০৪:১৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

রাজনৈতিক দল জন্ম নেওয়ার ক্ষেত্রে যখন বার্থ কন্ট্রোল নীতি দুর্বল থাকে

  • Sarakhon Report
  • ০৮:০০:৪৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ মে ২০২৫
  • 116

স্বদেশ রায়

বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া ওপেন করলেই দেখা যায়, কেউ না কেউ বলছেন, মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় চাই। নির্বাচনের দরকার নেই। ড. ইউনূসও আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জনগণ আমাকে এখনই ক্ষমতা থেকে যেতে বলছে না। তারা এই ইন্টারিম গভর্নমেন্টকে ভালো মনে করে। শেখ হাসিনার আমলে ২০১৪ থেকে আর কোন ভালো নির্বাচন হয়নি। তখনও বিভিন্নভাবে এক শ্রেণির লোক বলতেন, শেখ হাসিনাকে মানুষ সরকারে চায়। ভালো নির্বাচন বড় কোন বিষয় নয়। তখন মনে হতো, শুধু শেখ হাসিনার লোকদের একটি অংশ নির্বাচন চায় না। এখন দেখা যাচ্ছে শেখ হাসিনার চরম বিপক্ষের লোকেরাও নির্বাচন চায় না। তারাও ব্যক্তিকে চায়। তাই বাংলাদেশে আসলে কতভাগ মানুষ নির্বাচন চায় বা ভালো নির্বাচন চায় তা একটি বড় গবেষণার বিষয়। এবং ইউনূসের এই আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকার ও সোশ্যাল মিডিয়ার ক্যাম্পেইনের পরে অন্তত এ বিষয়টি বলা যায়, কোন বড় গবেষণার আগে বলা যাবে না শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল ভালো নির্বাচন না দেওয়া।

তাই ওই নির্বাচনের দিকে না গিয়ে গবেষণা ছাড়া একজন সাংবাদিক হিসেবে সাদা চোখে মনে হয়, শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল, জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি না নেওয়া। এ ভূখণ্ডে জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি কঠোর ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে চালু হয় আইয়ুব খানের আমলে। সে সময় একটি প্রত্যন্ত গ্রামের গাছের গায়েও দেখা যেত একটি পোস্টার, “ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট”। স্বাধীনতার পরপর অর্থাভাব হোক আর সরকার গুছিয়ে উঠতে না পারার কারণে হোক—এই জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি থমকে থাকে। এরপরে এরশাদ আমলে জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি খুবই গতি পায়। গ্রামে গ্রামে প্রচুর ফিল্ড ওয়ার্কার নেওয়া হয়। তারা বাড়িতে বাড়িতে মহিলাদের কাছে জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পৌঁছাত। অন্যদিকে পুরুষরা অপারেশন করে বন্ধ্যত্ব মেনে নিলে তাদের লুঙ্গি, গেঞ্জি ও কয়েক শত নগদ টাকা দেওয়া হত।

এই জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি মূলত অলিখিতভাবে বন্ধ হয়ে যায় ২০০১ সালে জামায়াত ও বিএনপি সম্মিলিতভাবে ক্ষমতায় আসার পরে। কেউ কেউ বলে জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি জামায়াতের নীতিবিরুদ্ধ—তাই বিএনপি অলিখিতভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বন্ধ করে রাখে।

এরপরে ২০০৯-এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে একের পর এক উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে শুরু করলেও জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নিয়ে তাদের কোন উচ্চবাচ্য দেখতে পাই না। অথচ ততদিনে বাংলাদেশে যে ভয়াবহ হারে দরিদ্র ঘরে সন্তান জন্ম নিচ্ছে তার কিছুটা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়। ২০০৫-এর দিকে নিম্নবর্গীয়, বিশেষ করে বস্তির জীবন নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার জন্য কিছু ফিল্ডওয়ার্ক শুরু করেছিলাম। মনে করেছিলাম ফিল্ডওয়ার্কটা এখন সেরে রাখি। তারপরে যদি জীবনে সুযোগ পাই তাহলে উপন্যাসটা লিখব। যেমন আমার উপন্যাস “মৌসুমি বউ” লেখার জন্য ফিল্ডওয়ার্ক করেছিলাম ১৯৯১-এর দিকে। লেখার সুযোগ পেয়েছিলাম ২০০৪-এ। এ ছাড়া আমাদের মতো সাংবাদিক লেখকদের কোন উপায় থাকে না।

যাহোক, ওই বস্তি জীবন নিয়ে উপন্যাস লেখার জন্য প্রায় প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যার পরে দুই-তিনজন জুনিয়র বন্ধু নিয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি বস্তি এলাকা ঘুরতে থাকি। দেশের ওই সময়ের সকলে জানেন, ২০০৫-এর দিকে বস্তি এলাকাগুলো ছিল সন্ত্রাসের ঘাঁটি। সেখানে একা একা ঘোরা মোটেই সম্ভব ছিল না। তাছাড়া ততদিনে বাংলাদেশে বস্তিকেন্দ্রিক মাদক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। যাক, সেগুলো এ লেখার বিষয় নয়। বস্তির জীবনের কথা আসছে শুধুমাত্র একটি ঘটনা উল্লেখ করার জন্য। একদিন সন্ধ্যার পরে একটি বস্তি থেকে একটু দূরে একটা ফাঁকা মাঠের মতো স্থানে বসে—বস্তির ভেতরের নানান ঝগড়া শুনছি আর তাদের ঝগড়ার ভাষা ও স্টাইল বোঝার চেষ্টা করছি। এর ভেতর বুঝতে পারি এক স্বামী তার ওই বস্তির স্ত্রীকে ত্যাগ করে অন্য বস্তির স্ত্রীর কাছে চলে যাচ্ছে। তাই নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। এর ভেতর হঠাৎই লোকটি আমাদের সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে যায় হাতে একটি পুঁটলি নিয়ে। তার পিছে পিছে তার স্ত্রী ও সন্তানরা আসতে থাকে। আমার সঙ্গে থাকা এক জুনিয়র বন্ধু বারো কি তেরোটি সন্তান গোনার পরে আমি তাকে থামতে বলি।

