০১:০৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
মহানন্দা নদী: দুই শতাব্দী ধরে উত্তরবঙ্গের আত্মা যুক্তরাষ্ট্র–জাপান বাণিজ্য চুক্তি: পারস্পরিক শুল্ক ১৫%, ৫৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি হিউএনচাঙ (পর্ব-১৫৪) হুথি পেট্রোলিয়াম ও আর্থিক নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞা “হলি আর্টিজান” আইএস জঙ্গী হামলা : এক ক্ষত, যা আজও রক্তাক্ত বন্ধুত্বের গল্প হোক রঙ বাংলাদেশ’র রঙিন আয়োজনে নীরবে চলে যাচ্ছে তাজউদ্দিন আহমদের জন্ম শতবার্ষিকী বাংলা চলচ্চিত্রের প্রিয় মুখ কবিতা লালন ও রুমি: দুটি আত্মার আলোর তুলনা এবং বাংলাদেশের মৌলবাদী হুমকি ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথ হিসেবে প্রতিশোধকে বেছে নেওয়া হয়েছে — হোসেন জিল্লুর রহমান

বালখিল্যগণের উৎপত্তি

  • Sarakhon Report
  • ০৭:০০:৩৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫
  • 119

রাজশেখর বসু

পুরাণে আছে, বালখিল্য মুনিরা বুড়ো আঙুলের মতন লম্বা এবং সংখ্যায় ষাট হাজার। তাঁদের পিতার নাম কুতু, মাতার নাম ক্রিয়া। এই বৃত্তান্ত অসম্পূর্ণ এতে কিছু ভুলও আছে। বালখিল্যগণের প্রকৃত ইতিহাস নিম্নে বিবৃত করছি।

পুরাকালে নৈমিষারণ্যে বহু, ঋষির আশ্রম ছিল। ব্রহ্মার অন্যতম মানসপুত্র মহর্ষি কুতু তার ভার্যা ক্রিয়ার সঙ্গে সেখানেই বাস করতেন। ক্রতু হলেন সপ্তর্ষি-গণের ফণ্ঠ ঋষি। একদিন বিকাল বেলা কুটীরের দাওয়ায় বসে তিনি তাঁর পত্নীকে ব্যাকরণ শেখাচ্ছিলেন। রুতু বলছিলেন, প্রিয়ে, এই স্ত্রীপ্রত্যয়প্রকরণ বড়ই কঠিন, তুমি উত্তমরূপে কণ্ঠস্থ কর। মৎস্য শব্দের য-ফলা আছে, কিন্তু স্ত্রীলিঙ্গে মৎসী, য-ফলা হয় না। অনুরূপ মনুষ্য মনুষী। ইন্দ্রের স্ত্রী ইন্দ্রাণী, চন্দ্রের স্ত্রী চন্দ্রা। অশ্বের স্ত্রী অম্বা, অথচ গর্দভের স্ত্রী গর্দভী।

সহসা একটা গম্ভীর চাপা আওয়াজ শোনা গেল। মহর্ষি রুতু সবিস্ময়ে কান পেতে শুনলেন যেন কেউ কলসীর ভিতর থেকে কথা বলছে-আপনি সব ভুল শেখাচ্ছেন।

রুদ্ধ হয়ে রুতু বললেন, কে রে তুই, এতদূর আস্পর্ধা যে আমার ভুল ধরিস!

আবার আওয়াজ হল-ওসব সেকেলে ব্যাকরণ চলবে না। স্ত্রীলিঙ্গঙ্গ একই পদ্ধতিতে করতে হলে-মৎস্যী মনুষ্যী ইন্দ্রী চন্দ্রী অশ্বী গর্দভী, কিংবা মৎস্যণী মনুযাণী ইন্দ্রিণী চন্দ্রিণী অশ্বিণী গর্দভিনী।

কুতু বললেন, কোথায় আছিস তুই, সম্মুখে আয়, লগুড়াঘাতে তোকে ব্যাকরণ শিক্ষা দেব।

ঋষিপত্নী ক্রিয়া বললেন, স্বামী, অদৃশ্য মূর্খের বাক্যে কর্ণপাত করো না। ব্যাকরণের পাঠ আজ স্থগিত থাকুক, সেদিন তুমি যে প্রত্যক্ষ দেবতাদের কথা বলছিলে তাই পুনর্বার শুনতে ইচ্ছা করি।

