১১:৩৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫
সপ্তাহান্তের ছোটখাটো খুশি—ঢাকার হোটেলে একটি পরিবারের ডিনার পরিকল্পনা ট্রাম্প রাশিয়ার উত্তেজক বিবৃতির পর দুইটি পারমাণবিক সাবমেরিন স্থানান্তরের নির্দেশ দিলেন হিউএনচাঙ (পর্ব-১৬১) ড্রাগ বা ডায়েট ছাড়া কীভাবে চীনে এক ইনফ্লুয়েন্সার পাঁচ বছরে ৬০ কেজি ওজন কমিয়েছেন ট্রাম্পের ট্যারিফে আফ্রিকা চীনের কোলে মাশরাফি বিন মর্তুজা: বাংলাদেশের এক মহান ক্রিকেটারের জীবনগাথা ট্রাম্পের শুল্ক ভারতের ৪০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে ফেডারেল তহবিল কাটা যাওয়ায় পাবলিক ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বন্ধ, স্থানীয় গণমাধ্যমে বড় ধাক্কা ট্রেড আলোচনা স্থবির, শুল্ক হুমকি বাড়ছে: যুক্তরাষ্ট্র–ভারত অংশীদারিত্বে টানাপোড়ন  বাংলাদেশে দুই কোটি হিন্দুর ও প্রগতিশীল মুসলিমদের ভবিষ্যত কি?

কী ‘উদ্দেশ্যে’ গাবতলীর হাট ইজারা বাতিল?

  • Sarakhon Report
  • ০৭:০০:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ মে ২০২৫
  • 65

গাবতলী পশুর হাটে সর্বোচ্চ দর দিয়েও কার্যাদেশ পায়নি একটি প্রতিষ্ঠান৷ সিটি কর্পোরেশন নিজেই হাসিল আদায় করছে৷ দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক৷

শুধু বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ, সাবেক সিপিটিইউ)-র ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না হওয়ায় গাবতলী গবাদি পশুর হাটের ইজারা দরপত্র বাতিল করা হয়েছে। এতে বড় অঙ্কের সরকারি আয় হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

টেন্ডার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ‘অন্য উদ্দেশ্যে’ খোঁড়া অজুহাতে এই টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে। কারণ, গত ১২ বছরে সিপিটিইউ হাট ইজারার কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেনি। তারপরও হাটগুলো ইজারা হয়েছে, সরকার রাজস্ব পেয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখে গত বুধবার দুদকের একটি দল ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন-ডিএনসিসি কার্যালয়ে অভিযান চালায়। সেখানে তারা প্রশাসক ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং নথি সংগ্রহ করেন। অভিযান পরিচালনা টিমের প্রধান, দুদকের সহকারি পরিচালক মো. আব্দুল মালেক ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, “গাবতলী পশুর হাট ইজারা দরপত্রের ক্ষেত্রে অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি রাজস্বের ক্ষতি করার অভিযোগ আমরা পেয়েছি। আমরা সংশ্লিষ্ট অন্য কর্তৃপক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলে রিপোর্ট কমিশনকে দেবো।”

দরপত্র আহবান এবং সর্বোচ্চ মূল্য

ঢাকার গবাদী পশুর সবচেয়ে বড় হাট গাবতলী পশুর হাট ইজারা দিতে গত ৩ মার্চ দরপত্র আহবান করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল ১৯ মার্চ এবং ওই দিনই দরপত্রের বাক্স খোলা হয়। গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় ৫ কোটি টাকা বেশি, অর্থাৎ ২২ কোটি ২৫ লাখ টাকার সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েছিল আরাত মোটর্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী গত তিন বছরের ইজারার মূল্য গড় করে তার সঙ্গে ৬ শতাংশ বাড়িয়ে নতুন ইজারা মূল্য ১৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৯ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করে ডিএনসিসি। সে অনুযায়ী সর্বোচ্চ দরদাতা আরাত মোটর্স ৭ কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার ৭০০ টাকা বেশি দর দিয়ে দরপত্র দাখিল করে। ফলে, কাজটি তাদের পাওয়ার কথা।
নির্ধারিত সময়ে পাঁচটি দরপত্র জমা পড়ে। আরাত মোটর্সের পর ২১ কোটি ৬৫ লাখ ৭০ হাজার ৩০০ টাকা দর দিয়ে দ্বিতীয় হয় এস এফ কর্পোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তৃতীয় হয়েছে রাইয়ান এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটি ১৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা দর দিয়েছিল। ‘দি সিমেন্ট জয়েন্ট’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান ১৪ কোটি ৬৩ লাখ দর দিয়ে চতুর্থ এবং ১৪ কোটি ৬২ লাখ দর দিয়ে পঞ্চম হয়েছে আবু বকর সিদ্দীক নামের অপর একটি প্রতিষ্ঠান।

এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দি সিমেন্ট জয়েন্ট ও আবু বকর সিদ্দীক কোনো পে অর্ডার দেয়নি। আর দ্বিতীয় হওয়া এস এফ কর্পোরেশন যে দুইটি পে অর্ডার দাখিল করে, তার মধ্যে ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার পে অর্ডারটি ‘ভুয়া’ প্রমাণিত হয়। ফলে, তাদের দরপত্র বাতিল করা হয়। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গত ৯ এপ্রিল সর্বোচ্চ দরদাতা আরাত মোটর্সকে কার্যাদেশ দেওয়ার জন্য মতামত দিয়ে প্রশাসকের কাছে নথি পাঠায়। চারদিন পর ১৩ এপ্রিল প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বিপিপিএ ওয়েব সাইটে দরপত্র প্রকাশ না হওয়ার কথা বলে তা বাতিল করে দেন।
দরপত্র আহবান কমিটির প্রধান ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (বর্তমানে অর্থ বিভাগে বদলি হয়েছেন) মো. নুরুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমরা নিয়ম মেনে দরপত্র আহবান করেছি। এখন যেটা বলা হচ্ছে, বিপিপিএ’র ওয়েবসাইটে প্রকাশ না হওয়ায় এটা বাতিল। আমরা কিন্তু বিপিপিএ’র কাছে এই দরপত্র পাঠিয়েছি তাদের ওয়েবসাইটে প্রচার করার জন্য। সেই কথা আমাদের বিজ্ঞপ্তির নীচে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু তারা ক্রয় সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া হাট ইজারার দরপত্র প্রচার করে না বলে ফেরত পাঠিয়েছে। এভাবেই গত ১২ বছর ধরে হাটগুলো ইজারা দেওয়া হচ্ছে। যে অজুহাতে এটা বাতিল করা হয়েছে, সেটা খোঁড়া অজুহাত। এর পেছনে ‘অন্য উদ্দেশ্য’ থাকতে পারে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে বড় বড় কর্মকর্তারা আছেন, তিনজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আছেন, তারাও কি বিষয়টি বোঝেন না? তা তো নয়। তারা নিশ্চয় জেনে-বুঝে সুপারিশ করেছেন। আমি বলতে পারি, আমরা নিয়মের বাইরে কোনো কিছু করিনি।”

ডিএনসিসি কার্যালয়ে দুদকের অভিযান

দুদকের সহকারি পরিচালক মো. আব্দুল মালেক ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, “গাবতলী পশুর হাটের ইজারা নিয়ে একটা টেলিভিশনে রিপোর্ট আমরা দেখতে পাই। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে কমিশন বিষয়টি অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নেয়। ডিএনসিসিতে গিয়ে আমরা প্রাথমিক অনুসন্ধান করেছি। এরপর সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে একটা রিপোর্ট প্রস্তুত করা হবে। সেই রিপোর্ট কমিশনে দাখিল করার পর কমিশন পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে।”
অভিযানের পর দুদকের পক্ষ থেকে সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তি বলা হয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক গাবতলী গরুর হাট ইজারা প্রদানে অনিয়মের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় রাজস্বের ক্ষতিসাধনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা থেকে একটি এনফোর্সমেন্ট টিম ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে অভিযান চালায়। অভিযানে সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের বক্তব্য গ্রহণ করা হয় এবং দরপত্র সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়।
অভিযানকারী টিম জানতে পারে, ২০২৫ সালের হাট ইজারায় সর্বোচ্চ দর ছিল প্রায় ২২ কোটি টাকা, যা সরকার নির্ধারিত দর ১৪.৬১ কোটির চেয়ে অনেক বেশি। মূল্যায়ন কমিটি সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা দেওয়ার সুপারিশ করলেও তা বাতিল করে খাস আদায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার যুক্তি হিসেবে সিপিটিইউ ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি না দেওয়ার কারণ দেখানো হয়। তবে হাট ইজারা সরকারি ক্রয় নীতিমালার আওতায় পড়ে না এবং এ ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার বাধ্যবাধকতাও নেই মর্মে অভিযানকালে টিম বিশেষজ্ঞ মতামত পায়।

