সারাক্ষণ রিপোর্ট
বর্তমান অচলাবস্থা
বাংলাদেশের ১৪ টি নিটওয়্যার ও পোশাক রপ্তানিকারকের প্রায় ৭.৬ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি মূল্য এক বছরের বেশি সময় ধরে রাশিয়াতে ফেরত আসছে না। রাশিয়ান আমদানিকারকেরা ডলার সংকটে ভুগছেন এবং SWIFT–সংযুক্ত ব্যাংক চ্যানেল ব্যবহার করতে পারছেন না ।
বিকেএমইএ সভাপতির দাবি
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের (আরএনপিপি) ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের রাশিয়ার কাছে যে অর্থপ্রদান বকেয়া রয়েছে, তা ব্যবহার করে রপ্তানিকারকদের পাওনা পরিশোধে সরকার সহায়তা করতে পারে ।
রূপপুরের অর্থপ্রবাহ ও নিষেধাজ্ঞা
রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা (সেকেন্ডারি স্যাংশনসহ) ডলার লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছে। বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ইউয়ানে ৩১৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তবে আরও ৯০০ মিলিয়ন ডলার এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের এসক্রো হিসাবে আটকে আছে । গত মাসে রাশিয়া দেরি হওয়া কিস্তির ১৬৪ মিলিয়ন ডলারের জরিমানা মওকুফ করে এবং ঋণ পরিশোধের সময়সীমা দুই বছর বাড়ায়, যা উভয় দেশের কূটনৈতিক সমঝোতার ইঙ্গিত দেয় ।
ক্ষতিগ্রস্ত বাজার ও পরিসংখ্যান
২০২৩‑২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট তৈরি পোশাক (RMG) রপ্তানি ছিল ৩৮.৪৮ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে রুশ বাজারের অংশ মাত্র ৪০৬ মিলিয়ন ডলার—মোট রপ্তানির প্রায় ১ শতাংশ । তবে রাশিয়া “নন‑ট্র্যাডিশনাল” বাজার হিসেবে দ্রুত বেড়েছিল; অর্থ আটকে যাওয়ায় ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোর নগদ প্রবাহে সরাসরি চাপ সৃষ্টি হয়েছে, জানিয়েছেন বিকেএমইএ ও বিজিএমইএ কর্মকর্তারা ।
ব্যাংকিং চ্যালেঞ্জ ও বিকল্প পথ
রাশিয়ার ১২টি বড় ব্যাংক SWIFT থেকে বিচ্ছিন্ন; অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন “ট্রাম্প‑প্রুফ” নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার উপর লেনদেনে মাধ্যমী (secondary) স্যাংশনের ঝুঁকি বাড়িয়েছে, ফলে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলো লেটার অব ক্রেডিট খুলতে অনিচ্ছুক । ব্যবসায়ীরা এখন চীনা CIPS প্ল্যাটফর্ম, রুবল‑টাকায় দ্বিপাক্ষিক মুদ্রা বিনিময়, কিংবা বার্টার ব্যবস্থার মতো বিকল্প সংযোগ খুঁজছেন ।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতি
- মস্কো‑ওয়াশিংটন টানাপোড়েন:ইউক্রেন যুদ্ধ–পরবর্তী নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে ডলারের বাইরে যেতে বাধ্য করেছে, ফলে রাশিয়াও ভারতের মতো অংশীদারদের সঙ্গে রুবল‑রুপিতে নিষ্পত্তি করছে।
• ওয়াশিংটনের নজরদারি: মার্কিন ট্রেজারি ক্রমেই সেকেন্ডারি স্যাংশন বাড়াচ্ছে; বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও রূপপুরের অর্থ পরিশোধে ‘উইন্ডো’ খোলার আগে অনুমতি নিতে হচ্ছে ।
• চীনের ভূমিকা: ইউয়ানে লেনদেন রাশিয়ার ডলার ও ইউরো ঝুঁকি কমাচ্ছে এবং চীন‑বাংলাদেশ‑রাশিয়া ত্রিপাক্ষিক বাণিজ্য‑সেতু তৈরি করছে ।
অর্থনীতিবিদদের পর্যবেক্ষণ
সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, “রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে লেনদেন‑ঝুঁকি ও আমদানি পরিশোধ দুই‑ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিকল্প মুদ্রায় নিষ্পত্তি অস্থায়ী স্বস্তি দিলেও ডলার‑নির্ভরতা কমানোর দীর্ঘমেয়াদি কৌশল দরকার” । আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদরা ইঙ্গিত করছেন, রাশিয়ান রপ্তানিকারকেরা এখন নিজেরা ট্রেড ক্রেডিট বাড়িয়ে আমদানিকারকদের অর্থায়ন করছেন, যা বৈশ্বিক বাণিজ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ।
সম্ভাব্য সমাধান
ইউয়ান‑ভিত্তিক লেনদেন বাড়ানো: কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যায়ে CIPS‑এর মাধ্যমে স্থায়ী বিনিময় চুক্তি।
বিনিময় ঝুঁকি বীমা (FX Hedging) তহবিল: সরকারের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে স্বল্প‑মেয়াদি সুদে সহায়তা।
বাজার বৈচিত্র্য: পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় নতুন ক্রেতা খোঁজা, যেখানে রাশিয়ার ব্যাংকিং প্রভাব কম।
যুক্তরাষ্ট্র‑সৌহার্দ্য কূটনীতি: বিশেষ স্যাংশন ছাড় (General License) পেতে সক্রিয় প্রচার।
সামনের দিকনির্দেশ
রাশিয়া‑ইউক্রেন যুদ্ধের কূটনৈতিক সমাধান ত্বরান্বিত না হলে রপ্তানিকারকরা আরও বড় ধরনের নগদ প্রবাহ সংকটে পড়তে পারেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ‑রাশিয়া ঋণ নিষ্পত্তি চুক্তির স্বচ্ছতা এবং বাংলাদেশি ব্যাংক‑ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি—না হলে ‘নন‑ট্র্যাডিশনাল’ বাজারে বাংলাদেশ যে অগ্রসর হয়েছিল, তা থমকে যেতে পারে।
উপসংহার
৭.৬ মিলিয়ন ডলার একটি তুলনামূলক ছোট সংখ্যা হলেও এটি রাশিয়া‑কেন্দ্রিক লেনদেনের বৃহত্তর ঝুঁকির প্রতীক। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, ব্যাংকিং অসঙ্গতি ও ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব—এই ত্রিমুখী চাপ সামলে টেকসই সমাধানে না পৌঁছালে, বাংলাদেশের রপ্তানি বৈচিত্র্য ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দুটোই হুমকির মুখে পড়তে পারে।