০৭:২৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫
সাকিব ও মাশরাফি ছাড়া পারফরম্যান্স, শ্রীলঙ্কা টেস্ট সিরিজের পর পথ কি? রাষ্ট্রে কখন ও কেন সংখ্যালঘুরা সংগঠিত ধর্ষণের শিকার হয় আরব আমিরাত, মরুভূমি শহরে ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা মুরাদনগরে সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণ: ‘এরপর সরকার ক্ষমতায় থাকার যোগ্য নয়’—জাপা চেয়ারম্যান ইরান ও পাকিস্তান থেকে আফগানদের গণনির্বাসনে উদ্বেগ স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্যে নতুন নিষেধাজ্ঞা ভারতের, প্রভাব কেমন হবে ইরানে চীনা বিনিয়োগ অনিশ্চিত, তবু মধ্যপ্রাচ্যের আহ্বান অটুট একজন চীনা আন্টি, ৫টি অ্যাপ, ৬০টি প্রথম ডেট জুলাই যাদুঘরে কি “ মুরাদনগরের দ্রৌপদী” স্থান পাবে? প্রতিদিন একটি রুমাল (পর্ব-২১)

গণমামলা আর গণআসামির নেপথ্যে চাঁদাবাজি?

  • Sarakhon Report
  • ০২:৫৪:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫
  • 50

বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট ছাত্র জনতার আন্দোলনে হত্যা ও হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন ঘটনায় এখন পর্যন্ত এক হাজার ৪৯৯টি মামলা হয়েছে বলে পুলিশ সদরদপ্তর জানিয়েছে৷ এসব মামলায় গণআসামি করার নেপথ্যে চাঁদাবাজি বলে অভিযোগ উঠেছে৷

সব আসামিকে চেনেন না বাদী

মিরপুর থানায় আলোচিত যে হত্যা মামলা হয়েছে তাতে শেখ হাসিনাসহ ৪০৭ জনকে আসামি করা হয়েছে৷ ওই মামলায় অভিনেতা ইরেশ যাকের ও সাংবাদিকদেরও আসামি করা হয়েছে৷ ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মিছিলে মিরপুরে গুলি ও গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ছাত্রদলের কর্মী মাহফুজ আলম শ্রাবণকে হত্যার অভিযোগে ওই মামলা করেন তার ভাই বিএনপি কর্মী মোস্তাফিজ বাপ্পি৷

ইরেশ যাকেরকে আসামি করায় এরইমধ্যে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে৷ আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ইরেশ যাকেরকে আসামি করার সমালোচনা করেছেন৷ আদালতে ২০ এপ্রিল মামলাটি দায়ের করার পর আদালতের নির্দেশে মিরপুর থানা ২৭ এপ্রিল এজাহার হিসাবে নেয়৷

ওই মামলার বাদী মোস্তফা বাপ্পি নিজেকে বিএনপির কর্মী পরিচয় দিয়ে ডিডাব্লিউকে জানান, ঘটনার দিন তিনি নিজে ঢাকায় ছিলেন না৷ সবার কাছ থেকে শুনে মামলাটি করেছেন৷ আসামিদের নাম ঠিকানা ঠিকমতো সংগ্রহ করতে সময় লাগায় মামলা করতে দেরি হয়েছে৷

‘‘আসামিদের সবাইকে আমি চিনি না৷ আমি ঢাকায়ও ছিলাম না৷ আর গণমামলার তো একটা পদ্ধতি আছে, আমি সেভাবেই করেছি৷ আরো তো মামলা হয়েছে৷ সেভাবেই আমি করেছি৷ সবার কাছে শুনে মামলা করেছি৷ এখন তদন্তে দেখা যাবে কারা কারা জড়িত ছিলো,” বলেন তিনি৷

ইরেশ যাকের প্রসঙ্গে বাদী মোস্তফা বাপ্পি বলেন, ‘‘তিনি তো আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে ব্যবসা করতেন৷ তাদের তো অ্যাডফার্ম আছে এশিয়াটিক৷ নূর তো আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী ছিলেন৷ ফলে ইরেশ যাকেরও তো সুবিধাভোগী৷”

বাদী মোস্তফা বাপ্পি বাড়ি নওগাঁয়৷ তিনি ঘটনার সময় নওগাঁ ছিলেন৷ এখনো সেখানেই আছেন৷ মামলা করার সময় এসেছিলেন৷ আর এলাকায় তিনি ছোটখাটো ব্যবসা করেন বলে জানান৷

