বিল গেটস
আমার বয়স যখন নয় বছর তখন নেলসন ম্যান্ডেলাকে রোবেন দ্বীপে কারাবন্দি ছিলেন, তখন তার কথা আমি প্রথম জানতে পারি। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর সম্পর্কে পড়েছি, আর সন্ধ্যার খবরে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রতিবেদন দেখতাম। বহু বছর পর তাঁর সঙ্গে দেখা ও কাজ করার সুযোগ পাই, আর সরাসরি তাঁর বিনয় ও সাহস আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে।
সেই মানুষটির নামে দেওয়া বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ পাওয়াটা আমার‑জন্য বিশেষ সম্মান। প্রিটোরিয়ায় নেলসন ম্যান্ডেলা লেকচার দিতে রাজি হয়ে আমি দ্রুতই বক্তব্য লিখতে শুরু করি।
আমি আফ্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম—দেখাতে চেয়েছিলাম কেন আমার বিশ্বাস, আগামী এক প্রজন্মে এই মহাদেশ পৃথিবীর যেকোনো মহাদেশের চেয়ে দ্রুত বদলে যেতে পারে।
আফ্রিকার জনসংখ্যা পৃথিবীর সবচেয়ে তরুণ; আর তারুণ্যের সঙ্গে এক ধরনের উদ্দীপনা আসে। আমি যখন বিশ বছর বয়সে পল অ্যালেনের সঙ্গে মাইক্রোসফট শুরু করি, তখনও সেই একই উদ্দীপনা কাজ করেছিল। আজ জোহানেসবার্গ, লাগোস ও নাইরোবির স্টার্ট‑আপ বুমের তরুণ উদ্যোক্তারা ঠিক ততটাই অল্প বয়সী, আর তাঁদের হাজারো উদ্যোগ ইতিমধ্যেই সারা মহাদেশে মানুষের জীবন বদলে দিচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক্স‑ভিত্তিক ডিজিটাল বিপ্লব এগিয়ে এলে সম্ভাবনা আরও বাড়বে।
কিন্তু এই ইতিবাচক পরিবর্তন স্বয়ংক্রিয়ভাবে আসবে না। প্রকৃত লাভ তখনই পাওয়া যাবে, যদি আফ্রিকা তাদের বেড়ে‑ওঠা প্রতিটি মানুষকে উদ্ভাবনী শক্তি উন্মোচনের সুযোগ দেয়। তরুণদের সেই সুযোগ পাওয়াই বড় প্রশ্ন, আর এটাই ছিল আজ প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বক্তৃতার মূল কথা। নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশন ও বিশ্ববিদ্যালয়কে ধন্যবাদ জানাই আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য।
সম্পূর্ণ বক্তৃতা
নেলসন ম্যান্ডেলা বার্ষিক বক্তৃতা
প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, দক্ষিণ আফ্রিকা
১৭ জুলাই ২০১৬
বিল গেটস:
ধন্যবাদ। শুভসন্ধ্যা, মহামান্য অতিথি ও বন্ধু‑বান্ধবকে। গ্রাসা মাশেল, প্রফেসর নডিবেলে, ভাইস‑চ্যান্সেলর ডি লা রে, মামেলোডি‑বাসী পরিবার, সম্মানিত অতিথিবৃন্দ—আপনাদের সামনে কথা বলা আমার‑জন্য পরম সম্মান।
নেলসন ম্যান্ডেলার নামে অনুষ্ঠিত বক্তৃতা দেওয়ার চেয়ে বড় সম্মান আর কী হতে পারে! এ‑বছর বক্তৃতার মূল‑ভাবনা “একসঙ্গে বাঁচা”—আর এ‑টি মোটেও কাকতালীয় নয়, কারণ “একসঙ্গে বাঁচা”‑ই ছিল ম্যান্ডেলার জীবনের সারকথা।