প্রাথমিক পর্যালোচনায় অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাবতলী গরুর হাট ইজারা না দিয়ে বড় অঙ্কের সরকারি আয় হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে মর্মে টিমের নিকট প্রতীয়মান হয়। এনফোর্সমেন্ট টিম কর্তৃক প্রাথমিক সত্যতা প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে এ অভিযোগের বিষয়ে পরবর্তী করণীয় প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত চেয়ে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবে অভিযান পরিচালনাকারী টিম।

বিপিপিইউ নিয়ে যা জানা গেল

বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ), যেটা আগের নাম ছিল সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ)। সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়গুলো এদের ওয়েবসাইটে প্রচার করতে হয়। কিন্তু গাবতলী পশুর হাটের ইজারার ক্ষেত্রে সেটার প্রতিপালন করা হয়নি। গত ১০-১২ বছর ধরে সিপিটিইউ হাট ইজারার দরপত্রগুলো ওয়েবসাইটে প্রকাশ করছে না। সিপিটিইউ’র বক্তব্য- হাট ইজারা তো ক্রয় সংক্রান্ত কিছু না, ফলে. হাট ইজারার দরপত্র এখানে প্রকাশ করার দরকার নেই। এভাবেই এতদিন এই প্রক্রিয়া চলছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সরকারি কাজে মুখের কথার কোনো মূল্য নেই। আইনে আছে সিপিটিইউ’র ওয়েবসাইটে দরপত্র প্রচার হতে হবে। ফলে, সিপিটিইউ যদি প্রচার না করে, তাহলে তাদের লিখিতভাবে জানাতে হবে কেন তারা এটা প্রচার করছে না। আর সেই লিখিত বক্তব্য না থাকলে দরপত্র প্রক্রিয়া অবৈধ হবে। সরকারি কাজে এই বিষয়গুলো অবশ্যই অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। এখন কথা হচ্ছে, গত ১০-১২ বছরে তো লাগেনি৷ এতদিন লাগেনি বলে যে এখন লাগবে না এ কথা কেউ বলতে পারবেন না। যেটা নিয়ম, সব সময় সেটা মেনে চলাই সব কর্মকর্তার জন্য উত্তম।”

প্রশাসকের আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা

ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এখানে অবশ্যই প্রক্রিয়াগত ভুল হয়েছে। কেন সিপিটিইউ’র ওয়েবসাইটে এটা যাইনি। এই কারণে দরপত্র বাতিল করা হয়েছে। আমার প্রশ্ন, আমার সামনে নথি আসার আগে দু’টি কমিটি পার হয়ে এসেছে। একটি দরপত্র কমিটি এবং অন্যটি মূল্যায়ন কমিটি। তারা কেন বিষয়টি দেখলো না? এটা কি তাদের অগোচরে ভুল হয়েছে, নাকি ইচ্ছাকৃত সেটা তদন্তের জন্য আমি একটা কমিটি করেছি। আর দুদক যে এসেছে, অবশ্যই তারা তদন্ত করবে। যাদের কারণে এটা হয়েছে, সেগুলো তদন্তের বের হবে।”
চৈত্র মাসের শেষে এই প্রক্রিয়াগুলো শেষ হওয়ার কথা। বৈশাখ মাসের শুরুতে নতুন করে হাট থেকে হাসিল আদায়ের প্রথা চালু রয়েছে উল্লেখ করে প্রশাসক বলেন, “যেহেতু হাতে সময় নেই, তাই আমরা নিজেরাই হাসিল আদায় শুরু করেছি। কয়েকদিন এভাবে চলুক, দেখি কী পরিমাণ হাসিল আদায় হয়। যদি দেখি ভালো হচ্ছে, তাহলে আমরা নিজেরাই করবো। আর যদি দেখি কম হচ্ছে, তাহলে মন্ত্রণালয় থেকে মতামত নিয়ে নতুন টেন্ডার আহবান করবো।” পছন্দের ঠিকাদার কাজ না পাওয়ার কারণে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার অভিযোগ সম্পর্কে প্রশাসক বলেন, “আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ আমার নেই।”
প্রসঙ্গত, এর আগে গাবতলী হাটের ইজারাদার ছিলেন চলচ্চিত্র প্রয়োজক ও অভিনেতা মনোয়ার হোসেন ডিপজল। নিয়ম অনুযায়ী বাংলা বছরের শেষ দিন ১৩ এপ্রিল রাতে হাট বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি চিঠি দিয়েছিলেন। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের দাবি- আগের ইজারদার হাট ‘বুঝিয়ে না দিয়ে’ চলে গেছেন।

