মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ০৯:৫৩ অপরাহ্ন
শিরোনাম :

যদি ইন্ডাস শুকায়, পাকিস্তানের মানুষও শেষ

  • Update Time : শুক্রবার, ২ মে, ২০২৫, ৭.০৫ পিএম

রিফফাত ইনাম বাট

যখন হিমালয়ের হিমবাহগুলো পিছু হটছে এবং তাপমাত্রা বাড়ছেতখন দক্ষিণ এশিয়ার নদীগুলো হয়ে উঠছে শুধু জীবনধারার উৎস নয়বরং বেঁচে থাকার অস্ত্র। এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হয়েছে ইন্ডাস নদী ঘিরেযেখানে ১৯৬০ সালের ইন্ডাস পানি চুক্তিযা একসময় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তিক্ত বিরোধ সত্ত্বেও একটি যুগান্তকারী সহযোগিতার নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হতোতা এখন দ্রুত উষ্ণায়নের বিশ্বে সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি।

এই সংকটের মোড় ঘুরেছে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে। জম্মু ও কাশ্মীরে একটি সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে হঠাৎ করে চুক্তিতে অংশগ্রহণ স্থগিত করেগুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিনিময় বন্ধ করে দেয় এবং নদীর উজানে আরও নিয়ন্ত্রণ আরোপের হুঁশিয়ারি দেয়। গত কয়েক বছরে পাকিস্তানের পাঞ্জাব অঞ্চলের গ্রামগুলোতেতারিক মাহমুদের মতো কৃষকেরা অসহায়ের মতো চেয়ে দেখেছেনচেনাব নদীর পানি ক্রমেই কমে আসছে।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বৈরিতার পরিপ্রেক্ষিতে পানির বিষয়টি আগে হয়তো পেছনে পড়ে ছিলকিন্তু এখন তা সামনের সারিতে উঠে এসেছে। পাকিস্তানের জন্য বিষয়টি অস্তিত্বেরপানীয় জলকৃষিকাজ ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলোর ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা ও উজানে ভারতের নিয়ন্ত্রণ কঠোর হওয়ার প্রেক্ষিতে একটি প্রশ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে: শক্তিশালী উজান দেশের মুখোমুখি হয়ে কি একটি দুর্বল নিম্ন অববাহিকার দেশ টিকে থাকতে পারে?

Trust dismantled, withdrawal is justified': Top geostrategist says India right to suspend Indus Water Treaty - 'Trust dismantled, withdrawal is justified': Top geostrategist says India right to suspend Indus Water Treaty BusinessToday

১৯৪৭ সালের বিভক্তির পর হিংসাত্মক পানিসংক্রান্ত বিরোধের প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত ইন্ডাস পানি চুক্তির মাধ্যমে ইন্ডাসঝেলম ও চেনাব নদী বরাদ্দ দেওয়া হয় পাকিস্তানকেআর রবিবিয়াস ও শতদ্রু থাকে ভারতের অধীনে। তবে সমালোচকেরা বলছেনচুক্তির সুরক্ষা ব্যবস্থা আজ ভেঙে পড়ছে। কিশনগঙ্গা ও বাঘলিহার বাঁধের মতো প্রকল্পগুলোযেগুলোর নির্মাণে কঠোর শর্ত ছিলসেগুলো নিচু অঞ্চলে পানির প্রবাহ হ্রাস করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা যুক্ত হয়ে পুরো অঞ্চলজুড়ে পানির প্রাপ্যতা আরও কমিয়ে দিচ্ছে।

আইনি লড়াইটি জটিল। ভারত বলছেতাদের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো চুক্তির অধিকার অনুযায়ী বৈধ। অন্যদিকে পাকিস্তানের কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক সালিশি ব্যবস্থার দ্বারস্থ হওয়ার চেষ্টা করছেনতাদের দাবিভারত চুক্তির মূল ভাবনাকে লঙ্ঘন করছে এবং পানি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

বিশ্বের অন্যান্য নিম্ন অববাহিকার দেশগুলোর অবস্থাও সতর্কবার্তার মতো। মধ্যপ্রাচ্য বহু দশক ধরে জর্ডান নদীর ন্যায্য ব্যবহার নিশ্চিত করতে চেষ্টা করে আসছেকিন্তু আন্তর্জাতিক আদালতআঞ্চলিক সংলাপ বা কূটনৈতিক প্রচেষ্টাগুলো খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। ইথিওপিয়ার গ্র্যান্ড রেনেসাঁস বাঁধ ঘিরে নীল নদ নিয়ে মিশরের লড়াইও দেখায়ঐতিহাসিক অধিকার রক্ষা উপরে অবস্থিত রাষ্ট্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সামনে কতটা কঠিন হয়ে পড়ে। তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে থাকা টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী নিয়ে ইরাক ও সিরিয়াও মুখোমুখি হয়েছে সংকটেঅর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও আঞ্চলিক জোটও এখানে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মেকং অববাহিকার দেশগুলোভিয়েতনামকম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডচীনের বাঁধ প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে পরিবেশবাদী কর্মকাণ্ডে জোর দেয়। আর বাংলাদেশ উপরের দিকে থাকা হুমকিগুলোর বিরুদ্ধে আঞ্চলিক কূটনীতি ও প্রযুক্তিগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে।