যে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি লড়েছিলেন, তার ভিত্তি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো ধারণা—যে মানুষকে আলাদা করে রাখতে হবে, আর আমাদের ভিন্নতা‑ই আমাদের সাধারণ মানবিকতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আজও দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ পূর্ণমাত্রায় “একসঙ্গে বাঁচা”‑র লক্ষ্য অর্জনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু ম্যান্ডেলা ও অপরাপর সংগ্রামীদের জন্যই সেই স্বপ্ন এখন অনেক কাছে।
আমি যখন ন’বছরের, ম্যান্ডেলাকে কারাবন্দি করা হয়। স্কুলে তাঁর গল্প পড়েছি, সন্ধ্যাকালে খবরেও আন্দোলনের ছবি দেখেছি। ১৯৯৪‑তে প্রথমবার তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলি; তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাচনের অর্থায়নে সাহায্যের অনুরোধ করেন। তখন আমি মাইক্রোসফট চালাচ্ছি, তবু ঐতিহাসিক সেই নির্বাচনে সাহায্য করতে পেরে গর্বিত বোধ করি।
এর ঠিক আগের বছর, ১৯৯৩‑তে মেলিন্ডা ও আমি পূর্ব আফ্রিকা সফর করি। অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বন্ধুসুলভ মানুষ দেখেছিলাম, তবে দারিদ্র্যের তীব্রতা আমাদের উদ্বিগ্ন ও উদ্দীপ্ত করে। আমরা জানতাম, একদিন আমাদের সম্পদ জনকল্যাণেই দেব; কিন্তু সেদিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে বুঝলাম, দেরি করার উপায় নেই।
১৯৯৭‑এ মাইক্রোসফটের প্রতিনিধি হয়ে প্রথম জোহানেসবার্গে আসি। বৈষয়িক এলাকায় বৈঠকে ব্যস্ত ছিলাম; তবু সোয়েটোর একটি কমিউনিটি‑সেন্টারে দানকৃত কম্পিউটার ঘুরে দেখি। সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় ডিজেল জেনারেটরে কম্পিউটারটি চালাতে হয়েছিল; বুঝলাম, আমি ফিরতেই জেনারেটরটা অন্য কাজে চলে যাবে। প্রযুক্তিগত‑মুখতা যে‑সমস্যার পুরোটা সমাধান নয়, সেটি গভীরভাবে উপলব্ধি করি।
এর পরেই আমরা গেটস ফাউন্ডেশন শুরু করি—কারণ অপেক্ষা করার মূল্য যে খুব বেশি, তা স্পষ্ট বোঝা গেছে। আমাদের কাজের মূল‑ভাবনা সিম্পল: মানুষ যেখানে জন্ম‑নেই, সেখানেই তাদের সুস্থ ও উৎপাদনশীল জীবনযাপনের সুযোগ থাকা উচিত।
পনেরো বছর ধরে আমরা সমস্যা শিখছি, আর এমন ক্ষেত্র খুঁজছি যেখানে হস্তক্ষেপ সর্বোচ্চ সুফল আনতে পারে। আফ্রিকা সফরগুলোতেই ম্যান্ডেলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজের সুযোগ পাই। এইডস ছিল আমাদের প্রথম কাজের অন্যতম—এখানে তিনি ছিলেন দিশারি ও প্রেরণা। ২০০৫‑এ নিজ পুত্রকে এইডসে হারিয়েও তিনি মৃত্যুর কারণ গোপন করেননি, কারণ কলঙ্ক ভেঙে ফেলা ছাড়া মহামারি থামানো যাবে না—সেটিই তিনি বুঝতেন।
আজ তাঁর উত্তরাধিকার স্মরণ করা জরুরি, তবে ম্যান্ডেলা ভবিষ্যৎ‑মুখী মানুষ ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষই ভবিষ্যৎকে অতীতের চেয়ে ভালো করতে পারে। তাই আজ আমি ভবিষ্যতের কথাই বলতে চাই—দক্ষিণ আফ্রিকা কী হতে পারে, আফ্রিকা কী হতে পারে, বিশ্বই বা কী হতে পারে, আর আমাদের কী করা উচিত।
