০১:৫১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ: বাস্তবে রূপ নিচ্ছে প্রজন্ম Z-এর জন্য

  • Sarakhon Report
  • ০৫:৩৫:০৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ মে ২০২৫
  • 45

সারাক্ষণ রিপোর্ট

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রজন্ম Z-এর ক্রেতাদের কাছে চীনের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্যযুদ্ধ এখন আর শুধু সংবাদপত্রের শিরোনামে সীমাবদ্ধ নেই। ২৫ এপ্রিল জনপ্রিয় চীনা অনলাইন মার্কেটপ্লেস শেইন ও টেমু ঘোষণা করে যে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যের দাম সমন্বয় করবে। এর ফলে শেইন-এর কিছু পণ্যের মূল্য ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। টেমু “ইমপোর্ট চার্জ” যোগ করেছে, যা অনেক ক্ষেত্রে পণ্যের আসল দামের চেয়েও বেশি।

এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে ২ মে থেকে কার্যকর হওয়া ‘ডি মিনিমিস’ ছাড় বাতিল। আগে ৮০০ ডলারের নিচের প্যাকেটগুলোর ওপর আমদানি শুল্ক আরোপ করা হতো না। এই বিধিনিষেধের আওতায় গত বছর শেইন ও টেমুসহ চীনা কোম্পানিগুলো প্রায় ৫০০০ কোটি ডলারের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করেছে, যা দেশটির মোট চীনা রপ্তানির প্রায় ১১ শতাংশ।

নতুন নিয়মে ডাক বিভাগের মাধ্যমে পাঠানো এসব পণ্যে এখন ১২০ শতাংশ শুল্ক বা ১০০ ডলারের ফ্ল্যাট ফি (যা জুনে বেড়ে ২০০ ডলারে পৌঁছাবে) ধার্য হবে। অন্য মাধ্যমে পাঠানো পণ্যের ওপর শুল্ক হবে ১৪৫ শতাংশ।

টিকে থাকা কঠিন: মূল অস্ত্র ছিল অবিশ্বাস্যভাবে কম দাম

শেইন ও টেমুর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল অতি কম মূল্য। মাত্র ৩ ডলারে টি-শার্ট বা ৫ ডলারে ব্যাকপ্যাক বিক্রি করেই তারা বৈশ্বিক সাফল্য পায়। চীনা কারখানা থেকে সরাসরি পণ্য পাঠিয়ে তারা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও কাস্টমস শুল্ক এড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ছিল তাদের প্রধান বাজার—শেইনের মোট বিক্রির ৩০ শতাংশ ও টেমুর ৪০ শতাংশ এখান থেকেই আসত।

একসময় ছিল শীর্ষেএখন অনিশ্চয়তার মুখে

২০২২ সালে শেইনের মূল্যায়ন দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন ডলার এবং সে বছরই তারা এইচঅ্যান্ডএম ও জারাকে ছাড়িয়ে ফ্যাস্ট ফ্যাশনের শীর্ষ বিক্রেতা হয়ে ওঠে। একই বছর টেমু যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রা শুরু করে এবং “Shop Like a Billionaire” স্লোগানে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

কিন্তু এখন তারা ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রে। শেইন শুরুতে নিউইয়র্কে তালিকাভুক্তির চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত লন্ডনে আইপিওর অনুমোদন পায়। তবে তাদের মূল্য এখন নেমে এসেছে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারে এবং তালিকাভুক্তির সময় বা নিশ্চয়তা অনিশ্চিত।

নতুন বাজারে প্রবেশের চ্যালেঞ্জ

যুক্তরাষ্ট্রের বিক্রি হ্রাসের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা ইউরোপের যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও স্পেনে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। তবে এসব দেশও ছোট পার্সেলে শুল্ক ছাড় বাতিলের কথা ভাবছে। এশিয়ায় বিস্তার করাও সহজ নয়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ভিয়েতনামের নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের জাল পণ্য বিক্রির অভিযোগে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। টেমুর অ্যাপ ইন্দোনেশায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের রক্ষা করতে।

উৎপাদন সরানোও কঠিন

তাদের কম দামে দ্রুত পণ্য সরবরাহের সক্ষমতা নির্ভর করে চীনের দক্ষ সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর। বেশিরভাগ পণ্য আসে গুয়াংডং প্রদেশ থেকে, যেখানে শেইনের জন্য বিশেষভাবে পোশাক প্রস্তুতকারক ক্লাস্টার গড়ে উঠেছে। যদিও টেমু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মেক্সিকোতে সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান মর্নিংস্টার জানিয়েছে, বছরের শেষে তাদের কেবল ১৫ শতাংশ পণ্যই চীনের বাইরে থেকে আসবে।

মার্কিন বাজারে নতুন কৌশল

টেমু “লোকাল-টু-লোকাল” মডেল চালু করেছে—যেখানে মার্কিন ভিত্তিক কোম্পানি থেকে ক্রেতারা পণ্য কিনছে। কিন্তু এসব কোম্পানির বেশিরভাগই আসলে চীনা, যারা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। ফলে তারাও ট্রাম্পের নতুন শুল্কের আওতায় পড়বে।