রুতু বললেন, প্রিয়ে, প্রণিধান কর। আকাশে তিন প্রত্যক্ষ দেবতা আছেন-সূর্য চন্দ্র ও মেঘরূপ পর্জন্য। ভূতলেও তিন প্রত্যক্ষ দেবতা আছেন-গর্ভধারিণী মাতা, জন্মদাতা পিতা, এবং বিদ্যাদাতা গুরু। এরাই সর্বাগ্রে উপাস্য। অগ্নি বায়ু বরুণ প্রভৃতির স্থান এ’দের নিম্নে।

পুনর্বার আওয়াজ হল-সব ভুল। আকাশে বা ভূতলে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ কোনও দেবতা নেই, চন্দ্র সূর্য পর্জন্য পিতা মাতা গুরু, কেউ উপাস্য নয়।

অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে রুতু বললেন, ওরে পাষণ্ড পিশাচ, সাহস থাকে তো দৃষ্টি-গোচর হয়ে তর্ক’ কর, নতুবা ব্রহ্মশাপে তোকে ধ্বংস করব।

ঋষিপত্নী ক্রিয়া কাতর হয়ে করজোড়ে বললেন, স্বামী, ও পিশাচ নয়, আমার গর্ভস্থ পুতই কথা বলছে। অবোধ শিশুকে তুমি ক্ষমা কর।

-গর্ভস্থ পুত্র না জ্যেষ্ঠতাত!

বেরিয়ে আয় হতভাগা অকালকুষ্মাণ্ড!

ক্রিয়া তাঁর পুত্রের উন্দেশ্যে বললেন, বৎস, ক্ষান্ত হও, পুজাপাদ পিতার বাক্যের প্রতিবাদ ক’রো না। আগে ভূমিষ্ঠ হও, তোমার দন্তোদগম হক, অন্নপ্রাশন চড়া-করণ উপনয়ন প্রভৃতি সংস্কার চুকে যাক, তার পর যদি কিছু, জ্ঞাতব্য থাকে তবে পিতাকে সবিনয়ে শ্রম্পাসহকারে জিজ্ঞাসা ক’রো। এখন মৌনাবলম্বন কর, গর্ভস্থ অপোগণ্ডের পক্ষে বাচালতা অতান্ত অনিষ্টকর।

মহর্ষি রুতুর অজাত অপত্য নীরব হল। অধ্যাপনার ব্যাঘাত হওয়ায় রুতু উঠে পড়ে সন্ধ্যাবন্দনা করতে গেলেন।

নৈমিষারণ্যের একদিকে গোমতী নদী। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষে যতী তিথিতে সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে গর্ভিণী নারীরা সমাগত হন এবং সুপুত্র-কামনায় পুণ্যতোয়া গোমতীতে স্নান করে ফণমাতৃকা অর্থাৎ ষষ্ঠিদেবীর আরাধনা করেন। এবারে এই শুভর্তিাখতে পুষ্যা নক্ষত্র ও বৃদ্ধিযোগ পড়েছে, সেজন্য অসংখা নারী গোমতীতীরে সমবেত হয়েছেন। রুতুর পত্নী ক্রিয়া তাঁদের নেত্রীস্থানীয়া, তিনি সকলকে রতপালনের পদ্ধতি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।

সহসা তাঁর গর্ভস্থ পুত্রের গরুগম্ভীর স্বর শোনা গেল-ভো অজাত অপো-গণবাণ, শুয়তাম্।

তন্ডুলভাণ্ডবাসী মুষিকশাবকের ন্যায় কিচকিচকণ্ঠে সহস্র ভ্রুণ উত্তর দিলে-

হাঁ হাঁ আমরা শুনছি।

-বিশ্বের অপোগণ্ড এক হও।

-এক হব।

-সকলে আরার উত্তোলন কর-প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ কোনও দেবতা মানব না।

-মানব না।

-পিতা মাতা গুরু, কারও শাসন মানব না।

-মানব না।

-গুরুকে আর ডরাব না, গুরুর গরু চরাব না। গুরুকুলে নাহি রব, না পড়ে পণ্ডিত হব।

-না পড়ে পণ্ডিত হব।

-তবে কাকে মানবে, কার আজ্ঞায় চলবে?

