সব আসামিকে চেনেন না বাদী
মিরপুর থানায় আলোচিত যে হত্যা মামলা হয়েছে তাতে শেখ হাসিনাসহ ৪০৭ জনকে আসামি করা হয়েছে৷ ওই মামলায় অভিনেতা ইরেশ যাকের ও সাংবাদিকদেরও আসামি করা হয়েছে৷ ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মিছিলে মিরপুরে গুলি ও গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ছাত্রদলের কর্মী মাহফুজ আলম শ্রাবণকে হত্যার অভিযোগে ওই মামলা করেন তার ভাই বিএনপি কর্মী মোস্তাফিজ বাপ্পি৷
ইরেশ যাকেরকে আসামি করায় এরইমধ্যে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে৷ আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ইরেশ যাকেরকে আসামি করার সমালোচনা করেছেন৷ আদালতে ২০ এপ্রিল মামলাটি দায়ের করার পর আদালতের নির্দেশে মিরপুর থানা ২৭ এপ্রিল এজাহার হিসাবে নেয়৷
ওই মামলার বাদী মোস্তফা বাপ্পি নিজেকে বিএনপির কর্মী পরিচয় দিয়ে ডিডাব্লিউকে জানান, ঘটনার দিন তিনি নিজে ঢাকায় ছিলেন না৷ সবার কাছ থেকে শুনে মামলাটি করেছেন৷ আসামিদের নাম ঠিকানা ঠিকমতো সংগ্রহ করতে সময় লাগায় মামলা করতে দেরি হয়েছে৷
‘‘আসামিদের সবাইকে আমি চিনি না৷ আমি ঢাকায়ও ছিলাম না৷ আর গণমামলার তো একটা পদ্ধতি আছে, আমি সেভাবেই করেছি৷ আরো তো মামলা হয়েছে৷ সেভাবেই আমি করেছি৷ সবার কাছে শুনে মামলা করেছি৷ এখন তদন্তে দেখা যাবে কারা কারা জড়িত ছিলো,” বলেন তিনি৷
ইরেশ যাকের প্রসঙ্গে বাদী মোস্তফা বাপ্পি বলেন, ‘‘তিনি তো আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে ব্যবসা করতেন৷ তাদের তো অ্যাডফার্ম আছে এশিয়াটিক৷ নূর তো আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী ছিলেন৷ ফলে ইরেশ যাকেরও তো সুবিধাভোগী৷”
বাদী মোস্তফা বাপ্পি বাড়ি নওগাঁয়৷ তিনি ঘটনার সময় নওগাঁ ছিলেন৷ এখনো সেখানেই আছেন৷ মামলা করার সময় এসেছিলেন৷ আর এলাকায় তিনি ছোটখাটো ব্যবসা করেন বলে জানান৷
পুলিশের কাছ থেকে সাক্ষী হওয়ার তথ্য পান জয়নাল
ওই মামলায় মোট আটজন সাক্ষীর নাম দেয়া হয়েছে৷ তাদের মধ্যে মিরপুরের জয়নাল আবেদীন জানান, ‘‘আমাকে যে ওই মামলার সাক্ষী করা হয়েছে তা মামলা হওয়ার পর পুলিশ আমাকে ফোন করে জানায়৷ ঘটনা ঘটেছে মিরপুর থানার সামনে৷ আর আমার একটা চায়ের দোকান আছে মিরপুর ২ নাম্বারে৷ তবে শ্রাবণ আমার দোকানের পাশেই একটি বাসায় ভাড়া থাকত৷ আমার দোকানে চা খেতে আসত৷ সে মারা যাওয়ার পর আমি শুনেছি৷ আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না৷ কিছু জানিও না৷ কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাও আমার জানা নাই৷”
আরেক সাক্ষী সাইফুল ইসলাম জানান, ‘‘শ্রাবণ পড়াশোনার পাশাপাশি রেনেটায় চাকরি করত৷ আমার বাসার পাশেই থাকত৷ তাকে আমি চিনি৷ ওই দিন আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম৷ পুলিশের গুলিতে মোট পাঁচজন মারা যায়৷ কিন্তু পুলিশ ছাড়া আর কেউ হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে আমার জানা নাই৷”
মিরপুর থানা পুলিশ জানায়, তারা আদালতের নির্দেশে মামলা নিয়েছে৷ এখন আইন মেনে তদন্ত হচ্ছে৷ জড়িত নয়, এমন কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না৷ তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে৷
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য বলছে, জুলাই-আগস্ট ছাত্র জনতার আন্দোলনে হত্যা ও হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন ঘটনায় এখন পর্যন্ত এক হাজার ৪৯৯টি মামলা হয়েছে৷ এর মধ্যে হত্যা মামলা ৫৯৯টি৷ অন্যান্য ৯০০টি৷ এসব মামলায় ১০ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ হত্যা মামলার মধ্যে অনেকগুলোর তদন্তে অগ্রগতি আছে বলেও পুলিশ সদর দপ্তর জানায়৷
‘এজাহারের কমন ফরম্যাট দাঁড় করানো হয়েছে’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ‘‘আমার পর্যবেক্ষণ বলছে প্রধানত চাঁদাবাজির জন্য এই গণমামলা দায়ের হচ্ছে৷ মামলার এজাহারের একটি কমন ফরম্যাট দাঁড় করানো হয়েছে৷ সেখানে শেখ হাসিনাসহ পতিত সরকারের মন্ত্রী এমপিদের নাম থাকে৷ কিছু সাংবাদিক বা পরিচিত ব্যক্তিদের নাম থাকে, তারপর চাঁদা আদায়ের জন্য অন্যদের নাম যুক্ত করা হয়৷ পূর্ব শত্রুতা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণেও ওই মামলাগুলোর আসামির তালিকায় নাম ঢুকানো হয়৷”