ওই ঘটনার পর উপন্যাসের চেয়ে মাথায় বেশি চেপে বসে বার্থ কন্ট্রোলের বিষয়টি। যাহোক, রাজনৈতিক টানাপড়েনের ফলে সে কাজ তখন শুরু করতে পারিনি। ২০০৯-এর পর থেকে রিপোর্টারদের দিয়ে একের পর এক বার্থ কন্ট্রোল কার্যক্রম কেন জোরদার হচ্ছে না, বাধা কোথায় এগুলো নিয়ে রিপোর্ট করানোর চেষ্টা করি। ততদিনে এ খাতে আন্তর্জাতিক সাহায্যও কমে গেছে। আর আন্তর্জাতিক সাহায্য কমে গেলে এনজিও-বাবুরা তো হাত গুটিয়ে নেন। কারণ, এনজিও-সুশীলদের হাত ধুতেও তো ডলার লাগে।

যাহোক, এক পর্যায়ে দেশীয় অর্থে হলেও বার্থ কন্ট্রোল কর্মসূচি জোরদার করা কেন প্রয়োজন, এবং ভবিষ্যতে এই মাদকাসক্ত এলাকা থেকে উঠে আসা বা জন্ম নেওয়া একের পর এক প্রজন্ম দেশের জন্য কত ভয়ংকর হবে, পাশাপাশি আমাদের এই ছোট ভূখণ্ডে জনসংখ্যা নিয়ে একটা সুপরিকল্পনা থাকা উচিত—যাতে তরুণ ও বয়স্ক জনসংখ্যার ভারসাম্য, অন্যদিকে সম্পদের সঙ্গে সমন্বয় থাকাটাও জরুরি—এসব কথা উল্লেখ করে একটি অপিনিয়ন লিখি।

ওই লেখা পড়ার পরে তৎকালীন একজন সিনিয়র মন্ত্রী আমার ওখানে চা খেতে আসেন এবং বলেন, আমি যেন এই বিষয়টি নিয়ে বারবার লিখি। কারণ, তিনিও মনে করেন বার্থ কন্ট্রোল একান্ত দরকার। কিন্তু তাঁর নেত্রী সেটা মানতে রাজি নন। একটু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করি, কেন? তিনি কি পারলৌকিক বিশ্বাসের কারণে এটা মানতে রাজি নন? ওই মন্ত্রী উত্তর দেন, না। তাঁর নেত্রীর ঘনিষ্ঠ একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী তাঁকে বুঝিয়েছেন, দেশ যত বেশি শ্রমিক তৈরি করতে পারবে ততই বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশ লাভবান হবে। কারণ, শ্রমিক রপ্তানি করা যাবে। মানুষ যদিও একে কায়িক পরিশ্রম বলে, আমার মতে এটাও এক ধরনের শরীর বিক্রি। যাহোক, ওই মন্ত্রীকে হাসতে হাসতে বলি, শরীর বিক্রি করে কি সাসটেইনেবল অর্থনীতি গড়া যায় কখনও? পরে তাকে ওই তেরো-চৌদ্দটি খালি গায়ের বাচ্চার দৌড়ের গল্পটি বলি।

আজকাল মাঝেমাঝেই ওই বিভিন্ন সাইজের বারো-তেরোটি বাচ্চা একটি মায়ের পেছনে দৌড়াচ্ছে—ওই ছবিটি চোখে ভাসে। তবে সেটা মানুষের বার্থ কন্ট্রোলের বিষয়টি মনে করে নয়, রাজনৈতিক দলের বার্থ কন্ট্রোলকে মনে করে। যদিও আমরা আমাদের দীর্ঘ জীবনে এ দেশে অনেক অসাংবিধানিক সরকার দেখেছি। আর অসাংবিধানিক সরকার হলেই তখন রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে কোন বার্থ কন্ট্রোল পলিসি থাকে না। বরং জন্মটি শুধু উন্মুক্ত হয়ে যায় না, কোন এক অদৃশ্য প্রজনন থেকে তাদের জন্ম হতে থাকে। আবার সময়ের গর্ভে এগুলো হারিয়ে যায়। অন্যদিকে শত বিপর্যয়ে প্রকৃত সন্তানের মতো প্রকৃত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা ও কর্মীরা তাদের দল ও আদর্শ ধরে টিকে থাকে—এ ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতার দেশে।

যেমন জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দেন। সে সময় তাঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের প্রার্থী জেনারেল ওসমানী। কিন্তু যেহেতু ততদিনে রাজনৈতিক বার্থ কন্ট্রোল পদ্ধতি উঠে গেছে—তাই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী প্রায় ৭০ জনের ওপরে। পল্টনের ছোট্ট একটি জুতোর দোকানের মালিকও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে তিন দিন কচুরি পানার নিচে ছিলেন, এমন ব্যক্তিও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়েছিলেন। তবে ওই সময় আবার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ১৯৫৪-এর প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও পরবর্তীকালের বিশিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তক ও কমিউনিস্ট নেতা কমরেড তোয়াহা।

