সারাক্ষণ রিপোর্ট
ঘরোয়া সহিংসতা শুধু ব্যক্তি বা পরিবারকে নয়, পুরো সমাজ ও জাতির সুস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের পথে বড় বাধা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুসারে, গড়ে প্রতি তিনজন মহিলার মধ্যে একজন জীবনের কোনো পর্যায়ে পক্ষে সহিংসতার শিকার হন। বাংলাদেশেও এই মনস্তাত্ত্বিক ও শারীরিক আঘাত বহুমুখী চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
পরিসংখ্যান: বর্তমান অবস্থা
- BDHS ২০১৪/১৫: বিবাহিত নারীদের ৪৪% শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার
- জাতীয় মহিলা কমিশন, ২০২৩: বছরে ১২ হাজারের বেশি নারী ও শিশু নির্যাতন অভিযোগ
- পুলিশ রিপোর্ট, ২০২৪: ৯২০০টি ঘরোয়া সহিংসতার মামলা; এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতন ৬৮%, মানসিক নির্যাতন ২৫%, যৌন নির্যাতন ৭%
- অফ-রেকর্ড: স্থানীয় এনজিওর ধারণা, প্রতি তিনটি হয়রানির মধ্যে দুইটি মামলা পুলিশে যায় না
সহিংসতার ধরন ও বহুমাত্রিক প্রভাব
- শারীরিক নির্যাতন: থাপ্পর, ধাক্কা, বোঁচকা
- মানসিক নির্যাতন: অপমান, হুমকি, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা
- যৌন নির্যাতন: অনৈচ্ছিক যৌন সহবাস, যৌন হেনস্থা
- আর্থিক নিয়ন্ত্রণ: বৈধভাবে টাকা দেওয়া বঞ্চনা, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অনধিকার প্রবেশ
- ডিজিটাল নির্যাতন: মোবাইল ট্র্যাকিং, চ্যাট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে হয়রানি
স্বাস্থ্যগত ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া
ঘরোয়া সহিংসতা ক্রমশ দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করে। প্রফেসর ডঃ মোহাম্মদ মাহমুদুল হক, বিভাগীয় প্রধান, ফিজিওলজি, BSMMU, বলেন, “নির্যাতনজনিত স্ট্রেসে দেহে কর্টিসলের মাত্রা দীর্ঘ সময় উচ্চ থাকে। এতে ব্লাড প্রেসার বাড়ে, হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়, মেটাবলিক সিনড্রোম ও হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। দ্রুত ও সমন্বিত চিকিৎসা-পরামর্শ না হলে শারীরিক পুনর্বাসন দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা বয়ে আনতে পারে।”
৫. মানসিক স্বাস্থ্যের দিকনির্দেশনা
নির্যাতিতারা প্রায়ই বিষণ্নতা, উদ্বেগ, PTSD (পোস্ট-ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার) ভুগছেন। দেশে কাউন্সেলিং সেবা অপ্রতুল।
- সাইকোথেরাপি সেশন: এনজিও ও কিছু বেসরকারি ক্লিনিকে বিনামূল্যে সাইকোথেরাপি হচ্ছে।
- গ্রুপ থেরাপি: সমবেদনায় বিকল্প শক্তি গড়ে তোলে, আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে।
- বিশেষজ্ঞ নির্দেশনা: ডাঃ নাসরীন আক্তার, মনোবিজ্ঞানী, মনে করেন, “নির্যাতিতার পুনর্বাসন শুধু ফিজিক্যাল নয়, মানসিক সুরক্ষার ওপর ভিত্তি করে।”
. আইনি কাঠামো ও সেবা পরিসর
- ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০: সুরক্ষা আদেশ, জরুরি আশ্রয় ভূমিকা নির্ধারণ
- সামাজিক কল্যাণ অধিদপ্তর: ১০৯৮৫ হটলাইন ও ২০টি আশ্রয়কেন্দ্র
- নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়: প্রশিক্ষণ, পুনর্বাসন প্রকল্প
- বেসরকারি সংস্থা: ব্র্যাক, Nijera Kori ও COAST ট্রাস্টের পুনর্বাসন ও আইনি সহায়তা কার্যক্রম
সমন্বিত প্রতিকারকৌশল
দ্রুত হস্তক্ষেপ ও সামঞ্জস্যতা
-
- পুলিশের স্পেশাল ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ইউনিটের ২৪/৭ টিম
- স্থানীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ ও এনজিওর সমন্বিত টিম মিটিং
সচেতনতা বৃদ্ধি
-
- স্কুল-কলেজ, গণমাধ্যমে নিয়মিত ক্যাম্পেইন
- গ্রামীণ এলাকায় সামাজিক ধর্মীয় নেতাদের অংশগ্রহণ
প্রতিরোধমূলক প্রশিক্ষণ
-
- আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সমাজসেবক ও স্বেচ্ছাসেবকদের রেগুলার ওয়ার্কশপ
- রাগ নিয়ন্ত্রণ, সহানুভূতিশীল যোগাযোগ প্রশিক্ষণ
প্রযুক্তি নির্ভর নিরাপত্তা
-
- GPS ট্র্যাকিং, জরুরি সতর্কতা অ্যাপ
- ইলেকট্রনিক মনিটরিং স্ক্রিপ্ট সহ সিস্টেম
বিশেষায়িত সেবা
-
