সারাক্ষণ রিপোর্ট
৭০০টির বেশি নদ-নদীতে জড়িত দেশ বাংলাদেশ বর্তমানে ভয়াবহ মিষ্টি পানির সংকটে পড়েছে। প্রচুর নদী থাকা সত্ত্বেও বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে দেশে তীব্র সুপেয় পানির সংকট দেখা দেয়। এই ঘাটতি কৃষি, জনস্বাস্থ্য ও সামগ্রিক পানি নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে।
মিষ্টি পানির সংকটের কারণসমূহ
উজানে পানিপ্রবাহে বাধা
বাংলাদেশের মিষ্টি পানির বড় অংশ আসে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো থেকে, বিশেষত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী থেকে, যেগুলো প্রতিবেশী দেশ থেকে প্রবাহিত হয়। ভারতের ফারাক্কা বাঁধের মতো স্থাপনাগুলো প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করেছে, ফলে ভাটিতে বাংলাদেশে মিষ্টি পানির প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ বেড়েছে, যা কৃষি ও সুপেয় পানির উৎসকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, যার মধ্যে রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়। এ ধরনের ঘটনা, বিশেষত খুলনা ও সাতক্ষীরার মতো উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি মিষ্টি পানির উৎসে ঢুকে পড়ছে। এর ফলে পানির গুণমান নষ্ট হচ্ছে এবং কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
নদীর পানি দূষণ
শিল্পকারখানার বর্জ্য, অপরিশোধিত পয়ঃবর্জ্য ও কৃষিজাত রাসায়নিকের কারণে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালুসহ প্রধান নদীগুলো মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছে। এই দূষণ পানিকে ব্যবহারের অযোগ্য করে তুলেছে এবং সেচসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহারে সমস্যা হচ্ছে।
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস ও দূষণ
ঢাকার মতো শহরগুলোতে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর উল্লেখযোগ্যভাবে নেমে গেছে। এ ছাড়া আর্সেনিক দূষণ ও লবণাক্ততার কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে নিরাপদ খাবার পানির উৎস আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
পরিণতি
• জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি: লবণাক্ত বা দূষিত পানি পান করায় উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ ও গর্ভাবস্থায় নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে।
• কৃষিতে সমস্যা: লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ও পানির অভাবে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকদের জীবনযাত্রাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
• অর্থনৈতিক প্রভাব: মিষ্টি পানির সংকট মৎস্য, কৃষি ও শিল্প খাতে ব্যাপক ক্ষতি সৃষ্টি করছে, যা অর্থনৈতিক ক্ষতি ও দরিদ্রতা বৃদ্ধির কারণ।
সংকটে থাকা নদীগুলো
বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি নদী দূষণ, পানির প্রবাহ কমে যাওয়া ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে গুরুতর বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে:
• বুড়িগঙ্গা নদী: একসময় ঢাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ নদী এখন শিল্পবর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্যে মারাত্মকভাবে দূষিত।
• শীতলক্ষ্যা নদী: ব্যাপক শিল্পদূষণের ফলে নদীর পানি ও জলজ জীবনের ক্ষতি হয়েছে।
• তুরাগ নদী: দখল ও বর্জ্য ফেলার কারণে নদী সংকুচিত ও দূষিত হয়ে পড়েছে।
• বালু নদী: শিল্পবর্জ্যের দূষণ ও নদী দখলের শিকার।
• কর্ণফুলী নদী: চট্টগ্রামে অবস্থিত এই নদী শিল্পদূষণ ও পলি জমার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের কোনো নদীই বর্তমানে নিরাপদ বাস্তুতান্ত্রিক অবস্থায় (Safe Operating Space) নেই, যা ব্যাপক পরিবেশগত সংকট নির্দেশ করছে।
সংকট মোকাবিলায় করণীয়
• আন্তঃসীমান্ত পানি ব্যবস্থাপনা: শুষ্ক মৌসুমে পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে উজানের দেশগুলোর সঙ্গে কার্যকর চুক্তি ও সমঝোতা বৃদ্ধি করা।
• দূষণ নিয়ন্ত্রণ: শিল্পবর্জ্যের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা ও পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনে জোর দেওয়া।
• বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ভূগর্ভস্থ স্তরের পুনঃপূর্ণতা: বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও ভূগর্ভস্থ স্তরে কৃত্রিমভাবে পানি যোগ করার উৎসাহ দেওয়া।
• লবণাক্ত পানি বিশুদ্ধকরণ: লবণাক্ত পানি বিশুদ্ধকরণ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ানো ও দূষিত পানিকে নিরাপদ করার ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশের মিষ্টি পানির সংকট মূলত মনুষ্যসৃষ্ট কর্মকাণ্ড ও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মিলিত ফলাফল। এই সংকট সমাধানে সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা, আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং টেকসই পানি অবকাঠামোতে বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি, যাতে দেশের মানুষের জন্য নিরাপদ ও পর্যাপ্ত মিষ্টি পানি নিশ্চিত করা যায়।