বাংলাদেশে আদালতের নির্দেশে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কিংবা বিচারাধীন মামলায় কারাগারে যত বন্দি আছেন তার মধ্যে কিছু আসামি তাদের সামাজিক সম্মান ও মর্যাদার ভিত্তিতে ডিভিশন-সুবিধা পেয়ে থাকেন।
গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ-আল-মামুন বলছেন, কারাবিধি অনুযায়ী এবং কখনো কখনো আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তারা একজন আসামিকে কারাগারে ডিভিশন দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে থাকেন।
আবার কারাগারগুলোতে সিঙ্গেল রুমসহ ডিভিশনপ্রাপ্তদের জন্য যেসব সুবিধা থাকে সেটিও নির্ধারিত। ফলে তার বেশি একই ধরনের আসামি কারাগারে এলে তখন তাদের জন্য ডিভিশন সুবিধা দেয়া সম্ভব হয় না বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ডঃ কাজী জাহেদ ইকবাল বলছেন, বিধি অনুযায়ী ডিভিশন সুবিধা যারা পাবেন তাদের মধ্যে সবাই আবার একই ধরনের সুবিধা পাবেন না।
“কে কোন ক্যাটাগরিতে কী ধরনের সুবিধা পাবেন সেটি ঠিক করা আছে। একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি যে সুবিধা পাবেন সেটি একজন অধ্যাপক পাবেন না, যদিও তারা দুজনই বিধি অনুযায়ী ডিভিশন সুবিধা পাবেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
কারা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী দেশে এখন তেরটি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার আছে। সবসময়ই কারাগারে মোট ধারণক্ষমতার বেশি বন্দিকে এসব কারাগারে অবস্থান করতে হয়।
গত মাসে কারা সদর দপ্তরের দেয়া হিসেবে ৪২ হাজার ৮৭৭ জনের ধারণক্ষমতার বিপরীতে কারাগারে আছে ৭০ হাজারের বেশি বন্দি।
প্রথম শ্রেণির বন্দিরা সিঙ্গেল রুমে আলদা বিছানা পেয়ে থাকেন
ডিভিশন কারা পান
কারাবিধি অনুযায়ী বন্দিদের কারাগারে তিন ধরনের ডিভিশন দেয়া হয়ে থাকে। ডিভিশন-১, ডিভিশন-২ এবং ডিভিশন-৩।
কারা বিধিতে বলা হয়েছে, সব বন্দিদের তিনটি ডিভিশনে ভাগ করতে হবে। এর মধ্যে ভাল চরিত্র সম্বলিত অনভ্যাসগত বন্দি, সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন শিক্ষিত ও উন্নত জীবন যাপনে অভ্যস্ত বন্দি এবং নিষ্ঠুরতা, মারাত্মক অপরাধ, সম্পদের আত্মসাতসহ কিছু সুনির্দিষ্ট কারণে দণ্ডিত নন- এমন ব্যক্তিরা ডিভিশন- ১ এর যোগ্য হবেন।
এরাই মূলত প্রথম শ্রেণির বন্দি বলে বিবেচিত হন। আর এই প্রথম শ্রেণিতে যারা অন্তর্ভুক্ত হবেন তাদের মধ্যে থাকবেন সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্সের ১ থেকে ১৮ নম্বর পর্যন্ত অবস্থানে থাকা সব সাবেক ব্যক্তিবর্গ।
এছাড়া জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক বীরত্বসূচক মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তি, বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সিআইপি, প্রফেসর অফ ইমিরেটাস হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরাও ডিভিশন-১ এর সুবিধা পাবেন।
এর বাইরে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাথে পরামর্শক্রমে সময়ে সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিবেচিত ব্যক্তিরাও এই সুবিধা পেতে পারেন।
ওদিকে নাগরিকত্ব নির্বিশেষে সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা এবং অভ্যাসের কারণে জীবনযাপনের ধরন বিবেচনায় অন্য উচ্চমানের বন্দিগণ ডিভিশন-২ প্রাপ্তির যোগ্য হবেন।
কারা বিধিতে বলা হয়েছে বন্দির নিয়োগ করা আইনজীবী এবং আত্মীয় স্বজনকেই এ বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে হবে। আর তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলে কারা কর্তৃপক্ষ প্রথমে বন্দিকে ডিভিশন দিবেন এবং এরপর বিষয়টি সরকারের কাছে পাঠাবেন।