-তাই তো, কাকে মানব?

-আদিবিদ্রোহী মহান, ত্রিশঙ্কুকে, যিনি ঊর্ধ্বপাদ অধঃশিরা হয়ে রাশিচক্রের বহির্দেশে বিদ্যমান রয়েছেন।

-মহান বিশঙ্কু বিদাতাম্, অন্য গুরু ম্রিয়তাম।

-ত্রিশঙ্কুর জন্য যিনি আকাশে নূতন স্বর্গলোক সৃষ্টি করেছেন সেই বশিষ্ঠ-

শত্রু বিশ্বামিত্রকেও ধন্যবাদ দাও।

-বিশ্বামিত্র ধন্যবাদ, বশিষ্ঠাদি নিন্দাবাদ!

-ভ্রাতৃগণ, এই বারে গর্ভকারা থেকে বেরিয়ে এস, স্বাধীন হও, বসুন্ধরা ভোগ কর।

-কিন্তু এখন যে পাঁচ মাসও পূর্ণ হয় নি!

-তর্ক’ কারো না, ত্রিশঙ্কুর আজ্ঞা, ভূমিষ্ঠ হও।

-আমাদের পালন করবে কে, খেতে দেবে কে?

-তর্ক’ ক’রো না, তোমাদের স্নেহা মুখ পিতামাতাই পালন করবে। নিষ্ক্রান্ত হও।

ষাট হাজার গর্ভিণী আর্তনাদ করে উঠলেন, ষাট হাজার ভ্রূণ গভচ্যুত হল। বহ, প্রসূতি প্রাণত্যাগ করলেন।

আর্তনাদ শুনে নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিফাণ সত্বর গোমতীতীরে উপস্থিত হলেন। তাঁরা দেখলেন, সদ্যোজাত মুনিসন্তানগণ গর্ভনাড়ী ছিন্ন করে ক্লেদাক্ত নগ্ন দেহে চিৎকার ও আস্ফালন করছে। সেই অকালপ্রসূত অকালপক দন্তহীন জটাম্মশ্র ধারী বালখিল্যগণের নেতা কুতুপুত্র ক্লাতব। সে দুই হাত নেড়ে বলছে, ভাইসব, এগিয়ে চল, আমরা এখানকার সমস্ত আশ্রম পুড়িয়ে ফেলব, তার পর বশিষ্ঠের আশ্রমে গিয়ে তার কামধেনু, হরণ করে দুধ খাব। বিশ্বামিত্র যা পারেন নি আমরা তা পারব। -দুধ খাব, দুধ খাব! মহান ত্রিশঙ্কু বিদ্যতাম, বশিষ্ঠ ঋষি ম্রিয়তাম। বাল-খিল্য বর্ধন্তাম, আর সবাই ক্ষীয়ন্তাম্!

বালখিল্যগণ উপদ্রব করতে উদ্যত হয়েছে দেখে ঋষিরা ভীত হয়ে বললেন, মহর্ষি রুতু, তোমার ওই অকালজাত পুত্র ক্লাতবই এই সর্বনাশের মূল, তুমিই এর প্রতিকার কর।

কুতু একটু চিন্তা করে বললেন, এরা ব্রাহ্মণসন্তান, অপজাত হলেও অধযা ও অবধ্য, নতুবা মুখে লবণ দিয়ে এদের ব্যাপাদিত করা যেত। এরা দেখছি ত্রিশঙ্কুর ভক্ত, সুতরাং রিশঙ্কুর যাজক বিশ্বামিত্র হয়তো এদের বশে আনতে পারবেন। চল, বিশ্বা-মিত্রের শরণাপন্ন হওয়া যাক।

নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিগণের প্রার্থনা শুনে বিশ্বামিত্র বললেন, এই বালখিলাগণের উপর অপদেবতার ভর হয়েছে, এরা সদুপদেশ শুনবে না, কৌশলে এদের বশে আনতে হবে। চল, চেষ্টা করে দেখা যাক।

বিশ্বামিত্রকে পুরোবতী’ করে ঋফিগণ নৈমিষারণ্যে ফিরে এলেন। বালখিল্যচম্ তখন বাহবন্ধ হয়ে আক্রমণের উপক্রম করছে।

বিশ্বামিত্র বললেন, ভো বালখিল্যগণ, আমাকে চিনতে পেরেছ? আমি হচ্ছি আদিবিদ্রোহী ত্রিশঙ্কুর যাজক বিশ্বামিত্র।

বালখিলাগণ চিৎকার করে বললে, মহামহিম বিশ্বামিত্রের জয়োহস্তু, অন্য ঋষি-দের ক্ষয়োহস্তু!