বেশ মনে পড়ে ১৯৭৮-এর ওই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় একটি সাবডিভিশন শহরে নিজ হাতে নিজের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের পোস্টারের বান্ডিল নিয়ে ট্রেন থেকে নামেন কমরেড তোয়াহা। কোন কারণে ওই রেল স্টেশনে সেদিন আমরা কয়েক বন্ধু ছিলাম ফিরতি রেলে চলে যাওয়ার জন্য। তাকে পোস্টারের বান্ডিল হাতে নামতে দেখে বাধ্য হয়ে আমাদের ফিরতি ট্রেনে যাওয়া বাতিল করতে হল। তিনি তখন আমাদের চিনতেন না। তবুও সালাম দিয়ে এগিয়ে গিয়ে তাঁর হাত থেকে পোস্টারের বান্ডিলটি নেই। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। তিনি আমাদের রেখে একটা রিকশা ডাকতে যান। আমরা দৌড়ে গিয়ে রিকশাওয়ালাকে ওনার পরিচয় জানাই। রিকশাওয়ালা বিনয়ী হয়ে মাথা নত করে তাকে রিকশায় উঠতে বলেন। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি, তিনি সার্কিট হাউসে যাবেন তো। তিনি হেসে বলেন, না, কাছে-পিঠে একটা টিনশেড হোটেল হলেই হবে। রিকশাওয়ালাকে তিনি নিজেই বললেন, তুমি এমন হোটেল চেনো না? আমাদের একজন তবু জোর করতে থাকে, তাকে সার্কিট হাউসে যাওয়ার জন্য। তিনি হেসে বলেন, সেখানে গিয়ে দেখ, জায়গা নেই—সরকারি লোকজনে ভরা। আমাদের একজন তবুও যায় এবং ফিরে এসে যা বলে তাতে বুঝি, অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই। যাহোক, একটা টিনশেড হোটেলে উঠে তিনি কোন মতে হাত-মুখ ধুয়ে একটু ডাল ও ভাজি দিয়ে ভাত খান। আমাদেরও খেতে বলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের সামনে না করার কোন উপায় ছিল না। এর ভেতর তিনি এক ফাঁকে বাইরে যান—তা আমরা দেখতে পাইনি। পরে দেখি হোটেলের বাবুর্চি তাঁর ময়দা জাল দিয়ে নিয়ে এসেছেন। এরপরে তিনি ময়দার পাত্র আর পোস্টার হাতে নিয়ে বের হওয়ার উদ্যোগ নেন। ততক্ষণে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোক ও কিছু অরাজনৈতিক মানুষ জড়ো হয়ে গেছেন তাঁর নাম শুনে। তারা সকলে মিলে তাঁর হাত থেকে ময়দার পাত্র আর পোস্টার কেড়ে নেন এবং তাঁকে সঙ্গে নিয়ে শহরের দেয়ালে দেয়ালে সেই পোস্টার লাগাতে থাকেন।

এরপরে সাংবাদিকতার জীবনে এসে কমরেড তোয়াহার খুব কাছের মানুষ হয়েছি। তাঁর বাম অর্থনীতি বিশ্বাসের সঙ্গে আমার ক্যাপিটালিজমের প্রতি বেশি আস্থার কখনও সংঘাত হয়নি। বরং তিনি সব সময়ই আমাকে কমিউনিস্ট বলতেন। যাহোক, সেই ১৯৭৮ সালের রেল স্টেশনটি মনে পড়লে- মনে পড়ে মানুষটি সেই ১৯৭৮-এ পৌঁছেছিলেন, ১৯৪০-এরও আগের থেকে রাজনীতি শুরু করে। ঘনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন—প্রখ্যাত রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি আবুল হাশিমের। শুধু ঘনিষ্ঠ নয়, স্নেহেরও ছিলেন। তাঁকে ভালোবাসতেন শেরে-বাংলা এ. কে. ফজলুল হকও। সর্বোপরি বাংলাদেশ সৃষ্টির সূতিকাগার ১৫০ মোগলটুলির তিনিও একজন। আর পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে কেমন ছিলেন, তার প্রমাণ তো পার্লামেন্টের প্রসিডিংসগুলোতেই আছে। রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁকে এখনও আমরা খুঁজে পাই আমাদের স্মৃতি ও পুরোনো নোটবুকে।

কমরেড তোয়াহা অনেক বড় নেতা—আবার সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মীও। সাংবাদিকতা জীবনে রাজনৈতিক দুর্দিনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিবেদিত হাজার হাজার কর্মী ও নেতাকে দেখার সুযোগ হয়েছে। যেমন একজন কর্মীর কথা মনে পড়ে, তিনি মোজাফফর ন্যাপ কর্মী ছিলেন। তাঁর এলাকায় সকলে তাঁকে ‘ন্যাপ সাহেব’ বলে চিনতেন। সারাদিন একটি হ্যান্ড-ব্যাগ বগলে নিয়ে পায়জামা বা লুঙ্গির ওপরে একটা হাফ-স্লিভ শার্ট পরে এলাকার লোকের নানান প্রয়োজন মিটিয়ে বেড়াতেন। এটাই ছিল তাঁর সারা দিনের রাজনৈতিক কাজ। তাঁর সংসারের দিকে কখনও তিনি তাকাননি। শুনতে পাই, একবার তাঁর ছোট ছেলেকে তার গ্রামের স্কুলে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে দেয়নি—বেতন দিতে না পারায়।

ঠিক তেমনি ১৯৮৩-তে তখন কেবল ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হয়েছে। আমি তখন একটি সাপ্তাহিক কাগজের সাংবাদিক। নিউজ কভার করার জন্য বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়েছি বেলা দুটো কি তিনটার দিকে। গিয়ে দেখি আওয়ামী লীগ অফিসে তখনও বড় নেতারা আসেননি। ময়লা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা একজন ব্যক্তি বারবার বমি করছেন। ছোটবেলা থেকে রোগি-রোগী সেবার সঙ্গে পরিচয় ও অভ্যাস থাকার কারণে দ্রুত তাঁর কাছে যাই। গিয়েই মনে হয়, তাকে এখনই হাসপাতালে নেওয়া দরকার। কয়েকজনকে বলতে তারাও সাহায্য করেন। নিয়ে যাই ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে। ততক্ষণে তাঁর দেহ অনেকটা নেতিয়ে পড়েছে। সেখানে ডাক্তার জানান, উনি খালি পেটে প্যারাসিটামল খেয়েছেন। গায়ে হাত দিয়ে বুঝেছিলাম তাঁর গায়ে একটু তাপ আছে। পরে জানতে পারি, উনি আওয়ামী লীগের বৃহত্তর বরিশাল এলাকার একজন নেতা—আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যও। ঢাকায় খাবারের জন্য বাড়ি থেকে চিড়া ও গুড় নিয়ে এসেছিলেন। শুয়ে থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের মেঝেতে। ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং তিন দিনের জায়গায় চার-পাঁচ দিনে গড়ানোর ফলে তাঁর চিড়া-গুড় ফুরিয়ে যায়। তাঁর কাছে আর কোন টাকা-পয়সা না থাকায় উনি শুধু পানি খেয়ে ছিলেন। এ অবস্থায় জ্বর আসাতে প্যারাসিটামল খেয়েছিলেন। যতদূর মনে পড়ে ভদ্রলোক আর বাঁচেননি। এই লেখা লেখার আগে তাঁকে চিনতে পারেন এমন যে দু-একজন বেঁচে আছেন যাদের বয়স আশির অনেক ওপরে; তাঁদের একজন কিছুটা মনে করতে পারেন তাঁর কথা, তবে নাম মনে করতে পারলেন না। এখন তাঁর নাম মনে করার মতো আমির হোসেন আমু ছাড়া কোন আওয়ামী লীগার নেই।

