সৌতিক বিশ্বাস
উদ্ভট অপরাধের পরিধি
ভারতে এমন কিছু আচরণও দণ্ডনীয় যে, সকালে নিয়মিত কুকুর হাঁটাতে না নিলে জরিমানা বা জেলদণ্ড হতে পারে। রাস্তার পাশে কোনো প্রাণীকে বেঁধে রাখা, আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার মতোভাবে ঘুড্ডি উড়িয়ে দেওয়া, স্কুলে হাজিরার নির্দেশ অমান্য করা কিংবা স্তনপান না করতে পারা কোনো মায়ের কাছে দুধের বোতল দেওয়া—এসবও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।
আইনগত সংখ্যার চিত্র
মহাবিদালয়ীয় ৮৮২টি কেন্দ্রীয় আইনের মধ্যে ৩৭০টিতে ক্রিমিনাল ধারা রয়েছে, যার ফলে ৭৩০৫টি কাজ বা অনুপস্থিতিকে অপরাধ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়—এক মাস আগেই চাকরি ছাড়ার নোটিশ না দেওয়া থেকে শুরু করে অবৈধ অস্ত্র ধারণ, খুন ও যৌন সহিংসতা পর্যন্ত নানা অপরাধ এতে রয়েছে। দিল্লির আইনী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিদি সেন্টার ফর লিগ্যাল পলিসি এই পরিস্থিতিকে “ভারতের অতিমাত্রায় অপরাধীকরণ সংকট” বলে অভিহিত করেছে।
দৈনন্দিন কাজেও শাস্তি
প্রাত্যহিক কাজকর্মকেও আইন সহজেই অপরাধে পরিণত করে। অবৈধভাবে ছেঁড়া নল মেরামত করা, কোন ভবনের মালিকের নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি, স্কুলে হাজিরার নির্দেশ উপেক্ষা—এসবের জন্যও শাস্তি আছে। এমনকি ড্রাইভিং লাইসেন্স গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেটির পরেও আবেদন করা অপরাধের তালিকায় স্থান পায়।
জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিস্তৃতি
ঘুড্ডি উড্ডয়নে অন্যকে আতঙ্কিত করার জন্য জরিমানা ধার্য থাকতে পারে। পশু পেতানো ক্ষেত্র বা সড়কে শূকর গেলে ১০ টাকা জরিমানা, চিড়িয়াখানায় আবর্জনা ফেলে দিলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ২ হাজার টাকা জরিমানা, আর কুকুরকে পর্যাপ্ত হাঁটানো থেকে বঞ্চিত করলে ১০০ টাকা জরিমানা ও তিন মাসের জেল হতে পারে।
শিশু খাদ্যবস্তু বা বোতল প্রচার করলে তিন বছরের কারাদণ্ড বা ৫০০০ টাকার জরিমানা হতে পারে। অপরাধের প্রায় ৭৩%–এ জেল জরিমানা রয়েছে, যা একদিন থেকে বিশ বছর পর্যন্ত হতে পারে। মোট অপরাধের প্রায় ৮০%–এ জরিমানা, যার পরিমাণ দুই টাকা থেকে শুরু করে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত।
ব্যবসা ও প্রশাসনে ব্যাঘাত
প্রায় ২৫০টি অপরাধে কাগজপত্র দাখিলে বিলম্বই দণ্ডনীয় অপরাধ, ১১৭টি আইনে এমন বিধান রয়েছে। ৮০টি আইনে ১২৪টি অপরাধে সরকারি কর্মকর্তাকে বাধাগ্রস্ত করাও অপরাধ, যা প্রায়ই অস্পষ্ট সংজ্ঞায় জোড়া হয়। যদিও আইনের অধিকাংশ ধারা সক্রিয়ভাবে প্রয়োগ হয় না, তবু তাতে লুটপাটের সুযোগ তৈরি হয়।
মৃত্যুদণ্ডসহ চরম দণ্ড
শুধু খুন বা বিদ্রোহ নয়, পাইপলাইন ক্ষতিসাধন বা পাহারাদার ঘুমিয়ে পড়ার মতো কার্যকলাপও মৃত্যুদণ্ডের তালিকায় আছে। মোট ৩০১টি অপরাধে আইন থেকে মৃত্যুদণ্ড আরোপের সুযোগ তৈরি হয়।
বিচারব্যবস্থার চাপ
ভারতে ৩৪ মিলিয়নেরও বেশি মামলা মুলতুবি রয়েছে, যার ৭২%–এরও বেশি এক বছরের বেশি সময় ধরে আটকে আছে। কারাগারগুলি ১৩১% ক্ষমতা ব্যবহার করছে, পুলিশে ৫৮১,০০০ শূন্যপদ, প্রতি ১ লক্ষ মানুষের বিপরীতে পুলিশের সংখ্যা মাত্র ১৫৪—যা অনুমোদিত ১৯৫–এর অনেক কম।
সংস্কারের ডাক
প্রতিবেদন অনুযায়ী, অপরাধ আইন শুধুমাত্র মৌলিক সামাজিক মূল্যবোধ—জনসুরক্ষা, জাতীয় নিরাপত্তা, জীবন, স্বাধীনতা, সম্পত্তি ও সামাজিক ঐক্য—রক্ষায় সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। সরকার ২০২৩ সালে ১৮০টি অপরাধমূলক ধারা বাতিল করেছে, আর এখন আরও ১০০টির বেশি ধারা সরানোর পরিকল্পনা করছে। এতে আইন হবে ভয়ের বদলে বিশ্বাসের পায়োনিয়ার, সন্দেহের বদলে নাগরিক মর্যাদার সহায়ক।