বিশ্বামিত্র বললেন, কল্যাণমতু। বৎসগণ, তোমরা আমার অতি স্নেহের পাত্র। তোমাদের ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে, কিছু খাবে?

-খাব, খাব।

-মুগমাংস? পুরোডাশ? পিষ্টক? সুপক্ক হরীতকী? ইক্ষুদণ্ড?

-ওসব চিবুতে পারব না, দাঁত নেই যে। আপনার সন্ধানে দুধ আছে?

-আছে। কিন্তু মাতৃদুগ্ধ বা গবাদির দুগ্ধ তো তোমরা জীর্ণ করতে পারবে না। এস আমার সঙ্গে, আমি লঘু পথ্যের ব্যবস্থা করব।

বালখিল্যদের নিয়ে বিশ্বামিত্র অলম্ব তীর্থে উপস্থিত হলেন। সেখানে একটি বিশাল বটবৃক্ষের শাখাপ্রশাখায় লক্ষ লক্ষ বাদুড় ত্রিশঙ্কুর মতন ঊর্ধ্বপাদ অধঃশিরা হয়ে ঝুলছে। স্ত্রী-বাদুড়দের সম্বোধন করে বিশ্বামিত্র বললেন, অয়ি চর্মপর্ণা দন্ত-বর্তী পয়স্বিনী বিহলঙ্গীর দল, এই সদ্যঃপ্রসূত বুভুক্ষু, মুনিশাবকগণকে তোমরা স্তন্যদান কর।

বাদুড়-বনিতারা করুণাবিষ্ট হয়ে বললে, আহা, এস এস বাছারা।

বিশ্বামিত্র বালখিল্যদের একে একে তুলে বটবৃক্ষের শাখায় লম্বিত করে দিলেন। তারা বাদুড়ীদের বক্ষোলগ্ন হয়ে পরমানন্দে স্তন্যপানে রত হল।

রুতু প্রশ্ন করলেন, এরা কত কাল এইপ্রকার শান্ত হয়ে থাকবে?

বিশ্বামিত্র বললেন, এখন তো থাকুক, এর পর আবার যদি উপদ্রব করে তখন দেখা যাবে।

১০৬০ (১৯৫০)

মহানন্দা নদী: দুই শতাব্দী ধরে উত্তরবঙ্গের আত্মা

বালখিল্যগণের উৎপত্তি

০৭:০০:৩৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

রাজশেখর বসু

পুরাণে আছে, বালখিল্য মুনিরা বুড়ো আঙুলের মতন লম্বা এবং সংখ্যায় ষাট হাজার। তাঁদের পিতার নাম কুতু, মাতার নাম ক্রিয়া। এই বৃত্তান্ত অসম্পূর্ণ এতে কিছু ভুলও আছে। বালখিল্যগণের প্রকৃত ইতিহাস নিম্নে বিবৃত করছি।

পুরাকালে নৈমিষারণ্যে বহু, ঋষির আশ্রম ছিল। ব্রহ্মার অন্যতম মানসপুত্র মহর্ষি কুতু তার ভার্যা ক্রিয়ার সঙ্গে সেখানেই বাস করতেন। ক্রতু হলেন সপ্তর্ষি-গণের ফণ্ঠ ঋষি। একদিন বিকাল বেলা কুটীরের দাওয়ায় বসে তিনি তাঁর পত্নীকে ব্যাকরণ শেখাচ্ছিলেন। রুতু বলছিলেন, প্রিয়ে, এই স্ত্রীপ্রত্যয়প্রকরণ বড়ই কঠিন, তুমি উত্তমরূপে কণ্ঠস্থ কর। মৎস্য শব্দের য-ফলা আছে, কিন্তু স্ত্রীলিঙ্গে মৎসী, য-ফলা হয় না। অনুরূপ মনুষ্য মনুষী। ইন্দ্রের স্ত্রী ইন্দ্রাণী, চন্দ্রের স্ত্রী চন্দ্রা। অশ্বের স্ত্রী অম্বা, অথচ গর্দভের স্ত্রী গর্দভী।

