সারাক্ষণ রিপোর্ট
লুকারাঙ্গা স্কুলে আলো আসার আগের দুরবস্থা
২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত তানজানিয়ার লুকারাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয় বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় পরিচালিত হচ্ছিল। ফলে ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত মূল্যায়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো এবং জাতীয় পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারতো না। প্রধান শিক্ষক জোসেফ টোঙ্গোরা বললেন, “আমরা মূল্যায়ন চালাতে পারতাম না, যার ফলে শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি থেমে যেত।”
শিক্ষকরাও নানা সমস্যার সম্মুখীন হতেন। শিক্ষক ফ্লোরা চাচা জানান, তাঁকে পাঠদানের জন্য প্রয়োজনীয় ফটোকপি বা ইলেকট্রনিক উপকরণের জন্য প্রায়ই পাশের শহর নিয়ানকুম্বুতে যেতে হতো।
একই সঙ্গে নিরাপত্তার অভাব ছিল বড় সমস্যা। আগে স্কুল প্রাঙ্গণে চারজন প্রহরী রাখতে হতো, এখন আলো থাকার কারণে একজনই যথেষ্ট। সঞ্চয় হওয়া অর্থ দিয়ে শিক্ষকদের খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে।
বিদ্যুৎ সংযোগ বদলে দিল পরিস্থিতি
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে তানজানিয়ার গ্রামীণ বিদ্যুৎ সংস্থা (REA) বিদ্যালয়টিকে জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করে। প্রধান শিক্ষক টোঙ্গোরা বলেন, “বিদ্যুৎ কতটা জরুরি তা আমি কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে বলেছিলাম, এবং তারাই আমাদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে সংযোগ দেন।”
এরপর থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কাজ সহজ হয়েছে, নিয়মিত সাপ্তাহিক মূল্যায়ন চালু হয়েছে। শিক্ষক ফ্লোরা চাচা বললেন, “আগে ইংরেজির পাঠ্যবই সংকট থাকত, এখন কপি তৈরি করা যাচ্ছে, এমনকি অডিও রিসোর্সও ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে।”
শিক্ষার্থীদের ফলাফলেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র জাফেত তোবেকা বলেন, “আমরা সন্ধ্যায় নিরাপদে স্কুলে পড়াশোনা করতে পারি, কারণ চারপাশে আলো থাকে।”
বিদ্যুৎ সংযোগে তানজানিয়ার অগ্রগতি
২০১১ সালে যেখানে দেশটির মাত্র ১৪% মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত, ২০২২ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬%। এর পেছনে রয়েছে ন্যাশনাল রুরাল ইলেক্ট্রিফিকেশন প্রোগ্রামের (NREP) পরিকল্পিত উদ্যোগ। শহরাঞ্চলে যেখানে বিদ্যুৎপ্রাপ্তির হার ৭৩.২%, সেখানে গ্রামে তা মাত্র ২৪.৫%—এই বৈষম্য দূর করতে সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে সার্বজনীন বিদ্যুৎপ্রাপ্তির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
বিশ্বব্যাংকের সহায়তা এবং প্রকল্পসমূহ
এই উদ্যোগে সহায়তা করছে বিশ্বব্যাংক, যার আওতায় চলছে দুইটি বৃহৎ প্রকল্প—TREEP এবং ASCENT TZ।
- TREEP (Tanzania Rural Electrification Expansion Program):
- ২০১৬ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পে প্রথমে ২০৯ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২২ সালে আরও ৩৪১ মিলিয়ন ডলার প্রদান করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (IDA)।
- উদ্দেশ্য: সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎসেবা সম্প্রসারণ, নবায়নযোগ্য শক্তির অংশ বৃদ্ধি, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং খাতটির আর্থিক টেকসইতা নিশ্চিত করা।
- ASCENT TZ (Accelerating Sustainable and Clean Energy Transformation):
- ২০২৩ সালে চালু হওয়া এই ৩০০ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প, যেটিও IDA অর্থায়িত।
- লক্ষ্য: দ্রুত বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান।
এ পর্যন্ত TREEP:
- ৮০ লাখ মানুষ
- ১,৬০০ স্বাস্থ্যকেন্দ্র
- ৬,৫০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
- ১৬,০০০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
ASCENT TZ ইতোমধ্যে:
- ৭.৫ লাখ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে বিদ্যুতের প্রভাব
বুয়ুনি গ্রামের চিকিৎসাকেন্দ্র:
ডা. জুলিয়াস নসোহা জানান, আগে গ্রামের মানুষ নিজেরাই ওষুধ খেতো, কারণ কেন্দ্রে আসার তেমন সুবিধা ছিল না। দিনে গড়ে তিনজন রোগী আসতো। বিদ্যুৎ না থাকায় রাতের বেলায় মোবাইলের আলোতে সন্তান প্রসব করাতে হতো।
বর্তমানে, বিদ্যুৎ থাকায় সেখানে টিকাদান, রক্তপরীক্ষা, ছোটখাটো অস্ত্রোপচার ও রাত্রীকালীন চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। এতে রোগী সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মধ্যে।
ফুকায়োসি গ্রামে স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন
ফুকায়োসি, প্রায় ৫ হাজার মানুষের একটি গ্রাম। আগে ছোট একটি ডিসপেনসারিতে পানি ও আলোর সংকটে চিকিৎসা চলতো। নার্সরা প্রতিদিন পানি বহন করে আনতেন। ২০২১ সালে সরকার এখানে বড় হাসপাতাল নির্মাণ করে এবং ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়।
বর্তমানে এখানে ল্যাব পরীক্ষার পাশাপাশি এক্স-রে, আল্ট্রাসাউন্ড ইত্যাদি করা সম্ভব। রোগীর সংখ্যা বেড়েছে—মাসিক ২৫০ থেকে ৭০০ জনে উন্নীত হয়েছে।
এখন মাসে ১৭-২১টি সন্তান প্রসব হয়, যেখানে আগে হতো ৯-১০টি। বিদ্যুতের সহায়তায় এখন নবজাতকের জন্য ওয়ার্মারও ব্যবহৃত হচ্ছে।
এই পরিবর্তনগুলো প্রমাণ করে, বিদ্যুৎ শুধু আলো দেয় না, এটি শিক্ষার মান উন্নত করে, স্বাস্থ্যসেবা বাঁচায় এবং উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।