২০০০‑এ গৃহীত মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস গত পনেরো বছরে অভূতপূর্ব অগ্রগতির ভিত্তি তৈরি করে; আর সদ্য গৃহীত সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য ঠিক করেছে।
আমি যখন অগ্রগতির কথা বলি, শিশু‑বেঁচে‑থাকা দিয়ে শুরু করি—কারণ শিশু বাঁচা‑মরা একটি সমাজের মূল্যবোধের মৌলিক সূচক। ১৯৯০‑এর পর থেকে সাব‑সাহারা আফ্রিকায় শিশুমৃত্যু ৫৪ শতাংশ কমেছে—মানে প্রতি বছর প্রায় দশ লাখ শিশু কম মারা যাচ্ছে। দশটি আফ্রিকান দেশ শিশুমৃত্যু দুই‑তৃতীয়াংশ কমানোর লক্ষ্যও অর্জন করেছে। দারিদ্র্য ও অপুষ্টিও কমেছে, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিছুটা ধীর।
তবে এই আখ্যান অসম্পূর্ণ। অগ্রগতি সবার নয়। ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমা পিকেটি গত বছরের বক্তৃতায় বলেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় আয়‑বৈষম্য “বিশ্বের প্রায় সর্বোচ্চ।” আফ্রিকার বহু দেশে একই চিত্র। আবার মহাদেশের গড় জিডিপি বেড়েছে বটে, কিন্তু অনেক দেশই সেই প্রবৃদ্ধি ভাগ পায়নি—দেশের ভিতর ও দেশগুলোর মধ্যে‑বৈষম্য বিদ্যমান। সবার মধ্যে অগ্রগতি ছড়িয়ে না‑গেলে “একসঙ্গে বাঁচা” স্বপ্নই থেকে যাবে।
তাছাড়া, এখনও আফ্রিকা বহু সূচকে অন্যদের পেছনে। সাব‑সাহারা আফ্রিকায় প্রতি বারো শিশুর একটি পাঁচ‑বছরের আগে মারা যায়; এটি আগের চেয়ে ভালো, কিন্তু গড় বিশ্ব‑শিশুর চেয়ে বাইশ গুণ বেশি ঝুঁকি। জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ায় দারিদ্র্য ও অপুষ্টির মোট সংখ্যা আসলে বেড়েছে।
এই অগ্রগতি ভঙ্গুরও। মহাদেশের দুই বৃহত্তম অর্থনীতি—দক্ষিণ আফ্রিকা ও নাইজেরিয়া—গুরুতর সমস্যায়; ইবোলা মহামারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা দেখিয়ে দিয়েছে; জলবায়ু‑পরিবর্তন কৃষকদের উপর ইতিমধ্যেই চাপ বাড়াচ্ছে। কাজেই লক্ষ্য পূরণে আফ্রিকাকে আরও দ্রুত, আরও ব্যাপক কাজ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, তা সম্ভব।
গত পনেরো বছরের সাফল্য‑ব্যর্থতা আমাদের শিক্ষা ও উদাহরণ দিয়েছে; বিজ্ঞান‑প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি সমাধানের পরিধি বাড়িয়েছে; আর আছে আফ্রিকার মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি। নেলসন ম্যান্ডেলা বারবার তারুণ্যের শক্তির কথা বলতেন—কারণ তিনি নিজেই বিশ বছর বয়সে এএনসি ইয়ুথ লিগে যুক্ত হয়েছিলেন। তরুণদের সম্ভাবনায় আমিও আশাবাদী। আগামী ৩৫ বছরে আফ্রিকায় ২০০ কোটি শিশু জন্মাবে; ২০৫০‑এ বিশ্বের ৪০ শতাংশ শিশু এই মহাদেশে।
যদি তাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সুযোগ নিশ্চিত করা যায়, তবে তারা অতীত‑নির্ধারিত সীমানা ভেঙে দেবে। আমার ভাবনায় বিনিয়োগের শীর্ষ ক্ষেত্র স্বাস্থ্য—কারণ যখন স্বাস্থ্য ভালো হয়, জীবনের সব সূচকই উন্নত হয়। গত পনেরো বছরে আমাদের ফাউন্ডেশন আফ্রিকায় ৯ বিলিয়ন ডলার‑এর বেশি বিনিয়োগ করেছে; পরবর্তী পাঁচ বছরে আরও ৫ বিলিয়ন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