DW বাংলা

জনপ্রিয় সংবাদ

সপ্তাহান্তের ছোটখাটো খুশি—ঢাকার হোটেলে একটি পরিবারের ডিনার পরিকল্পনা

কী ‘উদ্দেশ্যে’ গাবতলীর হাট ইজারা বাতিল?

০৭:০০:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ মে ২০২৫

গাবতলী পশুর হাটে সর্বোচ্চ দর দিয়েও কার্যাদেশ পায়নি একটি প্রতিষ্ঠান৷ সিটি কর্পোরেশন নিজেই হাসিল আদায় করছে৷ দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক৷

শুধু বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ, সাবেক সিপিটিইউ)-র ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না হওয়ায় গাবতলী গবাদি পশুর হাটের ইজারা দরপত্র বাতিল করা হয়েছে। এতে বড় অঙ্কের সরকারি আয় হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

টেন্ডার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ‘অন্য উদ্দেশ্যে’ খোঁড়া অজুহাতে এই টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে। কারণ, গত ১২ বছরে সিপিটিইউ হাট ইজারার কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেনি। তারপরও হাটগুলো ইজারা হয়েছে, সরকার রাজস্ব পেয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখে গত বুধবার দুদকের একটি দল ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন-ডিএনসিসি কার্যালয়ে অভিযান চালায়। সেখানে তারা প্রশাসক ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং নথি সংগ্রহ করেন। অভিযান পরিচালনা টিমের প্রধান, দুদকের সহকারি পরিচালক মো. আব্দুল মালেক ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, “গাবতলী পশুর হাট ইজারা দরপত্রের ক্ষেত্রে অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি রাজস্বের ক্ষতি করার অভিযোগ আমরা পেয়েছি। আমরা সংশ্লিষ্ট অন্য কর্তৃপক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলে রিপোর্ট কমিশনকে দেবো।”

দরপত্র আহবান এবং সর্বোচ্চ মূল্য

ঢাকার গবাদী পশুর সবচেয়ে বড় হাট গাবতলী পশুর হাট ইজারা দিতে গত ৩ মার্চ দরপত্র আহবান করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল ১৯ মার্চ এবং ওই দিনই দরপত্রের বাক্স খোলা হয়। গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় ৫ কোটি টাকা বেশি, অর্থাৎ ২২ কোটি ২৫ লাখ টাকার সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েছিল আরাত মোটর্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী গত তিন বছরের ইজারার মূল্য গড় করে তার সঙ্গে ৬ শতাংশ বাড়িয়ে নতুন ইজারা মূল্য ১৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৯ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করে ডিএনসিসি। সে অনুযায়ী সর্বোচ্চ দরদাতা আরাত মোটর্স ৭ কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার ৭০০ টাকা বেশি দর দিয়ে দরপত্র দাখিল করে। ফলে, কাজটি তাদের পাওয়ার কথা।
নির্ধারিত সময়ে পাঁচটি দরপত্র জমা পড়ে। আরাত মোটর্সের পর ২১ কোটি ৬৫ লাখ ৭০ হাজার ৩০০ টাকা দর দিয়ে দ্বিতীয় হয় এস এফ কর্পোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তৃতীয় হয়েছে রাইয়ান এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটি ১৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা দর দিয়েছিল। ‘দি সিমেন্ট জয়েন্ট’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান ১৪ কোটি ৬৩ লাখ দর দিয়ে চতুর্থ এবং ১৪ কোটি ৬২ লাখ দর দিয়ে পঞ্চম হয়েছে আবু বকর সিদ্দীক নামের অপর একটি প্রতিষ্ঠান।

এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দি সিমেন্ট জয়েন্ট ও আবু বকর সিদ্দীক কোনো পে অর্ডার দেয়নি। আর দ্বিতীয় হওয়া এস এফ কর্পোরেশন যে দুইটি পে অর্ডার দাখিল করে, তার মধ্যে ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার পে অর্ডারটি ‘ভুয়া’ প্রমাণিত হয়। ফলে, তাদের দরপত্র বাতিল করা হয়। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গত ৯ এপ্রিল সর্বোচ্চ দরদাতা আরাত মোটর্সকে কার্যাদেশ দেওয়ার জন্য মতামত দিয়ে প্রশাসকের কাছে নথি পাঠায়। চারদিন পর ১৩ এপ্রিল প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বিপিপিএ ওয়েব সাইটে দরপত্র প্রকাশ না হওয়ার কথা বলে তা বাতিল করে দেন।
দরপত্র আহবান কমিটির প্রধান ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (বর্তমানে অর্থ বিভাগে বদলি হয়েছেন) মো. নুরুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমরা নিয়ম মেনে দরপত্র আহবান করেছি। এখন যেটা বলা হচ্ছে, বিপিপিএ’র ওয়েবসাইটে প্রকাশ না হওয়ায় এটা বাতিল। আমরা কিন্তু বিপিপিএ’র কাছে এই দরপত্র পাঠিয়েছি তাদের ওয়েবসাইটে প্রচার করার জন্য। সেই কথা আমাদের বিজ্ঞপ্তির নীচে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু তারা ক্রয় সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া হাট ইজারার দরপত্র প্রচার করে না বলে ফেরত পাঠিয়েছে। এভাবেই গত ১২ বছর ধরে হাটগুলো ইজারা দেওয়া হচ্ছে। যে অজুহাতে এটা বাতিল করা হয়েছে, সেটা খোঁড়া অজুহাত। এর পেছনে ‘অন্য উদ্দেশ্য’ থাকতে পারে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে বড় বড় কর্মকর্তারা আছেন, তিনজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আছেন, তারাও কি বিষয়টি বোঝেন না? তা তো নয়। তারা নিশ্চয় জেনে-বুঝে সুপারিশ করেছেন। আমি বলতে পারি, আমরা নিয়মের বাইরে কোনো কিছু করিনি।”

ডিএনসিসি কার্যালয়ে দুদকের অভিযান

দুদকের সহকারি পরিচালক মো. আব্দুল মালেক ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, “গাবতলী পশুর হাটের ইজারা নিয়ে একটা টেলিভিশনে রিপোর্ট আমরা দেখতে পাই। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে কমিশন বিষয়টি অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নেয়। ডিএনসিসিতে গিয়ে আমরা প্রাথমিক অনুসন্ধান করেছি। এরপর সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে একটা রিপোর্ট প্রস্তুত করা হবে। সেই রিপোর্ট কমিশনে দাখিল করার পর কমিশন পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে।”
অভিযানের পর দুদকের পক্ষ থেকে সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তি বলা হয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক গাবতলী গরুর হাট ইজারা প্রদানে অনিয়মের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় রাজস্বের ক্ষতিসাধনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধান কার্যালয়, ঢাকা থেকে একটি এনফোর্সমেন্ট টিম ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে অভিযান চালায়। অভিযানে সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের বক্তব্য গ্রহণ করা হয় এবং দরপত্র সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়।
অভিযানকারী টিম জানতে পারে, ২০২৫ সালের হাট ইজারায় সর্বোচ্চ দর ছিল প্রায় ২২ কোটি টাকা, যা সরকার নির্ধারিত দর ১৪.৬১ কোটির চেয়ে অনেক বেশি। মূল্যায়ন কমিটি সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা দেওয়ার সুপারিশ করলেও তা বাতিল করে খাস আদায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার যুক্তি হিসেবে সিপিটিইউ ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি না দেওয়ার কারণ দেখানো হয়। তবে হাট ইজারা সরকারি ক্রয় নীতিমালার আওতায় পড়ে না এবং এ ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার বাধ্যবাধকতাও নেই মর্মে অভিযানকালে টিম বিশেষজ্ঞ মতামত পায়।

প্রাথমিক পর্যালোচনায় অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাবতলী গরুর হাট ইজারা না দিয়ে বড় অঙ্কের সরকারি আয় হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে মর্মে টিমের নিকট প্রতীয়মান হয়। এনফোর্সমেন্ট টিম কর্তৃক প্রাথমিক সত্যতা প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে এ অভিযোগের বিষয়ে পরবর্তী করণীয় প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত চেয়ে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবে অভিযান পরিচালনাকারী টিম।

