সারাক্ষণ রিপোর্ট
আসন্ন ২০২৫‑২৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনছে অন্তর্বর্তী সরকার—চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। সুদ পরিশোধ ব্যয়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, রাজস্ব আহরণের অসামঞ্জস্য এবং উন্নয়ন ব্যয়ের নিম্ন বাস্তবায়ন হারই এ সংকোচনের মূল কারণ।
বাজেট সংকোচনের মূল চালিকাশক্তি
গত কয়েক বছর ধরে টাকার অবমূল্যায়ন ও বৈদেশিক ঋণের সুদহার বাড়ার ফলে সুদ পরিশোধে ব্যয় ২০ হাজার কোটি টাকা লাফ দিয়ে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে—প্রস্তাবিত বাজেটের প্রায় ১৬.৮ শতাংশ। এই ধারা বজায় থাকলে রাজস্বের চার ভাগের এক ভাগই সুদ পরিশোধে চলে যাবে, যা বিকাশমান অর্থনীতির জন্য টেকসই নয়।
সুদের ঊর্ধ্বগতি ও ঋণচিত্র
সরকারি মোট ঋণ এখন জিডিপির প্রায় ৩৯ শতাংশ (আইএমএফের তথ্য) এবং বৈদেশিক ঋণ ২০২৪‑এর শেষে ১০৩.৬ বিলিয়ন ডলার—যেখানে স্বল্পমেয়াদি দায়ও বেড়ে ১৪.২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ঋণ‑জিডিপি অনুপাত এখনও ঝুঁকির সীমা পেরোয়নি, তবে সুদ খাতে চাপ বাড়ায় ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ব্যয় ‘ক্রাউড আউট’ হওয়ার শঙ্কা তীব্র।
উন্নয়ন ব্যয়: কাঙ্ক্ষিত নয়, কার্যকরও নয়
প্রস্তাবিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা মাত্র—চার বছরে সর্বনিম্ন এবং গত বছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ কম। তবু বাস্তবায়ন আরও বড় সমস্যা; চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে খরচ হয়েছে মাত্র ৩৬.৬৫ শতাংশ, যা ১৫ বছরে সর্বনিম্ন। ফলে অবকাঠামো ও মানবিক প্রকল্পে ‘অনুদানের অকার্যকারিতা’ প্রকট।
রাজস্ব আহরণ ও কর সংস্কার
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা—মাত্র ৭.৬ শতাংশ বৃদ্ধি। কিন্তু কর‑জিডিপি অনুপাত আটকে আছে ৭.৪‑৭.৫ শতাংশে, যেটি দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। কর অব্যাহতি সীমিতকরণ, ইউনিফর্ম ভ্যাট হার এবং শুল্ক কাঠামো পুনর্বিন্যাস ছাড়া এ লক্ষ্য অপূর্ণ থেকে যাবে।
আইএমএফ কর্মসূচি ও নীতি সংস্কার
৪.৭ বিলিয়ন ডলারের আইএমএফ সুবিধার দ্বিতীয় পর্যালোচনায় রাজস্ব বাড়াতে ও ব্যাংক খাত সংস্কারে ৪৫টির বেশি কার্যক্রম নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার ইতিমধ্যে অতিরিক্ত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ১৭ হাজার কোটি টাকা কমাতে আইএমএফকে রাজি করিয়েছে, যা বাস্তব চাপ কিছুটা কমাবে। তবে কাঠামোগত শর্ত পূরণ না হলে কিস্তি ঝুলে যাওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ও মুদ্রার মান
১৫ এপ্রিলের হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ ২১.১৮ বিলিয়ন ডলার; ৭ মে আকুর পরিশোধের পর তা কমে ২০.২৯ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে—যদিও এখনও চার মাসের আমদানি ব্যয়ের বেশি। রেমিট্যান্স বাড়লেও আমদানি‑ব্যয় ও ঋণসেবার চাপে রিজার্ভ ঘাটতি দ্রুত পূরণ কঠিন।
সামাজিক সুরক্ষা ও মানবিক ব্যয়ের দৃষ্টিকোণ
ইউনিয়ন পর্যায়ে অনুদান স্থগিত থাকায় প্রান্তিক গোষ্ঠী আয়ের ধাক্কা সামলাতে পারছে না। সিপিডি ও পিআরআই বাজেটে অতিরিক্ত সামাজিক সুরক্ষা বরাদ্দের পরামর্শ দিয়েছে, নতুবা দারিদ্র্য ও বৈষম্য আরও বাড়তে পারে। সাংগঠনিক দক্ষতার ঘাটতি থাকলে বরাদ্দ বাড়ালেও সুফল মিলবে না—শৃঙ্খলিত টার্গেটিং জরুরি।
ঝুঁকি ও সুপারিশ
সুদ খাতে নিয়ন্ত্রণ: স্বল্পমেয়াদি ঋণ কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদি, নিম্ন সুদহারযুক্ত বৈদেশিক ঋণ পুনঃতালিকাভুক্ত করা।
কর সংস্কারে গতি: ইউনিফর্ম ভ্যাট (১০‑১২ শতাংশ) চালু করে কর অব্যাহতি ধাপে ধাপে কমানো।
এডিপি বাস্তবায়ন দক্ষতা: প্রকল্প মূল্যায়ন কমিশন সক্রিয় করে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পোর্টফোলিও গঠন।
স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ: ‘পূর্ব‑বাজেট বিবৃতি’ এবং ত্রৈমাসিক বাস্তবায়ন প্রতিবেদন সময়মতো প্রকাশ বাধ্যতামূলক—ওপেন বাজেট জরিপে ৬১ স্কোর অর্জনের লক্ষ্যে।
বৈদেশিক রিজার্ভ সুরক্ষা: বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে প্রাধান্য দেওয়া উচিত কনসেশনাল ঋণকে; পাশাপাশি রেমিট্যান্স ও রপ্তানির প্রণোদনা বজায় রাখার সুপারিশ।
২০২৫‑২৬ অর্থবছরের বাজেট ঋণসেবা ও রাজস্ব ঘাটতি—উভয় সংকট—একসঙ্গে সামাল দেওয়ার ইঙ্গিতবাহী। পরিকল্পনা যথাযথ হলেও বাস্তবায়ন দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত না হলে বাজেট কেবল কাগজেই সেরা থাকবে। এখন মূল প্রশ্ন—সরকার কত দ্রুত শনাক্ত কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো দূর করতে পারবে এবং নাগরিক আস্থা পুনর্গঠন করবে।