এভাবে উদাহরণ দিতে গেলে কয়েক হাজার পৃষ্ঠার বই হয়ে যাবে। কারণ, কমিউনিস্ট পার্টিতে এর সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। হয়তো বড় পার্টি বলে আওয়ামী লীগের সংখ্যাটি অনেক বড় হবে। যেমন ‘সচিত্র সন্ধানী’তে থাকার সময় একদিন এক ব্যক্তি আসেন—একটি অতি সাধারণ পায়জামা ও পাঞ্জাবি পরা। গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইকে তাঁকে বেশ শ্রদ্ধা করতে দেখে প্রথমে মনে করেছিলাম, হয়তো গ্রামে থাকেন এমন কোন লেখক হবেন। কিন্তু দেখি উনি গাজী ভাইয়ের কাছে আমাকে খুঁজছেন। আমার লেখার সঙ্গে নাকি তাঁর পরিচয় ৮৪-৮৫ সাল থেকে। আমার খবর পেয়েছেন ফজলুল হক বিএসসির কাছে। আলাপের পরে জানতে পারি, তিনি ১৯৬২ সালের দিকে গাজী গোলাম মোস্তফা জেলে গেলে ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে লাহোরে ছয় দফার বৈঠকে গিয়েছিলেন। এবং ঢাকার শুধু আওয়ামী লীগ নয় সব রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের তিনি চেনেন। চেনেন পুরোনো ঢাকা থেকে শুরু করে বেরাইদ ইউনিয়নের প্রতিটি মানুষকে—যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগ্রামে ও আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে লড়েছেন।

সাধ্য না থাকলেও মানুষের সাধের অভাব থাকে না। তাই মনে হলো, আচ্ছা, সেই ১৯৪৮ থেকে একের পর এক যে গণ-আন্দোলন এই ভূখণ্ডে হচ্ছে—এর সবই তো শুরু হয় ঢাকা থেকে, তারপর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। আর সে সব আন্দোলন তো কোন সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্যাম ছিল না, কোন মেটিকুলাস ডিজাইনের ফসল ছিল না; ছিল সাধারণ মানুষের ও রাজনৈতিক দলের ঘোষিত ওপেন আন্দোলন। আগেই সেখানে আন্দোলনের লক্ষ্য ও কর্মসূচি ঘোষণা করা থাকত।

তাই স্বাভাবিকভাবে সাধ জাগে এ নিয়ে গবেষণা করার। বয়সও তখন কম ছিল। মনে করলাম, গবেষণার কাঁচা মাল হিসেবে আপাতত আন্দোলনের স্থানীয় ইউনিয়ন পর্যায়ের (তখন ঢাকা পৌরসভা হওয়ায়, ধানমন্ডিও একটি ইউনিয়ন) নেতাদের সাক্ষাৎকারগুলো নিয়ে রাখা।

সমস্যা সৃষ্টি হয় ওই ভদ্রলোক—অর্থাৎ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সামাদ সাহেবের মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসার খরচ নিয়ে। কারণ, প্রতি সপ্তাহে একবার আসতে তাঁর লঞ্চ ও বাস ভাড়া মিলিয়ে খরচ দশ টাকা। সেটা তাঁর পক্ষে ব্যয় করা সম্ভব নয়। আমি সংকুচিত চিত্তে তাঁকে সেটা দিতে চাইলে তিনি প্রথমে নিতে রাজি হন না। তখন আমি বলি, তিনি এটা নিলে আমার বড় একটা গবেষণার কাজ হবে। এটা আমারই লাভ, তিনি শুধু আমার জন্য কষ্ট করছেন। কাজটা করেছিলাম বেশ কিছুদিন। তারপর সাংবাদিকতায় অনেক বেশি ব্যস্ত হওয়ায় আর এগোয়নি।

এরপরে সামাদ সাহেবের সঙ্গে দেখা হয় ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে। সেদিন আওয়ামী লীগের ১৯৯১-এর নির্বাচনে মনোনয়নপ্রার্থীদের সাক্ষাৎকার চলছিল। হঠাৎ দেখি হাসি মুখে সাদা শশ্রুমণ্ডিত সামাদ সাহেব আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর বলেন, মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন, মনোনয়ন বোর্ড থেকে এখনই বের হলেন। তাঁর হাসি মুখ দেখে মনে হলো, তিনি মনে হয় মনোনয়ন পাচ্ছেন। তবে আমাকে চমকে দিয়ে সেই হাসি মুখেই বললেন, মনোনয়ন বোর্ডে নেত্রী বললেন, প্রকৃত মনোনয়ন দিতে হলে তো আপনাকে দিতে হয়। কিন্তু আপনার তো টাকা নেই। নির্বাচন করবেন কীভাবে? এর ভেতর সামাদ সাহেবের পাশে তাঁর এলাকার অনেক কর্মী জমে যায়। আমিও আমার পেশার কাজে চলে যাই। এই লেখা লেখার আগে তাঁর নামও ভুলে গিয়েছিলাম। পরে মুন্সীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা ঢালী মোয়াজ্জেম ভাই—যার বয়স এখন প্রায় ৮০—তাকে জিজ্ঞেস করতে তিনি নামটি মনে করিয়ে দিলেন।

এরাই ছিলেন আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির মতো প্রাচীন দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা। এর বদলে এখন যখন আরাফাতরা এসে ভিড় করে তখন অনেক অঘটন ঘটে। তবে বাস্তবতা হলো, যে কোন দেশ থেকে আরাফাতরা পরাজিত হয়, হারিয়ে যায়, কিন্তু রাজনীতি ও প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মী-নেতা কখনও হারিয়ে যায় না। এদের সঙ্গে ওই বার্থ কন্ট্রোলেরও কোন সম্পর্ক নেই। নিয়মতান্ত্রিক পথে দীর্ঘ পরিক্রমায় জন্ম নেয় এরা।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World

