সারাক্ষণ রিপোর্ট
২০২৪–২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল প্রাক্কলিত মাত্র ৪.২ শতাংশ, যা করোনা মহামারির পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে নিম্ন। এর মূল কারণ: রপ্তানি সংকোচন, বিনিয়োগের মন্থরতা, জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং ঋণের ব্যয়বৃদ্ধি। বিপরীতে প্রবাসী আয় ও রপ্তানির আয়ের ধারাবাহিকতা বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি কমিয়ে ঋণাত্মক ০.৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সরকারি বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে মোট জাতীয় আয়-এর ৩.৯ শতাংশে; তবে সরকারি রাজস্ব আদায় এখনও সীমিত, যা জাতীয় আয়-এর মাত্র ৮.৩ শতাংশ।
বাস্তব খাতের প্রবৃদ্ধি
- সামগ্রিক দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ৪.২ শতাংশ থেকে ২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্রায় ৩.৩ শতাংশে নেমে আসার পূর্বাভাস।
- শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ছিল ৩.৫ শতাংশ, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে মাত্র ১.৯ শতাংশ; তৈরি পোশাক ছাড়া অন্যান্য শিল্পে সংকোচন দেখা যাচ্ছে।
- কৃষি ও সেবা খাতে মৃদু স্থিতিশীলতা থাকলেও স্বাভাবিক গতিবেগ নেই।
মূল্যস্ফীতি ও নীতি সুদের হার
- ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৬ শতাংশ; ফেব্রুয়ারিতে এটি নেমে এসেছে ৯.৩ শতাংশে। খাদ্য ও জ্বালানি খাতের দাম বৃদ্ধি প্রধান চালক।
- বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর সংকোচন নীতি অব্যাহত রেখে নীতি সুদের হার দশ শতাংশে বজায় রেখেছে।
দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থান
- ২০২৪ সালে জাতীয় দারিদ্র্য হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০.৫ শতাংশ (আগের বছর ছিল ১৯.২ শতাংশ); শ্রমবাজারে নিরাপত্তাহীনতা ও কর্মসংস্থানের স্বল্পতা পরিস্থিতি খারাপ করেছে।
- অত্যন্ত দরিদ্রতার হার (ক্রয়ক্ষমতা সমতা অনুযায়ী দৈনিক আয় দুই দশমিক পনেরো মার্কিন ডলারের নিচে) দাঁড়িয়েছে ৭.৭ শতাংশ; ২০২৫ সালে জাতীয় দারিদ্র্য ২২.৯ শতাংশ এবং অত্যন্ত দরিদ্রতা ৯.৩ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশা।
ঋণ প্রবণতা ও ব্যাংকিং সংকট
- ব্যক্তিগত খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ডিসেম্বরে ছিল মাত্র ৭.৩ শতাংশ, যা গত ৩০ বছরে সর্বনিম্ন।
- সরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে ১৬.৬ শতাংশ, কারণ বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়েছে।
- খেলাপি ঋণের হার ডিসেম্বরে ছিল ২০.২ শতাংশ; নতুন ৯০ দিনের নিয়ম অনুযায়ী পরিমাপ করলে এটি ৩০ শতাংশ ছাড়াতে পারে।
- ব্যাংকগুলোর গড় মূলধন ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ অনুপাত মাত্র ৬.৯ শতাংশ, নিয়মিত নির্ধারিত ১০ শতাংশের অনেক নিচে।
- বাংকগুলো তারল্যসংকটে, আমানত কমে যাচ্ছে ও গ্রাহক অবিশ্বাস বেড়েছে; কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনঃক্রয়–বিক্রয় চুক্তির সুবিধা দিয়ে সহায়তা করছে।
- সংস্কার পদক্ষেপ: ১১টি দুর্বল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, ৬টি ব্যাংকে সম্পদ মান পর্যালোচনা, ১৮টিতে পুনর্গঠন পরিকল্পনা চালু, দেউলিয়া ব্যাঙ্ক পুনর্গঠন ও সম্পদ পুনরুদ্ধার কার্যদল গঠন।
বৈদেশিক বাণিজ্য ও মুদ্রার অবস্থা
- চলতি হিসাব ঘাটতি ২০২৪–২৫ এ ছিল মাত্র ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে পূর্বের বছর ছিল ৬.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
- প্রবাসী আয় বেড়েছে ২৩.৬ শতাংশ (জুলাই’২৪–জানুয়ারি’২৫), রপ্তানি আয়ের বৃদ্ধি ১০ শতাংশ, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে।
- আমদানি বেড়েছে ৪.৩ শতাংশ, স্থানীয় খাদ্য ও মধ্যপন্থী পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে।
- এক মার্কিন ডলারে বিনিময় হার স্থিতিশীল, ১২২ টাকা; মুদ্রা বাজারে খন্ডমূল্যের গড় পার্থক্য প্রায় ২.৬ শতাংশ।
- বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা তিন মাসের আমদানি ব্যয় বহন করতে সক্ষম।
সরকারি ব্যয় ও ঋণ স্থায়িত্ব
- রাজস্ব আদায় গত ছয় মাসে ৪.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩৬.৬ শতাংশ পূরণ হয়েছে।
- চলতি ব্যয় ২৪.১ শতাংশ হ্রাস, প্রকল্প অনুমোদনে কঠোরতার কারণে।
- মোট ব্যয়ের বৃদ্ধি মূলত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ, সুদ বাবদ টাকা প্রদান এবং সস্ত্রীকৃত মূলধন খাতে হয়েছে।
- সরকারি ঋণ জাতীয় আয়-এর ৩৬.৬ শতাংশ; এর মধ্যে বহিঃঋণ ১৩.৯ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ ঋণ ২২.৭ শতাংশ; বহুপাক্ষিক ঋণের অংশ ৫৬ শতাংশ, দ্বিপাক্ষিক ঋণের অংশ ৩৬.৫ শতাংশ।
ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা ও ঝুঁকি
- ২০২৫–২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৪.৯ শতাংশ; রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৪.২ শতাংশ হলেও বিশ্ব বাণিজ্য অনিশ্চয়তা ও উচ্চ সুদের চাপ প্রধান চ্যালেঞ্জ।
- মূল্যস্ফীতি পরবর্তী বছরেও উচ্চ থাকবে, তবে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আসবে।
- চলতি হিসাব ঘাটতি জাতীয় আয়-এর ০.৫ শতাংশের নিচে রাখতে প্রবাসী আয় ও রপ্তানির ধারাবাহিকতা অপরিহার্য।
- বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যয় কমানো এবং রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো জরুরি।
সংস্কার অগ্রাধিকার
১. মুদ্রানীতির স্বতন্ত্রতা ও সংকোচন নীতি স্থায়ী করা
২. কর প্রশাসন শক্তিশালী করা—একক মূল্য সংযোজন কর ও স্বচ্ছ নীতি প্রয়োগ
৩. ব্যাংকিং খাতে সুশাসন, অকার্যকর ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং সমস্যা ব্যাংক সমাধান প্রক্রিয়া কার্যকর করা
৪. দেউলিয়া আইনের সংস্কার ও সম্পদ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা
৫. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ স্বাধীনতা ও তদারকি ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দৃঢ় মুদ্রানীতি, আর্থিক সংস্কার এবং রাজস্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে মধ্যমেয়াদে স্থিতিশীল ও টেকসই উন্নয়ন অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।