- শিশু, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী নির্যাতিতাদের জন্য আলাদা ইউনিট
- মানসিক ও শারীরিক পুনর্বাসন কেন্দ্রে সমন্বিত প্রোগ্রাম
চ্যালেঞ্জ ও মৌলিক প্রতিবন্ধকতা
- সামাজিক কলঙ্ক: নির্যাতিতারা প্রতিবেদন করতে ভয় পান
- সম্পদের অভাব: আশ্রয়কেন্দ্র কম, দক্ষ কনসেলর কম
- আইন প্রয়োগের ফাঁকফোকর: পুলিশের অভিযোগ গ্রহণে অনীহা, প্রমাণ সংগ্রহের জটিলতা
- পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব: ‘ঘরের ভেতরে সমস্যা’ বিবেচনায় অপরাধ হালকা গণ্য
সফল নজির ও উদাহরণ
- COAST ট্রাস্ট: ৫০টি গ্রামে তৈরি করেছে সেফ হোম, যেখানে ৬০০+ নির্যাতিতার সেবা হয়েছে
- ব্র্যাক: কমিউনিটি সাপোর্ট সিস্টেম চালু করে ২৫% রিপোর্টিং বৃদ্ধিতে সহায়ক
- লোকাল কারিগরি উদ্যোগ: নারী উদ্যোক্তা গোষ্ঠী সহায়তা করে আর্থিকভাবে স্বাধীন হওয়ায় নির্যাতনের ঝুঁকি কমেছে
সুপারিশ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
- কেন্দ্রীয় বাজেট বৃদ্ধি: হটলাইন, আশ্রয়কেন্দ্র ও কাউন্সেলিং সেবায় বরাদ্দ বাড়ানো
- আইন প্রবিধান কঠোরকরণ: দমনকারী পতিবন্ধীতে দীর্ঘমেয়াদী কারাদন্ড ও মনিটরিং বাধ্যতামূলক
- দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা: মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও এনজিও মিলে জাতীয় ইনডেক্স গঠন
- দৈনিক মনিটরিং সিস্টেম: পুলিশ স্টেশন ও ভয়েস অফ ভিক্টিম প্ল্যাটফর্মে রিপোর্ট অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নথিভুক্তি
সরকার ও সমাজে অজানা কিছু দিকসমূহ
নিম্নলিখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে সরকার ও সমাজে ব্যাপকভাবে অবহেলা বা অজানা রয়ে গেছে, যা ঘরোয়া সহিংসতা প্রতিরোধে বড় বাধা সৃষ্টি করে:
- পুরুষ ও অন্যান্য লিঙ্গের শিকারীরা
অধিকাংশই মনে করেন নির্যাতন শুধুমাত্র নারীর সমস্যা; পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গের নির্যাতিতারা কথা বলতে ভয় পান এবং পুলিশ/সেবা কেন্দ্রে অভিযোগ নথিভুক্ত হয় না। - ডিজিটাল ও প্রযুক্তিনির্ভর নির্যাতন
মোবাইল স্পায়ারওয়্যার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানি ও গোপন তথ্য ফাঁস—এগুলো সহিংসতার অন্তর্ভুক্ত হলেও সচেতনতা খুবই কম। - বিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্রে শিশু ও কিশোর প্রভাব
গৃহে সহিংস পরিস্থিতি স্কুল-কলেজে মনোযোগের ঘাটতি, আচরণগত সমস্যা ও মানসিক বিষণ্নতা সৃষ্টি করে; অথচ এ বিষয়ে কোনো সমন্বিত জরিপ বা হস্তক্ষেপ নেই। - গ্রামীণ অঞ্চলের তথ্য ঘাটতি
পুলিশ স্ট্যাটিস্টিক্সে ঊর্ধ্বমুখী ঢাকার পরিসংখ্যান থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে রিপোর্টিং প্রায় নেই বললেই চলে।
- আর্থ-সামাজিক ক্ষতির পরিমাপের অভাব
সহিংসতার ফলে জন্ম নেওয়া স্বাস্থ্য ব্যয়, কর্মদক্ষতা কমে যাওয়া, আইনগত খরচ—এসবের আর্থিক পরিমাণ কখনো গণনা করা হয় না। - টেকসই পুনর্বাসনের অভাব
কাউন্সেলিং বা সাময়িক আশ্রয় দেওয়ার পর দীর্ঘমেয়াদী মনস্তাত্ত্বিক বা আর্থিক সহায়তার যেকোনো স্থায়ী পরিকল্পনা অনুপস্থিত। - আইনের ব্যবস্থাপনায় অমিল
পুলিশ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সামাজিক কল্যাণ বিভাগ ও আদালতের মধ্যে সমন্বয় কম– এক গৃহবধূ আশ্রয় কেন্দ্র চলে গেলেও আইনগত প্রক্রিয়া থমকে যেতে পারে। - লিঙ্গগত মনোভাব ও সামাজিক কলঙ্ক
“ঘরের মধ্যে সমস্যা” ধারণা যেভাবে প্রচলিত, সমাজে এটা ভাঁওতাবাজি বা বিনোদনের বিষয় বলে ভুল বোঝাপড়া আছে। - গভীর ট্রমা সম্পর্কিত গবেষণার অভাব
নির্যাতনগ্রস্তদের দীর্ঘমেয়াদি স্নায়ুবিজ্ঞানগত পরিবর্তন (neurobiology) বা মস্তিষ্কের কাঠামোগত ক্ষতি পর্যবেক্ষণের কোনো স্থানীয় গবেষণা নেই। - কর্মক্ষেত্রে কর্পোরেট অজান্ত:
প্রাইভেট সেক্টরে নির্যাতনের অবশিষ্ট প্রভাব (mental leave, productivity loss) বিবেচনা হয় না; HR নীতি বা কর্মস্থলে সাপোর্ট সিস্টেম নেই।
এই অজানা বা অবহেলিত বিষয়গুলো যদি সরকারী নীতি, সামাজিক সংস্কার ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাধান করা যায়, তবে ঘরোয়া সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই আরও কার্যকর হবে।