রাজনৈতিক দল জন্ম নেওয়ার ক্ষেত্রে যখন বার্থ কন্ট্রোল নীতি দুর্বল থাকে

০৮:০০:৪৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ মে ২০২৫

স্বদেশ রায়

বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া ওপেন করলেই দেখা যায়, কেউ না কেউ বলছেন, মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় চাই। নির্বাচনের দরকার নেই। ড. ইউনূসও আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জনগণ আমাকে এখনই ক্ষমতা থেকে যেতে বলছে না। তারা এই ইন্টারিম গভর্নমেন্টকে ভালো মনে করে। শেখ হাসিনার আমলে ২০১৪ থেকে আর কোন ভালো নির্বাচন হয়নি। তখনও বিভিন্নভাবে এক শ্রেণির লোক বলতেন, শেখ হাসিনাকে মানুষ সরকারে চায়। ভালো নির্বাচন বড় কোন বিষয় নয়। তখন মনে হতো, শুধু শেখ হাসিনার লোকদের একটি অংশ নির্বাচন চায় না। এখন দেখা যাচ্ছে শেখ হাসিনার চরম বিপক্ষের লোকেরাও নির্বাচন চায় না। তারাও ব্যক্তিকে চায়। তাই বাংলাদেশে আসলে কতভাগ মানুষ নির্বাচন চায় বা ভালো নির্বাচন চায় তা একটি বড় গবেষণার বিষয়। এবং ইউনূসের এই আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকার ও সোশ্যাল মিডিয়ার ক্যাম্পেইনের পরে অন্তত এ বিষয়টি বলা যায়, কোন বড় গবেষণার আগে বলা যাবে না শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল ভালো নির্বাচন না দেওয়া।

তাই ওই নির্বাচনের দিকে না গিয়ে গবেষণা ছাড়া একজন সাংবাদিক হিসেবে সাদা চোখে মনে হয়, শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল, জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি না নেওয়া। এ ভূখণ্ডে জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি কঠোর ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে চালু হয় আইয়ুব খানের আমলে। সে সময় একটি প্রত্যন্ত গ্রামের গাছের গায়েও দেখা যেত একটি পোস্টার, “ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট”। স্বাধীনতার পরপর অর্থাভাব হোক আর সরকার গুছিয়ে উঠতে না পারার কারণে হোক—এই জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি থমকে থাকে। এরপরে এরশাদ আমলে জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি খুবই গতি পায়। গ্রামে গ্রামে প্রচুর ফিল্ড ওয়ার্কার নেওয়া হয়। তারা বাড়িতে বাড়িতে মহিলাদের কাছে জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পৌঁছাত। অন্যদিকে পুরুষরা অপারেশন করে বন্ধ্যত্ব মেনে নিলে তাদের লুঙ্গি, গেঞ্জি ও কয়েক শত নগদ টাকা দেওয়া হত।

এই জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি মূলত অলিখিতভাবে বন্ধ হয়ে যায় ২০০১ সালে জামায়াত ও বিএনপি সম্মিলিতভাবে ক্ষমতায় আসার পরে। কেউ কেউ বলে জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি জামায়াতের নীতিবিরুদ্ধ—তাই বিএনপি অলিখিতভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বন্ধ করে রাখে।

এরপরে ২০০৯-এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে একের পর এক উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে শুরু করলেও জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নিয়ে তাদের কোন উচ্চবাচ্য দেখতে পাই না। অথচ ততদিনে বাংলাদেশে যে ভয়াবহ হারে দরিদ্র ঘরে সন্তান জন্ম নিচ্ছে তার কিছুটা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়। ২০০৫-এর দিকে নিম্নবর্গীয়, বিশেষ করে বস্তির জীবন নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার জন্য কিছু ফিল্ডওয়ার্ক শুরু করেছিলাম। মনে করেছিলাম ফিল্ডওয়ার্কটা এখন সেরে রাখি। তারপরে যদি জীবনে সুযোগ পাই তাহলে উপন্যাসটা লিখব। যেমন আমার উপন্যাস “মৌসুমি বউ” লেখার জন্য ফিল্ডওয়ার্ক করেছিলাম ১৯৯১-এর দিকে। লেখার সুযোগ পেয়েছিলাম ২০০৪-এ। এ ছাড়া আমাদের মতো সাংবাদিক লেখকদের কোন উপায় থাকে না।

যাহোক, ওই বস্তি জীবন নিয়ে উপন্যাস লেখার জন্য প্রায় প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যার পরে দুই-তিনজন জুনিয়র বন্ধু নিয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি বস্তি এলাকা ঘুরতে থাকি। দেশের ওই সময়ের সকলে জানেন, ২০০৫-এর দিকে বস্তি এলাকাগুলো ছিল সন্ত্রাসের ঘাঁটি। সেখানে একা একা ঘোরা মোটেই সম্ভব ছিল না। তাছাড়া ততদিনে বাংলাদেশে বস্তিকেন্দ্রিক মাদক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। যাক, সেগুলো এ লেখার বিষয় নয়। বস্তির জীবনের কথা আসছে শুধুমাত্র একটি ঘটনা উল্লেখ করার জন্য। একদিন সন্ধ্যার পরে একটি বস্তি থেকে একটু দূরে একটা ফাঁকা মাঠের মতো স্থানে বসে—বস্তির ভেতরের নানান ঝগড়া শুনছি আর তাদের ঝগড়ার ভাষা ও স্টাইল বোঝার চেষ্টা করছি। এর ভেতর বুঝতে পারি এক স্বামী তার ওই বস্তির স্ত্রীকে ত্যাগ করে অন্য বস্তির স্ত্রীর কাছে চলে যাচ্ছে। তাই নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। এর ভেতর হঠাৎই লোকটি আমাদের সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে যায় হাতে একটি পুঁটলি নিয়ে। তার পিছে পিছে তার স্ত্রী ও সন্তানরা আসতে থাকে। আমার সঙ্গে থাকা এক জুনিয়র বন্ধু বারো কি তেরোটি সন্তান গোনার পরে আমি তাকে থামতে বলি।