পুলিশের কাছ থেকে সাক্ষী হওয়ার তথ্য পান জয়নাল

ওই মামলায় মোট আটজন সাক্ষীর নাম দেয়া হয়েছে৷ তাদের মধ্যে মিরপুরের জয়নাল আবেদীন জানান, ‘‘আমাকে যে ওই মামলার সাক্ষী করা হয়েছে তা মামলা হওয়ার পর পুলিশ আমাকে ফোন করে জানায়৷ ঘটনা ঘটেছে মিরপুর থানার সামনে৷ আর আমার একটা চায়ের দোকান আছে মিরপুর ২ নাম্বারে৷ তবে শ্রাবণ আমার দোকানের পাশেই একটি বাসায় ভাড়া থাকত৷ আমার দোকানে চা খেতে আসত৷ সে মারা যাওয়ার পর আমি শুনেছি৷ আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না৷ কিছু জানিও না৷ কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাও আমার জানা নাই৷”

আরেক সাক্ষী সাইফুল ইসলাম জানান, ‘‘শ্রাবণ পড়াশোনার পাশাপাশি রেনেটায় চাকরি করত৷ আমার বাসার পাশেই থাকত৷ তাকে আমি চিনি৷ ওই দিন আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম৷ পুলিশের গুলিতে মোট পাঁচজন মারা যায়৷ কিন্তু পুলিশ ছাড়া আর কেউ হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে আমার জানা নাই৷”

মিরপুর থানা পুলিশ জানায়, তারা আদালতের নির্দেশে মামলা নিয়েছে৷ এখন আইন মেনে তদন্ত হচ্ছে৷ জড়িত নয়, এমন কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না৷ তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে৷

পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য বলছে, জুলাই-আগস্ট ছাত্র জনতার আন্দোলনে হত্যা ও হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন ঘটনায় এখন পর্যন্ত এক হাজার ৪৯৯টি মামলা হয়েছে৷ এর মধ্যে হত্যা মামলা ৫৯৯টি৷ অন্যান্য ৯০০টি৷ এসব মামলায় ১০ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ হত্যা মামলার মধ্যে অনেকগুলোর তদন্তে অগ্রগতি আছে বলেও পুলিশ সদর দপ্তর জানায়৷

‘এজাহারের কমন ফরম্যাট দাঁড় করানো হয়েছে’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ‘‘আমার পর্যবেক্ষণ বলছে প্রধানত চাঁদাবাজির জন্য এই গণমামলা দায়ের হচ্ছে৷ মামলার এজাহারের একটি কমন ফরম্যাট দাঁড় করানো হয়েছে৷ সেখানে শেখ হাসিনাসহ পতিত সরকারের মন্ত্রী এমপিদের নাম থাকে৷ কিছু সাংবাদিক বা পরিচিত ব্যক্তিদের নাম থাকে, তারপর চাঁদা আদায়ের জন্য অন্যদের নাম যুক্ত করা হয়৷ পূর্ব শত্রুতা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণেও ওই মামলাগুলোর আসামির তালিকায় নাম ঢুকানো হয়৷”

‘‘প্রথমে মামলার একটি ড্রাফট করে টার্গেট ব্যক্তিদের নাম দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে নাম বাদ দিয়ে মামলা করা হয়৷ মামলা করার পর দ্বিতীয় ধাপে তদন্ত পর্যায়ে যারা টাকা দেয় তাদের নাম বাদীর মাধ্যমে ভুল হয়েছে বলে বাদ দেয়া হয়৷ এরপর বিচারে গেলে আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দিয়ে বাঁচিয়ে দেয়ার কথা বলে টাকা আদায় করা হবে,” বলেন তিনি৷

ব্যারিস্টার ফারুক জানান, ‘‘এখন মামলা করার জন্য একটি চক্র তৈরি হয়েছে৷ তারাই বিভিন্ন ঘটনা ও বাদী যারা হবেন তাদের খুঁজে বের করেন৷ এরপর ওই চক্রই মামলার সব কিছু ঠিক করে৷ বাদীকে তারা অর্থের লোভ দেখিয়ে এটা করায়৷”

তার কথা, ‘‘সরকার যদি এটা এখনই বন্ধ না করে তাহলে প্রকৃত মামলাগুলোও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে৷ আর এরইমধ্যে অনেক সাধারণ মানুষ হয়রানি হচ্ছেন৷ আর একটি চক্র এইসব মামলাকে কাজে লাগিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে৷”

‘এবার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে’

পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘‘মিথ্যা বা ভুয়া মামলা আগেও হয়েছে৷ কিন্তু এবার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে৷ সরকারের উপদেষ্টারা বলছেন৷ কিন্তু কাজ তো হচ্ছে না৷ কারণ তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই৷ গণ ভুয়া মামলা চলছেই৷ নিরীহ মানুষকে আসামি করা হচ্ছে৷ এই ধরনের মামলা করতে যেন ব্যাপক উৎসাহ তৈরি হয়েছে৷”

তিনি বলেন, ‘‘কোনো নাগরিক মামলা করতে গেলে থানা মামলা নেবে৷ কিন্তু থানা যদি একটু প্রাথমিক তদন্ত করে মামলা নেয় তাহলে এই গণআসামি করা বন্ধ হবে৷ এখানে একটি চক্র আছে৷ যারা এটাকে ব্যবসা হিসাবে নিয়েছে৷ এখানে নানা ধরনের লোক যুক্ত হয়েছে৷ সরকার যেন ছেড়ে দিয়েছে৷”

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট বিগত সরকারের পতনের পর গণঅভ্যুত্থানে হতাহত ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির লক্ষ্যে দায়ের করা বেশকিছু মামলায় সমন্বয়হীনতা বা অসামঞ্জস্যতার অভিযোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ এসব মামলায় আসামি গ্রেপ্তারের নামে হয়রানির অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ৷ নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করায় ইতোমধ্যে দায়ের করা মামলাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে৷”

আসক বলছে, ‘‘ছাত্র-জনতা হত্যার ঘটনায় মামলা করার অধিকার সাধারণ মানুষের আছে৷ তবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব মামলায় কাউকে ফাঁসানো বা হয়রানির উদ্দেশ্যে আসামি করা হলে, তা মানবাধিকারের পরিপন্থি৷”

‘‘বিগত সরকারের সময় বিভিন্ন সময়ে ‘গায়েবি’ মামলার ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল৷ বর্তমান সরকারের সময়েও ‘গায়েবি মামলা’ ফিরে এসেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে৷ কেননা, ঘটনাস্থলে কখনোই উপস্থিত ছিলেন না এমন ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে৷ আশ্চর্যজনকভাবে বেশ কিছু মামলার এজাহার ও আসামি একই,” বলে আসক এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে৷

পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘‘৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের ব্যাপারে দায়ের করা মামলাগুলো আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি৷ সদরদপ্তরের সিনিয়র অফিসাররা মামলাগুলোর ব্যাপারে নজর রাখছেন৷ আর পুলিশ সদরদপ্তর নির্দেশ দিয়েছে, মামলা হলেই যেন কাউকে গ্রেপ্তার করা না হয়৷ তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে৷”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘মামলা করার অধিকার নাগরিকদের আছে৷ আবার কোনো নাগরিক যেন হয়রানির শিকার না হন তাও দেখা আমাদের দায়িত্ব৷”

ডয়চে ভেলে বাংলা

সাকিব ও মাশরাফি ছাড়া পারফরম্যান্স, শ্রীলঙ্কা টেস্ট সিরিজের পর পথ কি?

গণমামলা আর গণআসামির নেপথ্যে চাঁদাবাজি?

০২:৫৪:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট ছাত্র জনতার আন্দোলনে হত্যা ও হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন ঘটনায় এখন পর্যন্ত এক হাজার ৪৯৯টি মামলা হয়েছে বলে পুলিশ সদরদপ্তর জানিয়েছে৷ এসব মামলায় গণআসামি করার নেপথ্যে চাঁদাবাজি বলে অভিযোগ উঠেছে৷

সব আসামিকে চেনেন না বাদী

মিরপুর থানায় আলোচিত যে হত্যা মামলা হয়েছে তাতে শেখ হাসিনাসহ ৪০৭ জনকে আসামি করা হয়েছে৷ ওই মামলায় অভিনেতা ইরেশ যাকের ও সাংবাদিকদেরও আসামি করা হয়েছে৷ ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মিছিলে মিরপুরে গুলি ও গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ছাত্রদলের কর্মী মাহফুজ আলম শ্রাবণকে হত্যার অভিযোগে ওই মামলা করেন তার ভাই বিএনপি কর্মী মোস্তাফিজ বাপ্পি৷

ইরেশ যাকেরকে আসামি করায় এরইমধ্যে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে৷ আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ইরেশ যাকেরকে আসামি করার সমালোচনা করেছেন৷ আদালতে ২০ এপ্রিল মামলাটি দায়ের করার পর আদালতের নির্দেশে মিরপুর থানা ২৭ এপ্রিল এজাহার হিসাবে নেয়৷