প্রস্তুতি নিচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরেই

শেইন ও টেমু অনেক আগে থেকেই জানত, তাদের ব্যবসায়িক মডেলে বড় ঝাঁকুনি আসবে। শেনজেনের বাইরে তাদের একটি বড় প্ল্যান্ট, যেখানে পণ্য প্যাকিংয়ে স্বল্প অটোমেশনের ব্যবহার রয়েছে, কারণ মার্কিন রপ্তানি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে পারে—এই আশঙ্কা থেকেই এমন ব্যবস্থা।

চীনের পক্ষ থেকেও চাপ বাড়ছে

চীনের সরকার চাইছে না শেইন বা টেমু সরবরাহ চেইন বৈচিত্র্য আনুক। ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, বেইজিং সম্প্রতি শেইনকে অনুরোধ করেছে যেন তারা চীনের বাইরে উৎপাদন না বাড়ায়। এ নিয়ে গুজব ছড়ালে গুয়াংজোর স্থানীয় সরকার বিবৃতি দিয়ে জানায়, শেইনের মূল সরবরাহ এখনও সেখানেই রয়েছে।

ভবিষ্যৎ কোথায়?

চীনা সরকারের কাছে রয়েছে শক্ত প্রভাব। টেমুর মূল কোম্পানি পিডিডি এখনো চীনের ব্যবসা নির্ভর পিনডুওডুও-র ওপর। শেইন চীনে পণ্য না বিক্রি করলেও তাদের অ্যালগরিদম তৈরিতে চীনা প্রযুক্তিবিদের ওপর নির্ভর করে।

দু’টি কোম্পানিই চীনের সঙ্গে নিজেদের সংযোগ কম দেখাতে চায়। শেইন দাবি করে, তারা সিঙ্গাপুরভিত্তিক বৈশ্বিক কোম্পানি; টেমু নিজেকে আমেরিকান বলে, যার প্রধান কার্যালয় বোস্টনে। তবে বাস্তবে, সরবরাহ চেইনের জন্য তারা চীনের ওপর এবং বিক্রির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই নির্ভরশীল।

টিকে থাকতে হলে তাদের আরও বৈশ্বিক হতে হবে। ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ হয়তো শেষ পর্যন্ত তাদের প্রকৃত আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে রূপান্তর করতে বাধ্য করবে।

মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ: বাস্তবে রূপ নিচ্ছে প্রজন্ম Z-এর জন্য

০৫:৩৫:০৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ মে ২০২৫

সারাক্ষণ রিপোর্ট

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রজন্ম Z-এর ক্রেতাদের কাছে চীনের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্যযুদ্ধ এখন আর শুধু সংবাদপত্রের শিরোনামে সীমাবদ্ধ নেই। ২৫ এপ্রিল জনপ্রিয় চীনা অনলাইন মার্কেটপ্লেস শেইন ও টেমু ঘোষণা করে যে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যের দাম সমন্বয় করবে। এর ফলে শেইন-এর কিছু পণ্যের মূল্য ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। টেমু “ইমপোর্ট চার্জ” যোগ করেছে, যা অনেক ক্ষেত্রে পণ্যের আসল দামের চেয়েও বেশি।

এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে ২ মে থেকে কার্যকর হওয়া ‘ডি মিনিমিস’ ছাড় বাতিল। আগে ৮০০ ডলারের নিচের প্যাকেটগুলোর ওপর আমদানি শুল্ক আরোপ করা হতো না। এই বিধিনিষেধের আওতায় গত বছর শেইন ও টেমুসহ চীনা কোম্পানিগুলো প্রায় ৫০০০ কোটি ডলারের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করেছে, যা দেশটির মোট চীনা রপ্তানির প্রায় ১১ শতাংশ।

নতুন নিয়মে ডাক বিভাগের মাধ্যমে পাঠানো এসব পণ্যে এখন ১২০ শতাংশ শুল্ক বা ১০০ ডলারের ফ্ল্যাট ফি (যা জুনে বেড়ে ২০০ ডলারে পৌঁছাবে) ধার্য হবে। অন্য মাধ্যমে পাঠানো পণ্যের ওপর শুল্ক হবে ১৪৫ শতাংশ।

টিকে থাকা কঠিন: মূল অস্ত্র ছিল অবিশ্বাস্যভাবে কম দাম

শেইন ও টেমুর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল অতি কম মূল্য। মাত্র ৩ ডলারে টি-শার্ট বা ৫ ডলারে ব্যাকপ্যাক বিক্রি করেই তারা বৈশ্বিক সাফল্য পায়। চীনা কারখানা থেকে সরাসরি পণ্য পাঠিয়ে তারা আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও কাস্টমস শুল্ক এড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ছিল তাদের প্রধান বাজার—শেইনের মোট বিক্রির ৩০ শতাংশ ও টেমুর ৪০ শতাংশ এখান থেকেই আসত।

