ইউএনবি থেকে অনূদিত
সারাংশ
- দেশের শিক্ষিত বেকারত্বের ক্রমবর্ধমান হারের সঙ্গে একটি উদ্বেগজনক দ্বৈত সংকট তৈরি করেছে
- উচ্চশিক্ষিত তরুণরা দেশে উপযুক্ত কাজের সুযোগ পাচ্ছে না এবং বিদেশ থেকে ফিরে আসা স্নাতকদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো কঠিন হয়ে পড়ছে
- বিসিএসের পদের তুলনায় আবেদনকারীর বিশাল সংখ্যা শিক্ষিত বেকারত্বের একটি বড় কারণ
- বর্তমানে রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলেও, বিদেশে যাওয়া কর্মীদের ধরনে পরিবর্তন এসেছে
পরিসংখ্যানে উদ্বেগ
ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, উচ্চশিক্ষার ও উন্নত জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষায় গত ১৫ বছরে বিদেশে পড়াশোনা করতে যাওয়া বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের জরিপ বলছে, একই সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষিত বেকারত্বের হার প্রায় ১০% বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দ্বৈত সংকট অনেকেই মনে করেন, জীবনের মূল উদ্দেশ্যই হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশ ত্যাগ করা।
কাজের বাজার ও শিক্ষিত বেকারত্ব
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ৪৬–তম বিসিএস পরীক্ষার জন্য আবেদনকারী ৩২৫,৬০৮ জন, অথচ শুক্লার নম্বর মাত্র ৩,১৪০। এই বিশাল ব্যবধানই শিক্ষিত বেকারত্ব বাড়াচ্ছে। ঢাকার ইস্ট–ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আয়াজ বিন ফারুক বলেন, “বাংলাদেশি ছাত্রদের সামনে সাধারণত তিনটাই অপশন—বিসিএসের প্রস্তুতি, ব্যাংকিং ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি বা আইইএলটিএস দিয়ে বিদেশে যাওয়া।”
প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা: বিসিএস, ব্যাংকিং পরীক্ষা ও বিদেশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র সাফিউর রহমান যোগ করেন, “প্রতি সকালেই কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে তরুণেরা বিসিএসের প্রস্তুতি নেয়। কেউ কেউ প্রথম বর্ষ থেকেই এ প্রস্তুতি শুরু করে। বিসিএস যেন সোনার হরিণ, তবুও অনেকের কাছে বিদেশই বাস্তবসম্মত পথ।”
নারী শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব ও নিরাপত্তা
উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা নারী শিক্ষার্থীরা কাজের ক্ষেত্রে এখনও বৈষম্যের শিকার। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন ছাত্রী ফাতেমা জাহান ইকু লন্ডনে স্থানান্তরিত হয়ে বলেন, “বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীসুরক্ষা ও সামাজিক মর্যাদা অপ্রতুল, অন্যদিকে বিদেশে নিরাপত্তা ও সামাজিক স্বস্তি বেশি।” এসব কারণে বহু নারী বিদেশে পড়াশোনা বা চাকরির দিকে ঝুঁকছেন।
প্রতিষ্ঠানগত প্রতিবন্ধকতা ও দক্ষতার মূল্যায়ন
বাংলাদেশ বুরো অব এডুকেশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকস (বিএনবিএইএস) জানিয়েছে, প্রতি বছর প্রায় এক মিলিয়ন তরুণ স্নাতক পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়। তবুও দেশীয়ভাবে এসব দক্ষতা কাজে লাগানোর কোনো সুসংগঠিত নীতিমালা নেই। হিউস্টনের ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নূরুল ইসলাম মন্তব্য করেছেন, “উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা দেশের চাকরির বাজারে যোগ্যতা পাওয়ার মতো সুযোগ পাচ্ছে না। বিদেশে পড়ালেখা শেষ করে ফিরলেও উপযুক্ত কাজ নেই; এরকম পরিস্থিতিতে ‘রিভার্স ব্রেন বিডি’ সাফল্য পাবে না।”
দক্ষতার তুলনায় অভিজ্ঞতার প্রাধান্য
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অনুযায়ী, বেকারদের ১২% বেক্তির কমপক্ষে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আছে; অন্যদিকে শিক্ষাহীনদের বেকারত্বের হার কম। তাই উচ্চশিক্ষিতদের জন্য কাজের অভাবই বড় প্রতিবন্ধকতা। অন্যদিকে কর্মরতরা খুশি নয় তাদের বেতন ও সুবিধা নিয়ে। কর্পোরেট কর্মচারী ফয়সাল রিমন বলেন, “অন্যান্য দেশে নতুন কর্মসংস্কৃতি গড়ে উঠছে, আমরা কিন্তু পুরানো নিয়মে আটকে আছি। শ্রম আইন তোয়াক্কা হয় না, প্রসারিত বেতন-সুবিধা না থাকায় তরুণরা অধিকার রক্ষায় অনীহা।”
বিদেশে যাওয়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ছাত্র শফায়াত আল রাযী জানান, “বাংলাদেশে ২৫ বছরের বেশি বয়সে চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে পড়াশোনা শেষ করি; কিন্তু এখানে এসেই পার্ট-টাইম কাজ করে বছরে $৫০,০০০–$৬০,০০০ ইনকাম করছি। খরচ মেটানোর পরও দেশে টাকা পাঠাতে পারি, যা দেশে থাকলে সম্ভব হত না।”
উচ্চশিক্ষা ও অভিবাসনের ধারা
ইউনেস্কো অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ৫২,৮০০ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়েছে; ২০০৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ১৬,৮০৯। ২০২৪ সালের ‘ওপেন ডোরস’ রিপোর্ট বলছে, গত বছরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছে ১৭,০০০ জন—সর্বোচ্চ সংখ্যা, যা আগের বছরের তুলনায় ২৬% বৃদ্ধি। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের গবেষক ড. নুসরাত জাহান চৌধুরী বলেন, “উন্নত জীবনমান ও সামাজিক নিরাপত্তার পাশাপাশি দেশে বিদেশে শেখা দক্ষতা কাজে লাগার সুযোগ নেই; যারা ফেরেন, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক বাধার কারণে অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেন না।”
নীতি প্রণয়নের তাগিদ
জার্মানি ভিত্তিক ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশন (ডি+সি)’ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৮০–এর দশক থেকে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় উৎস রেমিট্যান্স; কিন্তু এখন প্রস্থানের স্বরূপ বদলেছে—এক যুগ পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যে যেত যা কম দক্ষ শ্রমের জন্য, আজকের তরুণেরা পশ্চিমের দিকে যাচ্ছে উচ্চদক্ষতার সুযোগের খোঁজে। রিপোর্টে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, রেমিট্যান্স ভরসা না রেখে এই মস্তিষ্কসম্পদ কাজে লাগানোর জন্য নীতি প্রণয়ন এবং মানবসম্পদ বিনিয়োগের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।