অ্যালেক্স ট্রাভেলি ও সাইফ হাসনাত
ঢাকা ও সাভার থেকে প্রতিবেদন, ৬ মে ২০২৫
বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলো নিজেদের আধুনিক করে তুলেছিল এবং সেই সঙ্গে জাতীয় আয়ও বাড়িয়েছিল। কিন্তু তারা কখনো কল্পনাও করেনি যে এক বাণিজ্যযুদ্ধ তাদের এই অগ্রযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে দেবে।
অস্থির অর্থনীতি ও শুল্কের ধাক্কা
গত গ্রীষ্মে গভীর অর্থনৈতিক ধসে ক্ষুব্ধ জনতা এক দৃঢ় শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশকে নৈরাজ্যের কিনারায় নিয়ে যায়। নতুন সরকার অর্থনীতি স্থিতিশীল করার চেষ্টা করতেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্ক বসানোর ঘোষণা দেয়—বাংলাদেশের ওপর, যে দেশটিকে রপ্তানি আয়েই জ্বালানি, খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় আমদানি চালাতে হয়। বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অস্থায়ীভাবে এই শুল্ক স্থগিত করেন, তবে ফের কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনায় পোশাক শ্রমিকদের দুশ্চিন্তা ঘনিয়ে আছে।
শ্রমিকদের শঙ্কা
২৫ বছরের মুরশিদা আক্তার উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকার কাছে সাভারে এসে পাঁচ বছর ধরে সেলাই মেশিন চালিয়ে পরিবার চালান। সম্প্রতি তিনি ৪এ ইয়ার্ন ডাইং-এ নতুন চাকরি নেন। বেতন মাসে আনুমানিক ১৫৬ ডলার, যাতায়াত কম, পরিবেশ ভালো। তবু তিনি বলেন, “অর্ডার কমে গেলে কাজও কমে যাবে।”
পোশাকশিল্পই প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন
১৭ কোটি মানুষের ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশকে সত্তরের দশকের রক্তক্ষয়ী জন্মের পর ‘অর্থনৈতিক ব্যর্থ রাষ্ট্র’ বলা হতো। আশির দশক থেকে পোশাকশিল্প এই ধারণা বদলে দেয়; বিশেষত নারী শ্রমিকরা দেশকে বিশ্ববাজারের দর্জি বানায়। এরই ফলে গড় আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশের নাগরিকরা পাশের বিশাল দেশ ভারতের নাগরিকদেরও ছাড়িয়ে গেছে। কেবল পোশাকশিল্পে সরাসরি চার মিলিয়নের বেশি মানুষ কাজ করেন; পরোক্ষভাবে পরিবারসহ এই খাতে নির্ভরশীল সংখ্যা প্রায় পাঁচ গুণ।
শুল্কবিরোধী কূটনীতি
ট্রাম্প শুল্ক স্থগিত করলেও জুলাইয়ে ‘অনুগ্রহ মেয়াদ’ শেষ হলে ১০ শতাংশ সর্বজনীন শুল্ক বহাল থাকবে। এর মধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন নেতা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস ৯০ দিনের ছাড় চেয়ে ট্রাম্পকে চিঠি লেখেন—বাংলাদেশ বেশি আমেরিকান তুলা ও অন্যান্য পণ্য কিনবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর এ হুমকিকে “ক্ষমতার কদাকার প্রদর্শন” বলে আখ্যা দেন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও বৈদেশিক চাপ
দীর্ঘ ১৫ বছরের দুর্দমনীয় শাসনের পর শেখ হাসিনার পতনে নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি হয়; নয় মাস পেরিয়েও গণতন্ত্র পুনঃস্থাপনের স্পষ্ট রূপরেখা অনুপস্থিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক লুটপাটের ক্ষতি সামাল দিলেও বিশ্বব্যাংক আগামী দুই বছরের প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস কমিয়েছে। আইএমএফের ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজের শর্তে জ্বালানি ভর্তুকি কমাতে ও দাম বাড়াতে জোর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “আমরা ভর্তুকি কমিয়ে দাম বাড়ানোর তীব্র চাপের মুখে আছি।”
রানা প্লাজা থেকে সবুজ কারখানা
২০১৩-তে রানা প্লাজা ধসের ট্রাজেডিতে ১,১০০-এরও বেশি শ্রমিকের প্রাণ কেড়ে নিলে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহে পড়ে। জীবনহানির সেই ভয়াবহ ঘটনা শিল্পকে আমূল বদলাতে বাধ্য করে। কারখানার সংখ্যা কমলেও রপ্তানি মূল্য ও কর্মসংস্থান বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত লিড সনদপ্রাপ্ত ২৩০টি কারখানার সংখ্যায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বসেরা।
৪এ ইয়ার্ন ডাইং কারখানার চিত্র
মুরশিদার কর্মস্থল ৪এ ইয়ার্ন ডাইং বহু বছর ধরে সুতার রং বদলে বেশি মূল্য সংযোজনময় জ্যাকেট, জলরোধী কোট ইত্যাদি তৈরি করে। ক্রেতার তালিকায় কারহার্ট, ক্যালভিন ক্লেইন থেকে শুরু করে ইউরোপের বড় ব্র্যান্ডও আছে। পাঁচ তলা কারখানাজুড়ে বড় ফ্যান, সেলাই মেশিনের শব্দ আর সঙ্গীত—প্রাক-বর্ষার ভাপেও ভেতরটা আলো-বাতাস সমৃদ্ধ। ছাদে সৌর প্যানেল, বাইরের দেয়াল ঝুলন্ত সবুজ গাছের পর্দা। বিদেশি পরিদর্শকদের পর্যবেক্ষণ মাথায় রেখে ফ্লোরে সাইনবোর্ডেও ইংরেজি বড় করে লেখা।
গত আগস্টে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় বহু কারখানার মতো এখানেও হাজারো জনতা হামলার চেষ্টা করে। জেনারেল ম্যানেজার খন্দকার ইমাম হেলমেট পরে শ্রমিকদের সঙ্গে গেটে দাঁড়িয়ে কারখানা রক্ষা করেন; উৎপাদন এক দিনও বন্ধ হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির টেকসই উন্নয়নপ্রধান মোহাম্মদ মনোয়র হোসেন বলেন, “এই দেশের সমগ্র অর্থনীতিই এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। জাতি হিসেবে আমাদের একমাত্র সম্পদ শ্রমশক্তি।”
অ্যালেক্স ট্রাভেলি নিউ দিল্লিভিত্তিক সাংবাদিক; ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসা ও অর্থনীতি নিয়ে লেখেন।