একসময় ছিল শীর্ষেএখন অনিশ্চয়তার মুখে

২০২২ সালে শেইনের মূল্যায়ন দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন ডলার এবং সে বছরই তারা এইচঅ্যান্ডএম ও জারাকে ছাড়িয়ে ফ্যাস্ট ফ্যাশনের শীর্ষ বিক্রেতা হয়ে ওঠে। একই বছর টেমু যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রা শুরু করে এবং “Shop Like a Billionaire” স্লোগানে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

কিন্তু এখন তারা ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রে। শেইন শুরুতে নিউইয়র্কে তালিকাভুক্তির চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত লন্ডনে আইপিওর অনুমোদন পায়। তবে তাদের মূল্য এখন নেমে এসেছে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারে এবং তালিকাভুক্তির সময় বা নিশ্চয়তা অনিশ্চিত।

নতুন বাজারে প্রবেশের চ্যালেঞ্জ

যুক্তরাষ্ট্রের বিক্রি হ্রাসের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা ইউরোপের যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও স্পেনে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। তবে এসব দেশও ছোট পার্সেলে শুল্ক ছাড় বাতিলের কথা ভাবছে। এশিয়ায় বিস্তার করাও সহজ নয়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ভিয়েতনামের নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের জাল পণ্য বিক্রির অভিযোগে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। টেমুর অ্যাপ ইন্দোনেশায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের রক্ষা করতে।

উৎপাদন সরানোও কঠিন

তাদের কম দামে দ্রুত পণ্য সরবরাহের সক্ষমতা নির্ভর করে চীনের দক্ষ সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর। বেশিরভাগ পণ্য আসে গুয়াংডং প্রদেশ থেকে, যেখানে শেইনের জন্য বিশেষভাবে পোশাক প্রস্তুতকারক ক্লাস্টার গড়ে উঠেছে। যদিও টেমু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মেক্সিকোতে সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান মর্নিংস্টার জানিয়েছে, বছরের শেষে তাদের কেবল ১৫ শতাংশ পণ্যই চীনের বাইরে থেকে আসবে।

মার্কিন বাজারে নতুন কৌশল

টেমু “লোকাল-টু-লোকাল” মডেল চালু করেছে—যেখানে মার্কিন ভিত্তিক কোম্পানি থেকে ক্রেতারা পণ্য কিনছে। কিন্তু এসব কোম্পানির বেশিরভাগই আসলে চীনা, যারা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। ফলে তারাও ট্রাম্পের নতুন শুল্কের আওতায় পড়বে।

প্রস্তুতি নিচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরেই

শেইন ও টেমু অনেক আগে থেকেই জানত, তাদের ব্যবসায়িক মডেলে বড় ঝাঁকুনি আসবে। শেনজেনের বাইরে তাদের একটি বড় প্ল্যান্ট, যেখানে পণ্য প্যাকিংয়ে স্বল্প অটোমেশনের ব্যবহার রয়েছে, কারণ মার্কিন রপ্তানি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে পারে—এই আশঙ্কা থেকেই এমন ব্যবস্থা।

চীনের পক্ষ থেকেও চাপ বাড়ছে

চীনের সরকার চাইছে না শেইন বা টেমু সরবরাহ চেইন বৈচিত্র্য আনুক। ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, বেইজিং সম্প্রতি শেইনকে অনুরোধ করেছে যেন তারা চীনের বাইরে উৎপাদন না বাড়ায়। এ নিয়ে গুজব ছড়ালে গুয়াংজোর স্থানীয় সরকার বিবৃতি দিয়ে জানায়, শেইনের মূল সরবরাহ এখনও সেখানেই রয়েছে।

ভবিষ্যৎ কোথায়?

চীনা সরকারের কাছে রয়েছে শক্ত প্রভাব। টেমুর মূল কোম্পানি পিডিডি এখনো চীনের ব্যবসা নির্ভর পিনডুওডুও-র ওপর। শেইন চীনে পণ্য না বিক্রি করলেও তাদের অ্যালগরিদম তৈরিতে চীনা প্রযুক্তিবিদের ওপর নির্ভর করে।

দু’টি কোম্পানিই চীনের সঙ্গে নিজেদের সংযোগ কম দেখাতে চায়। শেইন দাবি করে, তারা সিঙ্গাপুরভিত্তিক বৈশ্বিক কোম্পানি; টেমু নিজেকে আমেরিকান বলে, যার প্রধান কার্যালয় বোস্টনে। তবে বাস্তবে, সরবরাহ চেইনের জন্য তারা চীনের ওপর এবং বিক্রির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই নির্ভরশীল।

টিকে থাকতে হলে তাদের আরও বৈশ্বিক হতে হবে। ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ হয়তো শেষ পর্যন্ত তাদের প্রকৃত আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে রূপান্তর করতে বাধ্য করবে।