সহসা একটা গম্ভীর চাপা আওয়াজ শোনা গেল। মহর্ষি রুতু সবিস্ময়ে কান পেতে শুনলেন যেন কেউ কলসীর ভিতর থেকে কথা বলছে-আপনি সব ভুল শেখাচ্ছেন।

রুদ্ধ হয়ে রুতু বললেন, কে রে তুই, এতদূর আস্পর্ধা যে আমার ভুল ধরিস!

আবার আওয়াজ হল-ওসব সেকেলে ব্যাকরণ চলবে না। স্ত্রীলিঙ্গঙ্গ একই পদ্ধতিতে করতে হলে-মৎস্যী মনুষ্যী ইন্দ্রী চন্দ্রী অশ্বী গর্দভী, কিংবা মৎস্যণী মনুযাণী ইন্দ্রিণী চন্দ্রিণী অশ্বিণী গর্দভিনী।

কুতু বললেন, কোথায় আছিস তুই, সম্মুখে আয়, লগুড়াঘাতে তোকে ব্যাকরণ শিক্ষা দেব।

ঋষিপত্নী ক্রিয়া বললেন, স্বামী, অদৃশ্য মূর্খের বাক্যে কর্ণপাত করো না। ব্যাকরণের পাঠ আজ স্থগিত থাকুক, সেদিন তুমি যে প্রত্যক্ষ দেবতাদের কথা বলছিলে তাই পুনর্বার শুনতে ইচ্ছা করি।

রুতু বললেন, প্রিয়ে, প্রণিধান কর। আকাশে তিন প্রত্যক্ষ দেবতা আছেন-সূর্য চন্দ্র ও মেঘরূপ পর্জন্য। ভূতলেও তিন প্রত্যক্ষ দেবতা আছেন-গর্ভধারিণী মাতা, জন্মদাতা পিতা, এবং বিদ্যাদাতা গুরু। এরাই সর্বাগ্রে উপাস্য। অগ্নি বায়ু বরুণ প্রভৃতির স্থান এ’দের নিম্নে।

পুনর্বার আওয়াজ হল-সব ভুল। আকাশে বা ভূতলে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ কোনও দেবতা নেই, চন্দ্র সূর্য পর্জন্য পিতা মাতা গুরু, কেউ উপাস্য নয়।

অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে রুতু বললেন, ওরে পাষণ্ড পিশাচ, সাহস থাকে তো দৃষ্টি-গোচর হয়ে তর্ক’ কর, নতুবা ব্রহ্মশাপে তোকে ধ্বংস করব।

ঋষিপত্নী ক্রিয়া কাতর হয়ে করজোড়ে বললেন, স্বামী, ও পিশাচ নয়, আমার গর্ভস্থ পুতই কথা বলছে। অবোধ শিশুকে তুমি ক্ষমা কর।

-গর্ভস্থ পুত্র না জ্যেষ্ঠতাত!

বেরিয়ে আয় হতভাগা অকালকুষ্মাণ্ড!

ক্রিয়া তাঁর পুত্রের উন্দেশ্যে বললেন, বৎস, ক্ষান্ত হও, পুজাপাদ পিতার বাক্যের প্রতিবাদ ক’রো না। আগে ভূমিষ্ঠ হও, তোমার দন্তোদগম হক, অন্নপ্রাশন চড়া-করণ উপনয়ন প্রভৃতি সংস্কার চুকে যাক, তার পর যদি কিছু, জ্ঞাতব্য থাকে তবে পিতাকে সবিনয়ে শ্রম্পাসহকারে জিজ্ঞাসা ক’রো। এখন মৌনাবলম্বন কর, গর্ভস্থ অপোগণ্ডের পক্ষে বাচালতা অতান্ত অনিষ্টকর।

মহর্ষি রুতুর অজাত অপত্য নীরব হল। অধ্যাপনার ব্যাঘাত হওয়ায় রুতু উঠে পড়ে সন্ধ্যাবন্দনা করতে গেলেন।