ওই ঘটনার পর উপন্যাসের চেয়ে মাথায় বেশি চেপে বসে বার্থ কন্ট্রোলের বিষয়টি। যাহোক, রাজনৈতিক টানাপড়েনের ফলে সে কাজ তখন শুরু করতে পারিনি। ২০০৯-এর পর থেকে রিপোর্টারদের দিয়ে একের পর এক বার্থ কন্ট্রোল কার্যক্রম কেন জোরদার হচ্ছে না, বাধা কোথায় এগুলো নিয়ে রিপোর্ট করানোর চেষ্টা করি। ততদিনে এ খাতে আন্তর্জাতিক সাহায্যও কমে গেছে। আর আন্তর্জাতিক সাহায্য কমে গেলে এনজিও-বাবুরা তো হাত গুটিয়ে নেন। কারণ, এনজিও-সুশীলদের হাত ধুতেও তো ডলার লাগে।

যাহোক, এক পর্যায়ে দেশীয় অর্থে হলেও বার্থ কন্ট্রোল কর্মসূচি জোরদার করা কেন প্রয়োজন, এবং ভবিষ্যতে এই মাদকাসক্ত এলাকা থেকে উঠে আসা বা জন্ম নেওয়া একের পর এক প্রজন্ম দেশের জন্য কত ভয়ংকর হবে, পাশাপাশি আমাদের এই ছোট ভূখণ্ডে জনসংখ্যা নিয়ে একটা সুপরিকল্পনা থাকা উচিত—যাতে তরুণ ও বয়স্ক জনসংখ্যার ভারসাম্য, অন্যদিকে সম্পদের সঙ্গে সমন্বয় থাকাটাও জরুরি—এসব কথা উল্লেখ করে একটি অপিনিয়ন লিখি।

ওই লেখা পড়ার পরে তৎকালীন একজন সিনিয়র মন্ত্রী আমার ওখানে চা খেতে আসেন এবং বলেন, আমি যেন এই বিষয়টি নিয়ে বারবার লিখি। কারণ, তিনিও মনে করেন বার্থ কন্ট্রোল একান্ত দরকার। কিন্তু তাঁর নেত্রী সেটা মানতে রাজি নন। একটু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করি, কেন? তিনি কি পারলৌকিক বিশ্বাসের কারণে এটা মানতে রাজি নন? ওই মন্ত্রী উত্তর দেন, না। তাঁর নেত্রীর ঘনিষ্ঠ একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী তাঁকে বুঝিয়েছেন, দেশ যত বেশি শ্রমিক তৈরি করতে পারবে ততই বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশ লাভবান হবে। কারণ, শ্রমিক রপ্তানি করা যাবে। মানুষ যদিও একে কায়িক পরিশ্রম বলে, আমার মতে এটাও এক ধরনের শরীর বিক্রি। যাহোক, ওই মন্ত্রীকে হাসতে হাসতে বলি, শরীর বিক্রি করে কি সাসটেইনেবল অর্থনীতি গড়া যায় কখনও? পরে তাকে ওই তেরো-চৌদ্দটি খালি গায়ের বাচ্চার দৌড়ের গল্পটি বলি।

আজকাল মাঝেমাঝেই ওই বিভিন্ন সাইজের বারো-তেরোটি বাচ্চা একটি মায়ের পেছনে দৌড়াচ্ছে—ওই ছবিটি চোখে ভাসে। তবে সেটা মানুষের বার্থ কন্ট্রোলের বিষয়টি মনে করে নয়, রাজনৈতিক দলের বার্থ কন্ট্রোলকে মনে করে। যদিও আমরা আমাদের দীর্ঘ জীবনে এ দেশে অনেক অসাংবিধানিক সরকার দেখেছি। আর অসাংবিধানিক সরকার হলেই তখন রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে কোন বার্থ কন্ট্রোল পলিসি থাকে না। বরং জন্মটি শুধু উন্মুক্ত হয়ে যায় না, কোন এক অদৃশ্য প্রজনন থেকে তাদের জন্ম হতে থাকে। আবার সময়ের গর্ভে এগুলো হারিয়ে যায়। অন্যদিকে শত বিপর্যয়ে প্রকৃত সন্তানের মতো প্রকৃত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা ও কর্মীরা তাদের দল ও আদর্শ ধরে টিকে থাকে—এ ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতার দেশে।

যেমন জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দেন। সে সময় তাঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের প্রার্থী জেনারেল ওসমানী। কিন্তু যেহেতু ততদিনে রাজনৈতিক বার্থ কন্ট্রোল পদ্ধতি উঠে গেছে—তাই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী প্রায় ৭০ জনের ওপরে। পল্টনের ছোট্ট একটি জুতোর দোকানের মালিকও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে তিন দিন কচুরি পানার নিচে ছিলেন, এমন ব্যক্তিও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়েছিলেন। তবে ওই সময় আবার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ১৯৫৪-এর প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও পরবর্তীকালের বিশিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তক ও কমিউনিস্ট নেতা কমরেড তোয়াহা।