জাতিসংঘ: কীভাবে এবং কেন তৈরি করা হয়েছিলো এই বৈশ্বিক সংস্থাটি - BBC News বাংলা

পাকিস্তানের জন্য এই বার্তা স্পষ্ট: বেঁচে থাকতে হলে বহুস্তরবিশিষ্ট কৌশল নিতে হবে।প্রথমতইন্ডাস অববাহিকার সংকটকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলতে হবে। শুধু কারিগরি আলোচনার জন্য গঠিত পার্মানেন্ট ইন্ডাস কমিশন বর্তমান ভূরাজনৈতিক চাপ মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট নয়। ইসলামাবাদকে বিষয়টি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদে তুলতে হবে এবং বিশ্বব্যাংকের ভূমিকাকে কাজে লাগাতে হবে। আলোচনার ধারা শুধু দ্বিপাক্ষিক ক্ষোভে আটকে না রেখে বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট হিসেবে তুলে ধরতে হবে।

দ্বিতীয়তআইনি কৌশলও গুরুত্বপূর্ণশুধু রাজনৈতিক বয়ান গঠনে নয়বরং কারিগরি সমাধানের হাতিয়ার হিসেবেও। আফ্রিকান সংস্থাগুলোর কাছে মিশরের ধারাবাহিক আবেদন হয়তো ধীরে ফল দিয়েছেকিন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে নীল নদের ইস্যুকে টিকিয়ে রেখেছে। পাকিস্তানকে প্রতিটি চুক্তিভঙ্গির দলিল তৈরি করতে হবে এবং সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO), আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ও অন্যান্য বৈশ্বিক ফোরামে পরামর্শমূলক মতামত চাইতে হবেযাতে ভারতের আচরণকে আন্তর্জাতিক পানিসীমান্ত আইন ভঙ্গের নজির হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়।

তৃতীয়তপ্রযুক্তিগত সক্ষমতা গড়ে তোলা এখন অপরিহার্য। পানির খরায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পাকিস্তানকে নোনা পানি মিঠা করার প্রযুক্তিবৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা এবং ড্রিপ সেচে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি নতুন জলাধার নির্মাণ ও পানির দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারেযা ইন্ডাস অববাহিকার ঝুঁকি কমাবে এবং ভবিষ্যতের শোষণ থেকে রক্ষা দেবে।

চতুর্থতকৌশলগত জোট আরও বিস্তৃত ও ধারালো হতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব বৃদ্ধির বিষয়ে চিন্তিত চীনও চায় নদীগুলোর স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক। এমনকি বাংলাদেশযার ওপরেও উপরের দিকের পানি নীতি হুমকি হয়ে দেখা দেয়এক্ষেত্রে নীরব সমর্থক হতে পারে। আফগানিস্তানযেটি কাবুল নদীর মাধ্যমে ইন্ডাস অববাহিকার প্রায় ৮ শতাংশ শেয়ার করেসেটিও গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ। ইসলামাবাদকে কাবুলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ বাড়াতে হবেযাতে তারা ভারতের পানি নীতির ঘনিষ্ঠ অংশীদার না হয়ে ওঠে।

Panic in Pakistan as India vows to cut off water supply over Kashmir | Reuters

সবশেষে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলোপাকিস্তানকে জলবায়ু বিষয়ক যুক্তিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ভবিষ্যতের হুমকি নয়এটি ইতিমধ্যেই নদীর প্রবাহহিমবাহ ও বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে দিচ্ছে। ভারতের আচরণকে একটি দুর্বল বাস্তুসংস্থানের প্রতি মারাত্মক হুমকি হিসেবে তুলে ধরলেপাকিস্তান পরিবেশবাদী সংস্থাজলবায়ু কর্মী ও সহানুভূতিশীল রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন পেতে পারে। এই ইস্যুকে শুধু দ্বিপাক্ষিক বিরোধ নয়বরং জলবায়ু যুগে বৈশ্বিক জল নিরাপত্তার ধস হিসেবে তুলে ধরতে হবে।

এর প্রভাব শুধু পাকিস্তানের কৃষিক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। ইন্ডাসের পানির প্রবাহ কমে গেলে কৃষি ধ্বংস হবেলাখ লাখ মানুষ শহরে ঠেলে দেওয়া হবেখাদ্য সংকট তৈরি হবে এবং এমনিতেই উত্তেজনাপূর্ণ পরমাণু অঞ্চলে সীমান্ত সংঘাত বাড়বে। ইন্ডাস চুক্তির পতন শুধু কূটনৈতিক ব্যর্থতা হবে নাবরং এটি একটি মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নেবেযার প্রভাব বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে।

তারিক মাহমুদ এবং তার মতো অগণিত কৃষকের কাছে এই হুমকি এখন আর ভবিষ্যতের কিছু নয়এটা এখন শুকনো কূপঅনাবাদি জমি আর ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসা হতাশা। তিনি বললেন, “যদি নদী না থাকেআমরাও থাকব না।

ইন্ডাস পানি চুক্তি এই ধরনের বিপর্যয় ঠেকানোর জন্যই করা হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হলোক্রমবর্ধমান উষ্ণতাকঠোর জাতীয়তাবাদ এবং ভেঙে পড়া বিশ্বাসের মধ্যে এই চুক্তি কি এখনও রক্ষা করা সম্ভবএর জবাব শুধু ভারত ও পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নয়বরং একটি পুরো অঞ্চলের ভাগ্য নির্ধারণ করবেযেটি এখন দাঁড়িয়ে আছে খুবই ভঙ্গুর মাটিতে।

লেখক আন্তর্জাতিক আইনপানি কূটনীতি এবং আইন সংস্কার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। যোগাযোগ: rbutt.99@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024