নৈমিষারণ্যের একদিকে গোমতী নদী। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষে যতী তিথিতে সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে গর্ভিণী নারীরা সমাগত হন এবং সুপুত্র-কামনায় পুণ্যতোয়া গোমতীতে স্নান করে ফণমাতৃকা অর্থাৎ ষষ্ঠিদেবীর আরাধনা করেন। এবারে এই শুভর্তিাখতে পুষ্যা নক্ষত্র ও বৃদ্ধিযোগ পড়েছে, সেজন্য অসংখা নারী গোমতীতীরে সমবেত হয়েছেন। রুতুর পত্নী ক্রিয়া তাঁদের নেত্রীস্থানীয়া, তিনি সকলকে রতপালনের পদ্ধতি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।

সহসা তাঁর গর্ভস্থ পুত্রের গরুগম্ভীর স্বর শোনা গেল-ভো অজাত অপো-গণবাণ, শুয়তাম্।

তন্ডুলভাণ্ডবাসী মুষিকশাবকের ন্যায় কিচকিচকণ্ঠে সহস্র ভ্রুণ উত্তর দিলে-

হাঁ হাঁ আমরা শুনছি।

-বিশ্বের অপোগণ্ড এক হও।

-এক হব।

-সকলে আরার উত্তোলন কর-প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ কোনও দেবতা মানব না।

-মানব না।

-পিতা মাতা গুরু, কারও শাসন মানব না।

-মানব না।

-গুরুকে আর ডরাব না, গুরুর গরু চরাব না। গুরুকুলে নাহি রব, না পড়ে পণ্ডিত হব।

-না পড়ে পণ্ডিত হব।

-তবে কাকে মানবে, কার আজ্ঞায় চলবে?

-তাই তো, কাকে মানব?

-আদিবিদ্রোহী মহান, ত্রিশঙ্কুকে, যিনি ঊর্ধ্বপাদ অধঃশিরা হয়ে রাশিচক্রের বহির্দেশে বিদ্যমান রয়েছেন।

-মহান বিশঙ্কু বিদাতাম্, অন্য গুরু ম্রিয়তাম।

-ত্রিশঙ্কুর জন্য যিনি আকাশে নূতন স্বর্গলোক সৃষ্টি করেছেন সেই বশিষ্ঠ-

শত্রু বিশ্বামিত্রকেও ধন্যবাদ দাও।

-বিশ্বামিত্র ধন্যবাদ, বশিষ্ঠাদি নিন্দাবাদ!

-ভ্রাতৃগণ, এই বারে গর্ভকারা থেকে বেরিয়ে এস, স্বাধীন হও, বসুন্ধরা ভোগ কর।

-কিন্তু এখন যে পাঁচ মাসও পূর্ণ হয় নি!

-তর্ক’ কারো না, ত্রিশঙ্কুর আজ্ঞা, ভূমিষ্ঠ হও।

-আমাদের পালন করবে কে, খেতে দেবে কে?

-তর্ক’ ক’রো না, তোমাদের স্নেহা মুখ পিতামাতাই পালন করবে। নিষ্ক্রান্ত হও।

ষাট হাজার গর্ভিণী আর্তনাদ করে উঠলেন, ষাট হাজার ভ্রূণ গভচ্যুত হল। বহ, প্রসূতি প্রাণত্যাগ করলেন।

আর্তনাদ শুনে নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিফাণ সত্বর গোমতীতীরে উপস্থিত হলেন। তাঁরা দেখলেন, সদ্যোজাত মুনিসন্তানগণ গর্ভনাড়ী ছিন্ন করে ক্লেদাক্ত নগ্ন দেহে চিৎকার ও আস্ফালন করছে। সেই অকালপ্রসূত অকালপক দন্তহীন জটাম্মশ্র ধারী বালখিল্যগণের নেতা কুতুপুত্র ক্লাতব। সে দুই হাত নেড়ে বলছে, ভাইসব, এগিয়ে চল, আমরা এখানকার সমস্ত আশ্রম পুড়িয়ে ফেলব, তার পর বশিষ্ঠের আশ্রমে গিয়ে তার কামধেনু, হরণ করে দুধ খাব। বিশ্বামিত্র যা পারেন নি আমরা তা পারব। -দুধ খাব, দুধ খাব! মহান ত্রিশঙ্কু বিদ্যতাম, বশিষ্ঠ ঋষি ম্রিয়তাম। বাল-খিল্য বর্ধন্তাম, আর সবাই ক্ষীয়ন্তাম্!