ওই মামলার বাদী মোস্তফা বাপ্পি নিজেকে বিএনপির কর্মী পরিচয় দিয়ে ডিডাব্লিউকে জানান, ঘটনার দিন তিনি নিজে ঢাকায় ছিলেন না৷ সবার কাছ থেকে শুনে মামলাটি করেছেন৷ আসামিদের নাম ঠিকানা ঠিকমতো সংগ্রহ করতে সময় লাগায় মামলা করতে দেরি হয়েছে৷

‘‘আসামিদের সবাইকে আমি চিনি না৷ আমি ঢাকায়ও ছিলাম না৷ আর গণমামলার তো একটা পদ্ধতি আছে, আমি সেভাবেই করেছি৷ আরো তো মামলা হয়েছে৷ সেভাবেই আমি করেছি৷ সবার কাছে শুনে মামলা করেছি৷ এখন তদন্তে দেখা যাবে কারা কারা জড়িত ছিলো,” বলেন তিনি৷

ইরেশ যাকের প্রসঙ্গে বাদী মোস্তফা বাপ্পি বলেন, ‘‘তিনি তো আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে ব্যবসা করতেন৷ তাদের তো অ্যাডফার্ম আছে এশিয়াটিক৷ নূর তো আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী ছিলেন৷ ফলে ইরেশ যাকেরও তো সুবিধাভোগী৷”

বাদী মোস্তফা বাপ্পি বাড়ি নওগাঁয়৷ তিনি ঘটনার সময় নওগাঁ ছিলেন৷ এখনো সেখানেই আছেন৷ মামলা করার সময় এসেছিলেন৷ আর এলাকায় তিনি ছোটখাটো ব্যবসা করেন বলে জানান৷

পুলিশের কাছ থেকে সাক্ষী হওয়ার তথ্য পান জয়নাল

ওই মামলায় মোট আটজন সাক্ষীর নাম দেয়া হয়েছে৷ তাদের মধ্যে মিরপুরের জয়নাল আবেদীন জানান, ‘‘আমাকে যে ওই মামলার সাক্ষী করা হয়েছে তা মামলা হওয়ার পর পুলিশ আমাকে ফোন করে জানায়৷ ঘটনা ঘটেছে মিরপুর থানার সামনে৷ আর আমার একটা চায়ের দোকান আছে মিরপুর ২ নাম্বারে৷ তবে শ্রাবণ আমার দোকানের পাশেই একটি বাসায় ভাড়া থাকত৷ আমার দোকানে চা খেতে আসত৷ সে মারা যাওয়ার পর আমি শুনেছি৷ আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না৷ কিছু জানিও না৷ কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাও আমার জানা নাই৷”

আরেক সাক্ষী সাইফুল ইসলাম জানান, ‘‘শ্রাবণ পড়াশোনার পাশাপাশি রেনেটায় চাকরি করত৷ আমার বাসার পাশেই থাকত৷ তাকে আমি চিনি৷ ওই দিন আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম৷ পুলিশের গুলিতে মোট পাঁচজন মারা যায়৷ কিন্তু পুলিশ ছাড়া আর কেউ হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে আমার জানা নাই৷”

মিরপুর থানা পুলিশ জানায়, তারা আদালতের নির্দেশে মামলা নিয়েছে৷ এখন আইন মেনে তদন্ত হচ্ছে৷ জড়িত নয়, এমন কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না৷ তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে৷

পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য বলছে, জুলাই-আগস্ট ছাত্র জনতার আন্দোলনে হত্যা ও হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন ঘটনায় এখন পর্যন্ত এক হাজার ৪৯৯টি মামলা হয়েছে৷ এর মধ্যে হত্যা মামলা ৫৯৯টি৷ অন্যান্য ৯০০টি৷ এসব মামলায় ১০ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ হত্যা মামলার মধ্যে অনেকগুলোর তদন্তে অগ্রগতি আছে বলেও পুলিশ সদর দপ্তর জানায়৷

‘এজাহারের কমন ফরম্যাট দাঁড় করানো হয়েছে’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ‘‘আমার পর্যবেক্ষণ বলছে প্রধানত চাঁদাবাজির জন্য এই গণমামলা দায়ের হচ্ছে৷ মামলার এজাহারের একটি কমন ফরম্যাট দাঁড় করানো হয়েছে৷ সেখানে শেখ হাসিনাসহ পতিত সরকারের মন্ত্রী এমপিদের নাম থাকে৷ কিছু সাংবাদিক বা পরিচিত ব্যক্তিদের নাম থাকে, তারপর চাঁদা আদায়ের জন্য অন্যদের নাম যুক্ত করা হয়৷ পূর্ব শত্রুতা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণেও ওই মামলাগুলোর আসামির তালিকায় নাম ঢুকানো হয়৷”