বিপিপিইউ নিয়ে যা জানা গেল

বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ), যেটা আগের নাম ছিল সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ)। সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়গুলো এদের ওয়েবসাইটে প্রচার করতে হয়। কিন্তু গাবতলী পশুর হাটের ইজারার ক্ষেত্রে সেটার প্রতিপালন করা হয়নি। গত ১০-১২ বছর ধরে সিপিটিইউ হাট ইজারার দরপত্রগুলো ওয়েবসাইটে প্রকাশ করছে না। সিপিটিইউ’র বক্তব্য- হাট ইজারা তো ক্রয় সংক্রান্ত কিছু না, ফলে. হাট ইজারার দরপত্র এখানে প্রকাশ করার দরকার নেই। এভাবেই এতদিন এই প্রক্রিয়া চলছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সরকারি কাজে মুখের কথার কোনো মূল্য নেই। আইনে আছে সিপিটিইউ’র ওয়েবসাইটে দরপত্র প্রচার হতে হবে। ফলে, সিপিটিইউ যদি প্রচার না করে, তাহলে তাদের লিখিতভাবে জানাতে হবে কেন তারা এটা প্রচার করছে না। আর সেই লিখিত বক্তব্য না থাকলে দরপত্র প্রক্রিয়া অবৈধ হবে। সরকারি কাজে এই বিষয়গুলো অবশ্যই অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। এখন কথা হচ্ছে, গত ১০-১২ বছরে তো লাগেনি৷ এতদিন লাগেনি বলে যে এখন লাগবে না এ কথা কেউ বলতে পারবেন না। যেটা নিয়ম, সব সময় সেটা মেনে চলাই সব কর্মকর্তার জন্য উত্তম।”

প্রশাসকের আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা

ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এখানে অবশ্যই প্রক্রিয়াগত ভুল হয়েছে। কেন সিপিটিইউ’র ওয়েবসাইটে এটা যাইনি। এই কারণে দরপত্র বাতিল করা হয়েছে। আমার প্রশ্ন, আমার সামনে নথি আসার আগে দু’টি কমিটি পার হয়ে এসেছে। একটি দরপত্র কমিটি এবং অন্যটি মূল্যায়ন কমিটি। তারা কেন বিষয়টি দেখলো না? এটা কি তাদের অগোচরে ভুল হয়েছে, নাকি ইচ্ছাকৃত সেটা তদন্তের জন্য আমি একটা কমিটি করেছি। আর দুদক যে এসেছে, অবশ্যই তারা তদন্ত করবে। যাদের কারণে এটা হয়েছে, সেগুলো তদন্তের বের হবে।”
চৈত্র মাসের শেষে এই প্রক্রিয়াগুলো শেষ হওয়ার কথা। বৈশাখ মাসের শুরুতে নতুন করে হাট থেকে হাসিল আদায়ের প্রথা চালু রয়েছে উল্লেখ করে প্রশাসক বলেন, “যেহেতু হাতে সময় নেই, তাই আমরা নিজেরাই হাসিল আদায় শুরু করেছি। কয়েকদিন এভাবে চলুক, দেখি কী পরিমাণ হাসিল আদায় হয়। যদি দেখি ভালো হচ্ছে, তাহলে আমরা নিজেরাই করবো। আর যদি দেখি কম হচ্ছে, তাহলে মন্ত্রণালয় থেকে মতামত নিয়ে নতুন টেন্ডার আহবান করবো।” পছন্দের ঠিকাদার কাজ না পাওয়ার কারণে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার অভিযোগ সম্পর্কে প্রশাসক বলেন, “আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ আমার নেই।”
প্রসঙ্গত, এর আগে গাবতলী হাটের ইজারাদার ছিলেন চলচ্চিত্র প্রয়োজক ও অভিনেতা মনোয়ার হোসেন ডিপজল। নিয়ম অনুযায়ী বাংলা বছরের শেষ দিন ১৩ এপ্রিল রাতে হাট বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি চিঠি দিয়েছিলেন। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের দাবি- আগের ইজারদার হাট ‘বুঝিয়ে না দিয়ে’ চলে গেছেন।

DW বাংলা