সারাক্ষণ রিপোর্ট
সরকার বদল, নেতৃত্ব বদল—কিন্তু বাজারে আশার আলো নেই
২০২৩ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। রাজনৈতিক পরিবর্তনের এই ঘটনার পর শেয়ারবাজারে একটি ক্ষণস্থায়ী ইতিবাচক ঢেউ দেখা গেলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেতৃত্বে পরিবর্তন এলেও বাজারে আস্থা ফেরেনি। বরং ধারাবাহিক দরপতনের মধ্যে পড়ে বিনিয়োগকারীরা আবারও মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
ঈদের পরেই ধস: ৩০২ পয়েন্ট সূচক পতন, ১৭ হাজার কোটি টাকার মূলধন উধাও
২০২৫ সালের ঈদের ছুটির পর বাজার খোলার প্রথম কয়েক দিনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৩০২ পয়েন্ট কমে যায়। এর ফলে বাজার থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকার মূলধন হাওয়া হয়ে যায়। অনেকের মতে, এটি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা হতাশা এবং আস্থাহীনতার একটি বহিঃপ্রকাশ।
শেয়ারবাজারের স্থবিরতা: সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে আস্থা, তারল্য ও নেতৃত্ব
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারের মূল সমস্যাগুলো—
- বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট
- তারল্য সংকট ও কম লেনদেন
- নতুন আইপিও বা শক্তিশালী কোম্পানির অনুপস্থিতি
- বিএসইসি-র অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সিদ্ধান্তহীনতা
এসব মিলিয়ে বাজার কার্যত দিকনির্দেশনাহীন হয়ে পড়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নান বলেছেন, “বর্তমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারের মূল সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না।”
বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভ ও হতাশা: ‘ভালো কোম্পানিতেও লোকসান’
বিনিয়োগকারী তারেকুল ইসলাম বলেন, “কমিশন আগে বলতো ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে ক্ষতি হবে না। এখন ভালো কোম্পানির শেয়ারের দামও পড়ে যাচ্ছে।”
অন্য এক বিনিয়োগকারী মোহাম্মদ আলী বলেন, “মার্জিন ঋণের কারণে ফোর্স সেলে অনেকের ভালো শেয়ারও বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এতে প্রতিটি শেয়ারে নেতিবাচক চাপ পড়ছে।”
বিও অ্যাকাউন্টে বিপর্যয়: জিরো ব্যালেন্স ৩.৮ লাখ ছাড়াল
সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্যমতে, গত এক মাসে ১১ হাজার ৪২৯ জন বিনিয়োগকারী তাদের বিও অ্যাকাউন্ট থেকে সব টাকা তুলে নিয়েছেন। বর্তমানে জিরো ব্যালেন্স অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৮০ হাজারে। এটি স্পষ্টভাবে আস্থাহীনতার প্রতিফলন।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নিষ্ক্রিয়, নতুন আইপিও অনিশ্চিত
পুঁজিবাজারে বর্তমানে বড় ধরনের কোনো নতুন আইপিও আসার সম্ভাবনা নেই। বাজারে শক্তিশালী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। আইসিবির চেয়ারম্যান আবু আহমেদ মনে করেন, “যদি বড় কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনা যায়, তবে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে।”
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
বাজারের সঙ্গে যুক্ত ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর লোকসান বাড়ছে। লেনদেন কমে যাওয়ায় তাদের পরিচালন খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে এই খাতেও কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার
এই পরিস্থিতি স্পষ্ট করে দেয়, কেবল রাজনৈতিক সরকার বদল বা নতুন নেতৃত্ব বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে না। প্রয়োজন—
- বিএসইসির কার্যকর ও স্বাধীন সিদ্ধান্তগ্রহণ
- প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ
- আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর বাজারে অন্তর্ভুক্তি
- মার্জিন ঋণের ব্যবস্থাপনায় কঠোর নীতি
- ছোট বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপত্তা বেষ্টনী
আস্থাহীনতার অবসানই হতে পারে বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রথম ধাপ
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে চলমান দরপতন শুধু পুঁজিহীনতা নয়, একটি আস্থার সঙ্কট। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে নেতৃত্ব, নীতি ও নজরদারির সমন্বয় ছাড়া বিকল্প নেই। বিনিয়োগকারীরা এখন শুধু লাভ নয়, স্থিতিশীলতা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা খুঁজছেন। যদি তা নিশ্চিত করা যায়, তবে শেয়ারবাজার আবারও জাতীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হয়ে উঠতে পারে।