পোলিও দূরীকরণ এখন দোরগোড়ায়; নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ার ভ্যাকসিন একই সঙ্গে ধনী‑গরিব সব দেশে শিশুদের পৌঁছাচ্ছে; মালাউই, ইথিওপিয়া, রোয়ান্ডার মত দেশগুলো সম্প্রদায়ভিত্তিক প্রাথমিক‑স্বাস্থ্যসেবায় সাফল্য পাচ্ছে; ম্যালেরিয়া‑মৃত্যু নাটকীয়ভাবে কমেছে; পশ্চিম আফ্রিকায় পরিবার‑নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি কোটি‑কোটি নারীর জীবন সহজ করছে।
এইডস‑সংক্রান্ত অর্জনও বড়, যদিও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। আজ ১ কোটি ২০ লক্ষ আফ্রিকান আর্ট পান, যার চার ভাগের এক ভাগ দক্ষিণ আফ্রিকায়। তবু প্রতিদিন ২৪ বছরের নিচে ২ হাজারের বেশি তরুণ এইচআইভি‑তে আক্রান্ত হন; ১৯৯০‑এর পর থেকে এই বয়সে এইডস‑জনিত মৃত্যু চার গুণ বেড়েছে। কাজেই টেস্ট, চিকিৎসা‑অনুশাসন এবং প্রতিরোধমূলক নতুন পদ্ধতির দরকার।
পুষ্টিহীনতাও বড় সমস্যা: প্রায় এক‑তৃতীয়াংশ আফ্রিকান শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। এতে দেহ‑মন উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা সারাজীবন ছাপ ফেলে। কৃষি‑উৎপাদনশীলতা বাড়াতে উন্নত বীজ, মাটির সঠিক সার, জলবায়ু‑সহিষ্ণু ফসল দরকার; বাজার‑সংযোগ দরকার যেন কৃষকরা লাভবান হন। তাতে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠবে।
তবে বিদ্যুৎ‑বিহীন উন্নয়ন অসম্ভব। আজও প্রতি দশে সাত জন আফ্রিকান বিদ্যুৎহীন; ২০৪০‑এ গিয়েও ৫০ কোটি মানুষ অন্ধকারে থাকতে পারে। সস্তা, পরিচ্ছন্ন শক্তি‑বিপ্লব জরুরি। সমন্বিত বড়‑গ্রিড, হাইড্রো, ভূ‑তাপ, মাইক্রো‑সোলার—সব কিছুর প্রয়োজন।
স্বচ্ছ ও দক্ষ শাসন এই সব প্রচেষ্টার অবকাঠামো। নাগরিক‑কেন্দ্রিক তথ্যপ্রকাশ, ডিজিটাল লেনদেনব্যবস্থার উন্নয়ন, নীতি‑সহায়ক পরিবেশ—এসবই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে।
আমি সম্প্রতি আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাঁদের প্রত্যেকেরই স্পষ্ট লক্ষ্য—নিজ দেশকে সমৃদ্ধ করা। এই লক্ষ্য‑সচেতন তরুণদের জন্য সুযোগ নিশ্চিত করাই আমাদের কর্তব্য। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, “যুবশক্তি জাগরিত হলে হতাশার টাওয়ার ভেঙে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করতে পারে।” আমাদের দায়িত্ব শুধু তাঁদের জাগিয়ে তোলা নয়—তাঁদের পেছনে বিনিয়োগ ও কাঠামো দাঁড় করানো, কারণ আগামীকালের উদ্ভাবন আজকের শিশুবিন্দুর উপর নির্ভর করছে।
এসব চ্যালেঞ্জ জটিল, তবে সাহস, মেধা, উদ্যম আর সহনশীলতা দিয়ে মানুষ এগুলো পার হতে পারে। চলুন, নেলসন ম্যান্ডেলার স্বপ্নের ভবিষ্যৎ—যেখানে আমরা সবাই একসঙ্গে বাঁচব—গড়ে তুলতে এখনই সর্বশক্তি নিয়োজিত করি।
ধন্যবাদ।
Leave a Reply