বেশ মনে পড়ে ১৯৭৮-এর ওই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় একটি সাবডিভিশন শহরে নিজ হাতে নিজের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের পোস্টারের বান্ডিল নিয়ে ট্রেন থেকে নামেন কমরেড তোয়াহা। কোন কারণে ওই রেল স্টেশনে সেদিন আমরা কয়েক বন্ধু ছিলাম ফিরতি রেলে চলে যাওয়ার জন্য। তাকে পোস্টারের বান্ডিল হাতে নামতে দেখে বাধ্য হয়ে আমাদের ফিরতি ট্রেনে যাওয়া বাতিল করতে হল। তিনি তখন আমাদের চিনতেন না। তবুও সালাম দিয়ে এগিয়ে গিয়ে তাঁর হাত থেকে পোস্টারের বান্ডিলটি নেই। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। তিনি আমাদের রেখে একটা রিকশা ডাকতে যান। আমরা দৌড়ে গিয়ে রিকশাওয়ালাকে ওনার পরিচয় জানাই। রিকশাওয়ালা বিনয়ী হয়ে মাথা নত করে তাকে রিকশায় উঠতে বলেন। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি, তিনি সার্কিট হাউসে যাবেন তো। তিনি হেসে বলেন, না, কাছে-পিঠে একটা টিনশেড হোটেল হলেই হবে। রিকশাওয়ালাকে তিনি নিজেই বললেন, তুমি এমন হোটেল চেনো না? আমাদের একজন তবু জোর করতে থাকে, তাকে সার্কিট হাউসে যাওয়ার জন্য। তিনি হেসে বলেন, সেখানে গিয়ে দেখ, জায়গা নেই—সরকারি লোকজনে ভরা। আমাদের একজন তবুও যায় এবং ফিরে এসে যা বলে তাতে বুঝি, অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই। যাহোক, একটা টিনশেড হোটেলে উঠে তিনি কোন মতে হাত-মুখ ধুয়ে একটু ডাল ও ভাজি দিয়ে ভাত খান। আমাদেরও খেতে বলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের সামনে না করার কোন উপায় ছিল না। এর ভেতর তিনি এক ফাঁকে বাইরে যান—তা আমরা দেখতে পাইনি। পরে দেখি হোটেলের বাবুর্চি তাঁর ময়দা জাল দিয়ে নিয়ে এসেছেন। এরপরে তিনি ময়দার পাত্র আর পোস্টার হাতে নিয়ে বের হওয়ার উদ্যোগ নেন। ততক্ষণে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোক ও কিছু অরাজনৈতিক মানুষ জড়ো হয়ে গেছেন তাঁর নাম শুনে। তারা সকলে মিলে তাঁর হাত থেকে ময়দার পাত্র আর পোস্টার কেড়ে নেন এবং তাঁকে সঙ্গে নিয়ে শহরের দেয়ালে দেয়ালে সেই পোস্টার লাগাতে থাকেন।

এরপরে সাংবাদিকতার জীবনে এসে কমরেড তোয়াহার খুব কাছের মানুষ হয়েছি। তাঁর বাম অর্থনীতি বিশ্বাসের সঙ্গে আমার ক্যাপিটালিজমের প্রতি বেশি আস্থার কখনও সংঘাত হয়নি। বরং তিনি সব সময়ই আমাকে কমিউনিস্ট বলতেন। যাহোক, সেই ১৯৭৮ সালের রেল স্টেশনটি মনে পড়লে- মনে পড়ে মানুষটি সেই ১৯৭৮-এ পৌঁছেছিলেন, ১৯৪০-এরও আগের থেকে রাজনীতি শুরু করে। ঘনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন—প্রখ্যাত রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি আবুল হাশিমের। শুধু ঘনিষ্ঠ নয়, স্নেহেরও ছিলেন। তাঁকে ভালোবাসতেন শেরে-বাংলা এ. কে. ফজলুল হকও। সর্বোপরি বাংলাদেশ সৃষ্টির সূতিকাগার ১৫০ মোগলটুলির তিনিও একজন। আর পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে কেমন ছিলেন, তার প্রমাণ তো পার্লামেন্টের প্রসিডিংসগুলোতেই আছে। রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁকে এখনও আমরা খুঁজে পাই আমাদের স্মৃতি ও পুরোনো নোটবুকে।

কমরেড তোয়াহা অনেক বড় নেতা—আবার সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মীও। সাংবাদিকতা জীবনে রাজনৈতিক দুর্দিনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিবেদিত হাজার হাজার কর্মী ও নেতাকে দেখার সুযোগ হয়েছে। যেমন একজন কর্মীর কথা মনে পড়ে, তিনি মোজাফফর ন্যাপ কর্মী ছিলেন। তাঁর এলাকায় সকলে তাঁকে ‘ন্যাপ সাহেব’ বলে চিনতেন। সারাদিন একটি হ্যান্ড-ব্যাগ বগলে নিয়ে পায়জামা বা লুঙ্গির ওপরে একটা হাফ-স্লিভ শার্ট পরে এলাকার লোকের নানান প্রয়োজন মিটিয়ে বেড়াতেন। এটাই ছিল তাঁর সারা দিনের রাজনৈতিক কাজ। তাঁর সংসারের দিকে কখনও তিনি তাকাননি। শুনতে পাই, একবার তাঁর ছোট ছেলেকে তার গ্রামের স্কুলে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে দেয়নি—বেতন দিতে না পারায়।

ঠিক তেমনি ১৯৮৩-তে তখন কেবল ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হয়েছে। আমি তখন একটি সাপ্তাহিক কাগজের সাংবাদিক। নিউজ কভার করার জন্য বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়েছি বেলা দুটো কি তিনটার দিকে। গিয়ে দেখি আওয়ামী লীগ অফিসে তখনও বড় নেতারা আসেননি। ময়লা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা একজন ব্যক্তি বারবার বমি করছেন। ছোটবেলা থেকে রোগি-রোগী সেবার সঙ্গে পরিচয় ও অভ্যাস থাকার কারণে দ্রুত তাঁর কাছে যাই। গিয়েই মনে হয়, তাকে এখনই হাসপাতালে নেওয়া দরকার। কয়েকজনকে বলতে তারাও সাহায্য করেন। নিয়ে যাই ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে। ততক্ষণে তাঁর দেহ অনেকটা নেতিয়ে পড়েছে। সেখানে ডাক্তার জানান, উনি খালি পেটে প্যারাসিটামল খেয়েছেন। গায়ে হাত দিয়ে বুঝেছিলাম তাঁর গায়ে একটু তাপ আছে। পরে জানতে পারি, উনি আওয়ামী লীগের বৃহত্তর বরিশাল এলাকার একজন নেতা—আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যও। ঢাকায় খাবারের জন্য বাড়ি থেকে চিড়া ও গুড় নিয়ে এসেছিলেন। শুয়ে থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের মেঝেতে। ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং তিন দিনের জায়গায় চার-পাঁচ দিনে গড়ানোর ফলে তাঁর চিড়া-গুড় ফুরিয়ে যায়। তাঁর কাছে আর কোন টাকা-পয়সা না থাকায় উনি শুধু পানি খেয়ে ছিলেন। এ অবস্থায় জ্বর আসাতে প্যারাসিটামল খেয়েছিলেন। যতদূর মনে পড়ে ভদ্রলোক আর বাঁচেননি। এই লেখা লেখার আগে তাঁকে চিনতে পারেন এমন যে দু-একজন বেঁচে আছেন যাদের বয়স আশির অনেক ওপরে; তাঁদের একজন কিছুটা মনে করতে পারেন তাঁর কথা, তবে নাম মনে করতে পারলেন না। এখন তাঁর নাম মনে করার মতো আমির হোসেন আমু ছাড়া কোন আওয়ামী লীগার নেই।