‘‘প্রথমে মামলার একটি ড্রাফট করে টার্গেট ব্যক্তিদের নাম দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে নাম বাদ দিয়ে মামলা করা হয়৷ মামলা করার পর দ্বিতীয় ধাপে তদন্ত পর্যায়ে যারা টাকা দেয় তাদের নাম বাদীর মাধ্যমে ভুল হয়েছে বলে বাদ দেয়া হয়৷ এরপর বিচারে গেলে আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দিয়ে বাঁচিয়ে দেয়ার কথা বলে টাকা আদায় করা হবে,” বলেন তিনি৷

ব্যারিস্টার ফারুক জানান, ‘‘এখন মামলা করার জন্য একটি চক্র তৈরি হয়েছে৷ তারাই বিভিন্ন ঘটনা ও বাদী যারা হবেন তাদের খুঁজে বের করেন৷ এরপর ওই চক্রই মামলার সব কিছু ঠিক করে৷ বাদীকে তারা অর্থের লোভ দেখিয়ে এটা করায়৷”

তার কথা, ‘‘সরকার যদি এটা এখনই বন্ধ না করে তাহলে প্রকৃত মামলাগুলোও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে৷ আর এরইমধ্যে অনেক সাধারণ মানুষ হয়রানি হচ্ছেন৷ আর একটি চক্র এইসব মামলাকে কাজে লাগিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে৷”

‘এবার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে’

পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘‘মিথ্যা বা ভুয়া মামলা আগেও হয়েছে৷ কিন্তু এবার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে৷ সরকারের উপদেষ্টারা বলছেন৷ কিন্তু কাজ তো হচ্ছে না৷ কারণ তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই৷ গণ ভুয়া মামলা চলছেই৷ নিরীহ মানুষকে আসামি করা হচ্ছে৷ এই ধরনের মামলা করতে যেন ব্যাপক উৎসাহ তৈরি হয়েছে৷”

তিনি বলেন, ‘‘কোনো নাগরিক মামলা করতে গেলে থানা মামলা নেবে৷ কিন্তু থানা যদি একটু প্রাথমিক তদন্ত করে মামলা নেয় তাহলে এই গণআসামি করা বন্ধ হবে৷ এখানে একটি চক্র আছে৷ যারা এটাকে ব্যবসা হিসাবে নিয়েছে৷ এখানে নানা ধরনের লোক যুক্ত হয়েছে৷ সরকার যেন ছেড়ে দিয়েছে৷”

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট বিগত সরকারের পতনের পর গণঅভ্যুত্থানে হতাহত ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির লক্ষ্যে দায়ের করা বেশকিছু মামলায় সমন্বয়হীনতা বা অসামঞ্জস্যতার অভিযোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ এসব মামলায় আসামি গ্রেপ্তারের নামে হয়রানির অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ৷ নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করায় ইতোমধ্যে দায়ের করা মামলাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে৷”

আসক বলছে, ‘‘ছাত্র-জনতা হত্যার ঘটনায় মামলা করার অধিকার সাধারণ মানুষের আছে৷ তবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব মামলায় কাউকে ফাঁসানো বা হয়রানির উদ্দেশ্যে আসামি করা হলে, তা মানবাধিকারের পরিপন্থি৷”

‘‘বিগত সরকারের সময় বিভিন্ন সময়ে ‘গায়েবি’ মামলার ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল৷ বর্তমান সরকারের সময়েও ‘গায়েবি মামলা’ ফিরে এসেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে৷ কেননা, ঘটনাস্থলে কখনোই উপস্থিত ছিলেন না এমন ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে৷ আশ্চর্যজনকভাবে বেশ কিছু মামলার এজাহার ও আসামি একই,” বলে আসক এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে৷

পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘‘৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের ব্যাপারে দায়ের করা মামলাগুলো আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি৷ সদরদপ্তরের সিনিয়র অফিসাররা মামলাগুলোর ব্যাপারে নজর রাখছেন৷ আর পুলিশ সদরদপ্তর নির্দেশ দিয়েছে, মামলা হলেই যেন কাউকে গ্রেপ্তার করা না হয়৷ তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে৷”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘মামলা করার অধিকার নাগরিকদের আছে৷ আবার কোনো নাগরিক যেন হয়রানির শিকার না হন তাও দেখা আমাদের দায়িত্ব৷”

ডয়চে ভেলে বাংলা