ডিভিশনপ্রাপ্তরা সাধারণ বন্দিদের চেয়ে বেশি সুবিধা পান
ডিভিশনপ্রাপ্তরা আলাদা কী সুবিধা পান
সাধারণত কোন ব্যক্তি গ্রেফতার হওয়ার পর তার জামিন না হলে তাকে জেল হাজতে পাঠানো হয়, যাদেরকে তখন বিচারাধীন বন্দি বলা হয়।
কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ-আল-মামুন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, বন্দিদের মধ্যে কারাবিধি অনুযায়ী যারা ডিভিশন পান তারা কারাগারে খালি থাকা সাপেক্ষে খাট সহ একটি সিঙ্গেল রুম পান ।
“এছাড়া তাদের খাবারের মেন্যু ও পরিমাণেও ভিন্নতা থাকে। তারা পত্রিকা, চেয়ার, টেবিল, তোষক,বালিশ, তেল, চিরুনি, আয়না সবকিছুই থাকে । আর নিয়মানুযায়ী স্বজনদের সাথে বিশেষ অনুমতি নিয়ে অফিস রুমে তারা দেখা করতে পারেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
এছাড়া ডিভিশনপ্রাপ্ত আসামিদের কাজকর্ম করে দেয়ার জন্য আরেকজন বন্দিও দেয়া হয়। পুরুষদের ক্ষেত্রে সাহায্যকারী হিসেবে আরেকজন ছেলে বন্দি আর নারী আসামিদের জন্য একজন মেয়ে বন্দি থাকবেন।
পাশাপাশি একটি পত্রিকা ও বই পড়ার সুযোগও তাদের দেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, সাধারণ বন্দিদের জন্য তাদের স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ কেবল কারাগারের প্রচলিত সাক্ষাৎ রুমেই থাকে।
ডঃ কাজী জাহেদ ইকবাল বলছেন, সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের ডিভিশন দেয়ার বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার। কোনো কারণে আদালত এ বিষয়ে নির্দেশনা না দিলে তারা নিজেরা তার আবেদন করতে পারবেন। কারা কর্তৃপক্ষ সেই আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠান চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য।
“কারাবিধিতে সুযোগ সুবিধাগুলো বলা হচ্ছে। এর বাইরে সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন মানুষের বিষয়ে আদালত নির্দেশ দিতে পারে। এর বাইরে বিধি অনুযায়ী ডিভিশন পাওয়ার যিনি যোগ্য তাকে কারা কর্তৃপক্ষ নিজেরাই এটি দেবেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
মি.ইকবাল বলেন, ডিভিশন পাওয়ার যোগ্য হয়েও কেউ ডিভিশন না পেলে তিনি আদালতে আবেদন করতে পারেন নিজের অবস্থান জানিয়ে। তখন আদালতও বিধি অনুযায়ী ডিভিশন দেয়ার নির্দেশ দিতে পারেন।
প্রিজন ভ্যানে করে আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে আনা নেয়া করা হয়
এখন ডিভিশন কারা পাচ্ছেন
গত বছর অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গ্রেফতার হওয়া বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক মন্ত্রী ও এমপিসহ অনেকে ডিভিশন সুবিধা পাচ্ছেন। আবার সাবেক এমপিসহ অনেকে আবার সেই সুবিধা পাচ্ছেন না।
গত মাসের শুরুতে ঢাকার বকশীবাজারে কারা সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) সৈয়দ মোতাহের হোসেন তখন পর্যন্ত মোট ১৫১ জনের প্রথম শ্রেণির বন্দি হিসেবে ডিভিশন সুবিধা পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন।
তার দেয়া হিসেব অনুযায়ী তখন পর্যন্ত সাবেক মন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের মধ্যে ৩০ জন, সাবেক সংসদ সদস্য ৩৮ জন, সরকারি কর্মকর্তা ৭০ জন ডিভিশন পাচ্ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে আরও ১৩ জন তখন এ সুবিধার আওতায় ছিলেন।
তবে অন্তত ২৪ জন সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি ও সরকারি কর্মকর্তা বন্দি থাকলেও তখন পর্যন্ত এ সুবিধা পাননি।
কারা কর্মকর্তারা বলছেন, সুবিধা খালি থাকা সাপেক্ষে সাধারণত ডিভিশন দেয়া হয়। তবে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে তখন সবাইকে এটি দেয়া যায় না।
বিবিসি নিউজ বাংলা