‘‘প্রথমে মামলার একটি ড্রাফট করে টার্গেট ব্যক্তিদের নাম দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে নাম বাদ দিয়ে মামলা করা হয়৷ মামলা করার পর দ্বিতীয় ধাপে তদন্ত পর্যায়ে যারা টাকা দেয় তাদের নাম বাদীর মাধ্যমে ভুল হয়েছে বলে বাদ দেয়া হয়৷ এরপর বিচারে গেলে আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দিয়ে বাঁচিয়ে দেয়ার কথা বলে টাকা আদায় করা হবে,” বলেন তিনি৷
ব্যারিস্টার ফারুক জানান, ‘‘এখন মামলা করার জন্য একটি চক্র তৈরি হয়েছে৷ তারাই বিভিন্ন ঘটনা ও বাদী যারা হবেন তাদের খুঁজে বের করেন৷ এরপর ওই চক্রই মামলার সব কিছু ঠিক করে৷ বাদীকে তারা অর্থের লোভ দেখিয়ে এটা করায়৷”
তার কথা, ‘‘সরকার যদি এটা এখনই বন্ধ না করে তাহলে প্রকৃত মামলাগুলোও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে৷ আর এরইমধ্যে অনেক সাধারণ মানুষ হয়রানি হচ্ছেন৷ আর একটি চক্র এইসব মামলাকে কাজে লাগিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে৷”
‘এবার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে’
পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘‘মিথ্যা বা ভুয়া মামলা আগেও হয়েছে৷ কিন্তু এবার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে৷ সরকারের উপদেষ্টারা বলছেন৷ কিন্তু কাজ তো হচ্ছে না৷ কারণ তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই৷ গণ ভুয়া মামলা চলছেই৷ নিরীহ মানুষকে আসামি করা হচ্ছে৷ এই ধরনের মামলা করতে যেন ব্যাপক উৎসাহ তৈরি হয়েছে৷”
তিনি বলেন, ‘‘কোনো নাগরিক মামলা করতে গেলে থানা মামলা নেবে৷ কিন্তু থানা যদি একটু প্রাথমিক তদন্ত করে মামলা নেয় তাহলে এই গণআসামি করা বন্ধ হবে৷ এখানে একটি চক্র আছে৷ যারা এটাকে ব্যবসা হিসাবে নিয়েছে৷ এখানে নানা ধরনের লোক যুক্ত হয়েছে৷ সরকার যেন ছেড়ে দিয়েছে৷”
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট বিগত সরকারের পতনের পর গণঅভ্যুত্থানে হতাহত ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির লক্ষ্যে দায়ের করা বেশকিছু মামলায় সমন্বয়হীনতা বা অসামঞ্জস্যতার অভিযোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ এসব মামলায় আসামি গ্রেপ্তারের নামে হয়রানির অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ৷ নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করায় ইতোমধ্যে দায়ের করা মামলাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে৷”
আসক বলছে, ‘‘ছাত্র-জনতা হত্যার ঘটনায় মামলা করার অধিকার সাধারণ মানুষের আছে৷ তবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব মামলায় কাউকে ফাঁসানো বা হয়রানির উদ্দেশ্যে আসামি করা হলে, তা মানবাধিকারের পরিপন্থি৷”
‘‘বিগত সরকারের সময় বিভিন্ন সময়ে ‘গায়েবি’ মামলার ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল৷ বর্তমান সরকারের সময়েও ‘গায়েবি মামলা’ ফিরে এসেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে৷ কেননা, ঘটনাস্থলে কখনোই উপস্থিত ছিলেন না এমন ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে৷ আশ্চর্যজনকভাবে বেশ কিছু মামলার এজাহার ও আসামি একই,” বলে আসক এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে৷
পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘‘৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের ব্যাপারে দায়ের করা মামলাগুলো আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি৷ সদরদপ্তরের সিনিয়র অফিসাররা মামলাগুলোর ব্যাপারে নজর রাখছেন৷ আর পুলিশ সদরদপ্তর নির্দেশ দিয়েছে, মামলা হলেই যেন কাউকে গ্রেপ্তার করা না হয়৷ তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে৷”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘মামলা করার অধিকার নাগরিকদের আছে৷ আবার কোনো নাগরিক যেন হয়রানির শিকার না হন তাও দেখা আমাদের দায়িত্ব৷”