বালখিল্যগণ উপদ্রব করতে উদ্যত হয়েছে দেখে ঋষিরা ভীত হয়ে বললেন, মহর্ষি রুতু, তোমার ওই অকালজাত পুত্র ক্লাতবই এই সর্বনাশের মূল, তুমিই এর প্রতিকার কর।

কুতু একটু চিন্তা করে বললেন, এরা ব্রাহ্মণসন্তান, অপজাত হলেও অধযা ও অবধ্য, নতুবা মুখে লবণ দিয়ে এদের ব্যাপাদিত করা যেত। এরা দেখছি ত্রিশঙ্কুর ভক্ত, সুতরাং রিশঙ্কুর যাজক বিশ্বামিত্র হয়তো এদের বশে আনতে পারবেন। চল, বিশ্বা-মিত্রের শরণাপন্ন হওয়া যাক।

নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিগণের প্রার্থনা শুনে বিশ্বামিত্র বললেন, এই বালখিলাগণের উপর অপদেবতার ভর হয়েছে, এরা সদুপদেশ শুনবে না, কৌশলে এদের বশে আনতে হবে। চল, চেষ্টা করে দেখা যাক।

বিশ্বামিত্রকে পুরোবতী’ করে ঋফিগণ নৈমিষারণ্যে ফিরে এলেন। বালখিল্যচম্ তখন বাহবন্ধ হয়ে আক্রমণের উপক্রম করছে।

বিশ্বামিত্র বললেন, ভো বালখিল্যগণ, আমাকে চিনতে পেরেছ? আমি হচ্ছি আদিবিদ্রোহী ত্রিশঙ্কুর যাজক বিশ্বামিত্র।

বালখিলাগণ চিৎকার করে বললে, মহামহিম বিশ্বামিত্রের জয়োহস্তু, অন্য ঋষি-দের ক্ষয়োহস্তু!

বিশ্বামিত্র বললেন, কল্যাণমতু। বৎসগণ, তোমরা আমার অতি স্নেহের পাত্র। তোমাদের ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে, কিছু খাবে?

-খাব, খাব।

-মুগমাংস? পুরোডাশ? পিষ্টক? সুপক্ক হরীতকী? ইক্ষুদণ্ড?

-ওসব চিবুতে পারব না, দাঁত নেই যে। আপনার সন্ধানে দুধ আছে?

-আছে। কিন্তু মাতৃদুগ্ধ বা গবাদির দুগ্ধ তো তোমরা জীর্ণ করতে পারবে না। এস আমার সঙ্গে, আমি লঘু পথ্যের ব্যবস্থা করব।

বালখিল্যদের নিয়ে বিশ্বামিত্র অলম্ব তীর্থে উপস্থিত হলেন। সেখানে একটি বিশাল বটবৃক্ষের শাখাপ্রশাখায় লক্ষ লক্ষ বাদুড় ত্রিশঙ্কুর মতন ঊর্ধ্বপাদ অধঃশিরা হয়ে ঝুলছে। স্ত্রী-বাদুড়দের সম্বোধন করে বিশ্বামিত্র বললেন, অয়ি চর্মপর্ণা দন্ত-বর্তী পয়স্বিনী বিহলঙ্গীর দল, এই সদ্যঃপ্রসূত বুভুক্ষু, মুনিশাবকগণকে তোমরা স্তন্যদান কর।

বাদুড়-বনিতারা করুণাবিষ্ট হয়ে বললে, আহা, এস এস বাছারা।

বিশ্বামিত্র বালখিল্যদের একে একে তুলে বটবৃক্ষের শাখায় লম্বিত করে দিলেন। তারা বাদুড়ীদের বক্ষোলগ্ন হয়ে পরমানন্দে স্তন্যপানে রত হল।

রুতু প্রশ্ন করলেন, এরা কত কাল এইপ্রকার শান্ত হয়ে থাকবে?

বিশ্বামিত্র বললেন, এখন তো থাকুক, এর পর আবার যদি উপদ্রব করে তখন দেখা যাবে।

১০৬০ (১৯৫০)