সারাক্ষণ রিপোর্ট
তরুণদের কর্মদক্ষতার পথে বাধা ইংরেজিতে দুর্বলতা
বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী ইংরেজি ভাষায় কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে পারছে না। শুধু শহরের শিক্ষার্থী নয়, মফস্বল, গ্রাম এবং মাদরাসা শিক্ষার ক্ষেত্রেও ইংরেজিতে ঘাটতি একটি কাঠামোগত দুর্বলতায় পরিণত হয়েছে। চাকরি বাজারে প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকা প্রতিযোগিতা ও আন্তর্জাতিক মানের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় দেশের বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠী সুযোগের দৌড়ে ছিটকে পড়ছে।
মুখস্থনির্ভর শিক্ষা ও শিক্ষক সংকট
বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে এখনও ইংরেজি শেখানোর মূল পদ্ধতি হলো ব্যাকরণনির্ভর মুখস্থকরণ। পাঠ্যবইয়ের গণ্ডি পার হয়ে ভাষার ব্যবহারিক চর্চা হয় না। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—অনেক স্কুল ও মাদরাসায় ইংরেজি শিক্ষকদের নিজেদেরই প্রয়োজনীয় দক্ষতা নেই।
শিক্ষকের দুর্বলতা:
- প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের অনেক শিক্ষক ইংরেজিতে সাবলীলভাবে কথা বলতে পারেন না।
•ইংরেজি শিক্ষকরা অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চারণ, শব্দচয়নে দুর্বল এবং স্পিকিংয়ে আত্মবিশ্বাসহীন।
• প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত, ফলে যুগোপযোগী পদ্ধতিতে শেখাতে পারেন না।
মাদরাসা শিক্ষার বাস্তবতা:
- দেশের একটি বড় অংশ শিক্ষার্থী আলিয়া ও কওমি মাদরাসায় পড়াশোনা করে,যেখানে ইংরেজি পড়ানো হয় সীমিত আকারে এবং কখনও কখনও উপেক্ষিত থাকে।
• মাদরাসার পাঠ্যসূচিতে ইংরেজি বাধ্যতামূলক হলেও তা বাস্তব চাহিদা ও আন্তর্জাতিক কর্মদক্ষতার সঙ্গে মিল নেই।
• অনেক মাদরাসায় ইংরেজি শিক্ষকই নেই, বা থাকলেও তারা শুধু পরীক্ষায় পাশ করানোর মতো পর্যায়ে সীমাবদ্ধ।
কোন কোন খাতে ইংরেজির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি?
১. বহুজাতিক কোম্পানি (MNCs)
২. আইটি ও ফ্রিল্যান্সিং
৩. ব্যাংক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান
৪. উচ্চশিক্ষা ও স্কলারশিপ
৫. সরকারি ও বেসরকারি নিয়োগ পরীক্ষা
৬. পর্যটন, হসপিটালিটি ও আন্তর্জাতিক এনজিও খাত
শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা
ঢাকার একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাকিব বলেন, “আমি মার্কেটিং নিয়ে পড়ছি, কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলতে গেলে জড়তা কাজ করে। ইন্টার্নশিপে গিয়ে বুঝেছি, এই ভাষা না জানলে কিছুই এগোয় না।”
কুমিল্লার মাদরাসা শিক্ষার্থী রওশন জানায়, “আমাদের ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন না। দাখিল পাশ করেছি ঠিকই, কিন্তু চাকরির আবেদন করতে গিয়ে দেখি নিজের সিভিই ইংরেজিতে ঠিকভাবে লিখতে পারি না।”
রাজশাহীর একটি কলেজের শিক্ষার্থী তামান্না বলেন, “ইংরেজি ক্লাসে শুধু গ্রামার পড়ানো হয়, কোনো দিন বলা বা শোনার চর্চা হয়নি। অথচ চাকরি পেতে গেলে ইংরেজি ইন্টারভিউয়ের মুখোমুখি হতে হয়।”
পরিসংখ্যান ও গবেষণা
- Centre for Policy Dialogue (CPD)-এর ২০২২ সালের গবেষণা অনুযায়ী,বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজি ও কমিউনিকেশন স্কিলে সবচেয়ে কম গড় স্কোর পাওয়া গেছে।
• British Council-এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে,বাংলাদেশের ৪৮% তরুণ মনে করেন, ইংরেজিতে দক্ষ হলে তারা উচ্চ বেতনের চাকরির সুযোগ পেতেন।
• ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এক অধ্যাপক জানান, “বর্তমানে যে শিক্ষা পদ্ধতি চালু আছে, তা শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ। মুখস্থনির্ভরতা বাদ দিয়ে ব্যবহারিক ভাষা চর্চার সুযোগ দিতে হবে।”
ইংরেজি দক্ষতার ঘাটতি ও চাকরি বাজারে প্রভাব
বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার অভাব একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেও ইংরেজিতে কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে অক্ষম। এই দুর্বলতা চাকরি বাজারে তাদের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিচ্ছে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, নিয়োগকর্তাদের ৯৩% মনে করেন, ইংরেজি ভাষার দক্ষতার অভাব চাকরি প্রার্থীদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজি ও যোগাযোগ দক্ষতায় সবচেয়ে কম গড় স্কোর পাওয়া গেছে, যা চাকরি বাজারের চাহিদার সঙ্গে বড় ধরনের ফারাক সৃষ্টি করছে।
শিক্ষাবিদদের মতামত: শিক্ষকদের দক্ষতার ঘাটতি
শিক্ষাবিদরা মনে করেন, ইংরেজি শিক্ষকদের নিজস্ব দক্ষতার অভাব শিক্ষার্থীদের শেখার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক শিক্ষকই ইংরেজিতে সাবলীলভাবে কথা বলতে পারেন না, যা শিক্ষার্থীদের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাধ্যমিক স্তরের ইংরেজি শিক্ষকদের মধ্যে প্রশিক্ষণের অভাব এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ার দুর্বলতা ইংরেজি শিক্ষার মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।