশে অনেক স্বীকৃত ও সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশে রয়েছে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা, যাদের মধ্যে কয়েকটি স্বীকৃত জঙ্গি গোষ্ঠী আছে বলে সকলে জানে। বর্তমান সরকার সেই জঙ্গীদের এক নেতাকে সম্প্রতি গ্রেফতারও করেছে। অন্যদিকে নিউ ইয়র্ক টাইমস ও গার্ডিয়ানের মতো পত্রিকাও রিপোর্ট করেছে, বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুযোগ নিচ্ছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো, এবং তারা আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশের এই অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী অর্থনীতি এক ধরনের খাদের কিনারায় রয়েছে। আইএমএফ ইতোমধ্যে পূর্ব প্রতিশ্রুত ঋণের কিস্তি বাংলাদেশকে দিতে পারেনি—আইএমএফ-এর শর্ত পূরণ না করায়। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক এভাবে দূরে সরে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা কঠিন হয়ে যাবে। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি ইতোমধ্যে বিশ্বের ছোট অর্থনীতিগুলোকে আঘাত করেছে। বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্কসহ এখনই আমেরিকায় পণ্য রপ্তানিতে প্রায় ২৪ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক স্থগিত রাখার ৯০ দিনের সময়সীমা শেষে যদি পূর্বঘোষিত শুল্ক আবার কার্যকর হয়, তাহলে সেটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় আঘাত হবে।
তাই দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলো যখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে, সে সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঠেকাতে হলে সমগ্র বিশ্বকে এই দেশগুলোর স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতি নিয়ে চিন্তা করতে হবে। যেহেতু সন্ত্রাসবাদের অন্যতম একটি উপাদান হলো দারিদ্র্য।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.
Leave a Reply