ফারহান বোখারি
“কম প্রবৃদ্ধির হার, দীর্ঘদিনের ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি, যা সম্প্রতি কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলেও সাধারণ মানুষের জীবনমানে স্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে—এসবই প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সরকারের প্রতি জনঅসন্তোষ বাড়িয়েছে।”
পাকিস্তানের শাসকদের জন্য এটি বড় ভুল হবে যদি তারা মার্কিন কংগ্রেসের দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয়টিকে উপেক্ষা করে যান। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে মার্কিন কংগ্রেসে দুই দলীয় (ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান) সমর্থনে একটি বিল পেশ করা হয়েছে, যেখানে নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানানো হয়েছে।
মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে উত্থাপিত ‘পাকিস্তান ডেমোক্রেসি অ্যাক্ট’ হয়তো আগামী সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে কোনো বড় পরিবর্তন আনবে না। এর আগেও এমন বেশ কিছু উদ্যোগের প্রভাব সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়ন হয়নি। কিন্তু এই বিলটি বিশ্বব্যাপী এক উদ্বেগজনক অবস্থানকে আরও জোরদার করছে—যেখানে পাকিস্তানের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই আলোচনা আরও প্রকট হয়েছে।
জেলবন্দি ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এখনো স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ একটি তদন্তের দাবিতে সোচ্চার রয়েছে, যাতে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্নের মীমাংসা হয়। যদিও দলটি এখন পর্যন্ত কোনো সুসংগঠিত ও ধারাবাহিক গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, তবে তাদের জনপ্রিয়তা এখনো দেশের অনেক অংশে দৃশ্যমান। একই সঙ্গে, পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশও দেশের দৈনন্দিন জীবনের অবনতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছে।
এই অভিযোগগুলো আরও শক্তিশালী হয়েছে দেশের অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে। কম প্রবৃদ্ধির হার, দীর্ঘদিনের ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি, যা সম্প্রতি কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলেও সাধারণ মানুষের জীবনমানে স্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে—এসবই প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সরকারের প্রতি জনঅসন্তোষ বাড়িয়েছে।
এদিকে সামনে আরও চ্যালেঞ্জ আসছে—যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় বিশ্ব বাণিজ্যে চাপ প্রয়োগের হুমকি দিয়েছেন, বিশেষত চীনা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। যদিও পাকিস্তান সরাসরি লক্ষ্যবস্তু না হলেও বৈশ্বিক মন্দার প্রতিক্রিয়ায় দেশটি বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে।
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করছে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উপর। তাদের বড় মাপের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ধারাবাহিকতা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
জাতীয় ঐক্যের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার জন্য রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা অপরিহার্য। পাকিস্তানের চারটি বড় প্রদেশ—পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়া—ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রায় একে অপরের থেকে আলাদা। তাই একে একটি সমন্বিত জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে ঐক্যের আবহ দরকার।
দেশটির ভবিষ্যৎ সবচেয়ে বেশি নির্ভর করছে বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়ার চরমপন্থা দমন করার সক্ষমতার উপর। এই দুই প্রদেশ আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী এবং পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বারবার দাবি করেছেন, আফগানিস্তান থেকে আসা সন্ত্রাসীরাই এসব হামলার জন্য দায়ী।
চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষতির শিকার হয়েছে। এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে, তা বলা কঠিন। তবে কেবল সামরিকভাবে নয়, সমগ্র জাতিকে একত্রিত করে একটি সমন্বিত অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করা দরকার। তার আগে রাজনৈতিক বিভক্তির অবসান ঘটিয়ে নতুন এক জাতীয় ঐকমত্য গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে।
পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে যে ঘাটতি রয়েছে, তা এখনই সমাধান করতে হবে, নয়তো দেশটি আরও সমালোচনার মুখে পড়বে। মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে পাকিস্তানের গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু এই মর্যাদাই এখন দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা নিয়ে বিশ্বজুড়ে বাড়তি প্রশ্ন তুলছে। এই ঝুঁকি থেকে নিজেদের বাঁচাতে হলে, দেশটিকে স্বল্পমেয়াদী দ্বন্দ্ব ভুলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় মনোযোগ দিতে হবে।
যদিও ‘পাকিস্তান ডেমোক্রেসি অ্যাক্ট’-এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, তবে ইসলামাবাদকে এখনই কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দ্বিধা দূর করতে হবে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের একটি সুবিন্যস্ত পর্যালোচনা হওয়া উচিত, যাতে শাসনব্যবস্থা নিয়ে বারবার ওঠা প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়া যায়। একই সঙ্গে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনার জবাব দিতে হবে দৃঢ়তার সঙ্গে।
সবশেষে, এই বিষয়গুলো কেবল যুক্তরাষ্ট্রের একটি আইনপ্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় নয়, বরং পাকিস্তানকে নিজের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই সমাধান করতে হবে।
লেখক-পরিচিতি: ইসলামাবাদ-ভিত্তিক বিদেশি সংবাদদাতা; পাকিস্তান ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে লেখেন।