এভাবে উদাহরণ দিতে গেলে কয়েক হাজার পৃষ্ঠার বই হয়ে যাবে। কারণ, কমিউনিস্ট পার্টিতে এর সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। হয়তো বড় পার্টি বলে আওয়ামী লীগের সংখ্যাটি অনেক বড় হবে। যেমন ‘সচিত্র সন্ধানী’তে থাকার সময় একদিন এক ব্যক্তি আসেন—একটি অতি সাধারণ পায়জামা ও পাঞ্জাবি পরা। গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইকে তাঁকে বেশ শ্রদ্ধা করতে দেখে প্রথমে মনে করেছিলাম, হয়তো গ্রামে থাকেন এমন কোন লেখক হবেন। কিন্তু দেখি উনি গাজী ভাইয়ের কাছে আমাকে খুঁজছেন। আমার লেখার সঙ্গে নাকি তাঁর পরিচয় ৮৪-৮৫ সাল থেকে। আমার খবর পেয়েছেন ফজলুল হক বিএসসির কাছে। আলাপের পরে জানতে পারি, তিনি ১৯৬২ সালের দিকে গাজী গোলাম মোস্তফা জেলে গেলে ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে লাহোরে ছয় দফার বৈঠকে গিয়েছিলেন। এবং ঢাকার শুধু আওয়ামী লীগ নয় সব রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের তিনি চেনেন। চেনেন পুরোনো ঢাকা থেকে শুরু করে বেরাইদ ইউনিয়নের প্রতিটি মানুষকে—যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগ্রামে ও আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে লড়েছেন।

সাধ্য না থাকলেও মানুষের সাধের অভাব থাকে না। তাই মনে হলো, আচ্ছা, সেই ১৯৪৮ থেকে একের পর এক যে গণ-আন্দোলন এই ভূখণ্ডে হচ্ছে—এর সবই তো শুরু হয় ঢাকা থেকে, তারপর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। আর সে সব আন্দোলন তো কোন সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্যাম ছিল না, কোন মেটিকুলাস ডিজাইনের ফসল ছিল না; ছিল সাধারণ মানুষের ও রাজনৈতিক দলের ঘোষিত ওপেন আন্দোলন। আগেই সেখানে আন্দোলনের লক্ষ্য ও কর্মসূচি ঘোষণা করা থাকত।

তাই স্বাভাবিকভাবে সাধ জাগে এ নিয়ে গবেষণা করার। বয়সও তখন কম ছিল। মনে করলাম, গবেষণার কাঁচা মাল হিসেবে আপাতত আন্দোলনের স্থানীয় ইউনিয়ন পর্যায়ের (তখন ঢাকা পৌরসভা হওয়ায়, ধানমন্ডিও একটি ইউনিয়ন) নেতাদের সাক্ষাৎকারগুলো নিয়ে রাখা।

সমস্যা সৃষ্টি হয় ওই ভদ্রলোক—অর্থাৎ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সামাদ সাহেবের মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসার খরচ নিয়ে। কারণ, প্রতি সপ্তাহে একবার আসতে তাঁর লঞ্চ ও বাস ভাড়া মিলিয়ে খরচ দশ টাকা। সেটা তাঁর পক্ষে ব্যয় করা সম্ভব নয়। আমি সংকুচিত চিত্তে তাঁকে সেটা দিতে চাইলে তিনি প্রথমে নিতে রাজি হন না। তখন আমি বলি, তিনি এটা নিলে আমার বড় একটা গবেষণার কাজ হবে। এটা আমারই লাভ, তিনি শুধু আমার জন্য কষ্ট করছেন। কাজটা করেছিলাম বেশ কিছুদিন। তারপর সাংবাদিকতায় অনেক বেশি ব্যস্ত হওয়ায় আর এগোয়নি।

এরপরে সামাদ সাহেবের সঙ্গে দেখা হয় ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে। সেদিন আওয়ামী লীগের ১৯৯১-এর নির্বাচনে মনোনয়নপ্রার্থীদের সাক্ষাৎকার চলছিল। হঠাৎ দেখি হাসি মুখে সাদা শশ্রুমণ্ডিত সামাদ সাহেব আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর বলেন, মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন, মনোনয়ন বোর্ড থেকে এখনই বের হলেন। তাঁর হাসি মুখ দেখে মনে হলো, তিনি মনে হয় মনোনয়ন পাচ্ছেন। তবে আমাকে চমকে দিয়ে সেই হাসি মুখেই বললেন, মনোনয়ন বোর্ডে নেত্রী বললেন, প্রকৃত মনোনয়ন দিতে হলে তো আপনাকে দিতে হয়। কিন্তু আপনার তো টাকা নেই। নির্বাচন করবেন কীভাবে? এর ভেতর সামাদ সাহেবের পাশে তাঁর এলাকার অনেক কর্মী জমে যায়। আমিও আমার পেশার কাজে চলে যাই। এই লেখা লেখার আগে তাঁর নামও ভুলে গিয়েছিলাম। পরে মুন্সীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা ঢালী মোয়াজ্জেম ভাই—যার বয়স এখন প্রায় ৮০—তাকে জিজ্ঞেস করতে তিনি নামটি মনে করিয়ে দিলেন।

এরাই ছিলেন আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির মতো প্রাচীন দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা। এর বদলে এখন যখন আরাফাতরা এসে ভিড় করে তখন অনেক অঘটন ঘটে। তবে বাস্তবতা হলো, যে কোন দেশ থেকে আরাফাতরা পরাজিত হয়, হারিয়ে যায়, কিন্তু রাজনীতি ও প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মী-নেতা কখনও হারিয়ে যায় না। এদের সঙ্গে ওই বার্থ কন্ট্রোলেরও কোন সম্পর্ক নেই। নিয়মতান্ত্রিক পথে দীর্ঘ পরিক্রমায় জন্ম নেয় এরা।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World