মো. আবু সাঈদ
ওষুধ কোম্পানি এসিআই লিমিটেডের দাম ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১৫০ থেকে ২১০ টাকায় উঠেছিল। গত বৃহস্পতিবার, সবশেষ কার্যদিবসে, সেটি নেমে ১৮০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। কোনো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী যদি ২০০ টাকা করে ২০০০ শেয়ার কিনে থাকে, এ সপ্তাহে ওই একটি শেয়ারেই তার লস ৪০ হাজার টাকা। আবার গত অক্টোবরে বেক্সিমকো ফার্মার দাম ৬৫ টাকায় নেমেছিল; এ মাসের শুরুতে তা ১০৯ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। গত বৃহস্পতিবার সেটাও নেমে ৯০ টাকায় এসেছে।
সর্বোচ্চ দামে যে কিনেছিল, তার এখন লস প্রতি শেয়ারে ১৯ টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শেয়ারবাজারে কারসাজির বড় অভিযোগ ছিল “দরবেশ” খ্যাত সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে। পতনের পর প্রথম ধাপেই কঠিন অবস্থায় পড়েছিলেন তিনি। এমনকি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইত ইসলামও এখন জেলের ঘানি টানছেন। শেয়ারবাজারের কারসাজি বা গ্যাম্বলিং করত যারা— তারা কি এখনো আগের মতো সক্রিয়? তাহলে আবার কেন রাজপথে বিক্ষোভ করতে হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের?
অনেক দিন পর আবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক নেমে গেছে ৫ হাজারের নিচে। সাবেক ব্যাংকার রাশেদ মাকসুদ, যখন এসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন, তখন ডিএসইর ডিএসইএক্স ছিল ৫ ৭৭৫.৪৯ পয়েন্টে। বিদায়ী সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস ২৪ এপ্রিল তা নেমে এসেছে ৪ ৯৭২ পয়েন্টে। হিসাব বলছে, গত আট মাসে সূচক কমেছে ৮০২ পয়েন্ট; অর্থাৎ মাসে গড়ে ১০০ পয়েন্ট করে ঢাকার পুঁজিবাজারে পতন হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আর রাস্তায় নামা ছাড়া কি উপায় আছে? কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হতে পারে: লাভের সময় তো কেউ কমিশনকে সাধুবাদ জানায় না; দাম কমলে লসে পড়লে কেন রাস্তায় নামে শেয়ার কারবারিরা? বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম মিডিয়াকে বলেন, “বর্তমান কমিশন চায়— বাজার নিজের নিয়মে চলুক। সূচক কমুক বা বাড়ুক, এতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হস্তক্ষেপ করবে না।” তিনি আরও বলেন, বিএসইসি বাজারের উন্নয়নে টাস্কফোর্স গঠন করেছে; তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়ার পর কমিশন দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। মতিঝিলের রাস্তায় মিছিল করা বিনিয়োগকারীরা অবশ্য বলেন, গত দুই মাসের টানা দরপতনে বিনিয়োগকৃত অর্থের ৮০-৯০ শতাংশ কমে গেছে। তারা পুঁজিবাজার এবং বিনিয়োগকারীদের রক্ষায় প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ চান।
অনেকে মন্তব্য করেছেন, নতুন কমিশন যেসব সংস্কার করছে, তাতে গত কয়েক মাসে পুঁজিবাজার থেকে ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকার মূলধন উধাও হয়ে গেছে। বিক্ষোভকারীরা অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগ-করা চেয়ারম্যানের অপসারণ ৩০ এপ্রিলে মধ্যে দাবি করেছেন।
দেশের একটি শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউজের স্বত্বাধিকারী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগামী জুন মাস পর্যন্ত পরিস্থিতি দেখব; তারপর হয়তো বাধ্য হয়ে ব্রোকার হাউজের ব্রাঞ্চ অফিস বন্ধ করতে হবে।’ এই হাউজে দুই হাজারের বেশি বিও অ্যাকাউন্ট থাকলেও, গড়ে ১০০ অ্যাকাউন্টেও লেনদেন হয় না। সক্রিয় অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। শিরোনাম: “টানা ঢালাও দরপতনে নাকাল শেয়ারবাজার”, “কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না শেয়ারবাজারের দরপতন”, “পুঁজিবাজারে টানা পাঁচ কার্যদিবস সূচকের পতন”।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিএসইসি শুধু পুনর্গঠনই করেনি, সাবেক চেয়ারম্যানকে গ্রেফতারও করেছে। গঠন হয়েছে টাস্কফোর্স। আগের আমলে কারসাজিতে জড়িত কয়েকজন পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। একাধিক পরিচালক জামিনও পেয়েছেন। আবার সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের বিক্ষুদ্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নতুন চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের অবরুদ্ধ করেছিলেন; সেনাবাহিনী গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। এসবেরও নেতিবাচক প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়েছে। বিগত সরকারের সময় শেয়ারবাজারে আস্থাহীনতা দেখা দিলেও সরকার পতনের পরপরই ঢাকার পুঁজিবাজারে আশা ফিরে এসেছিল, সূচকও উঠেছিল। বেড়েছিল লেনদেন। প্রায় হাজার কোটি টাকার লেনদেন আট মাসের মাথায় নেমে ৩০০ কোটির ঘরে। ফলে এক রকম আতঙ্কে রয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। গত দুই মাসে দেখা যাচ্ছে— ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দাম না বাড়লেও দুর্বল ভিত্তির বা কম পুঁজির শেয়ারের দাম বেড়েছে। আবার যথেষ্ট লভ্যাংশ ঘোষণা সত্ত্বেও মৌলভিত্তির অনেক শেয়ারের দাম বাড়েনি। এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে ব্যাংক খাত। অনেক ব্যাংকের শেয়ারের দামই ফেসভ্যালু (১০ টাকা)-এর ৫/৭/৯ টাকার নিচে।
যে বাজারে পুঁজির নিরাপত্তা নেই বললেই চলে, যেখানে বিনিয়োগকারীদের আস্থা একেবারে তলানিতে— প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা যেখানে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন— সেখানে মূলধন হারানো স্বাভাবিক। বিএসইসির নতুন নেতৃত্ব আসার পর ছয় মাসে এমন কোনো তাৎক্ষণিক উদ্যোগ দেখা যায়নি, যাতে বিনিয়োগকারীরা আশাবাদী হতে পারেন। টাকার শোক বড় শোক; তাই রাস্তায় নেমে আসেন বিনিয়োগকারীরা। প্রশ্ন উঠছে, একটি অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও কি শেয়ারবাজারের ‘খেলোয়াড়রা’ সক্রিয়?
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী নাকি ক্যাপিটাল মার্কেটের দিকে নজর দেবেন? বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়ে ঘোলা চোখে তাকিয়ে থাকবে আর কত দিন?
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
Leave a Reply