সারাক্ষণ রিপোর্ট
অতীত: সমৃদ্ধ শালবনের রাজত্ব (১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত)
ভাওয়াল ছিল এক সময় বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঘন শালবন অঞ্চলের নাম। মূলত গাজীপুর ও এর আশপাশের এলাকায় বিস্তৃত এই বনাঞ্চল শত শত বছর ধরে টিকে ছিল।
ঔপনিবেশিক আমলে এই অঞ্চল ছিল ভাওয়াল জমিদারির অন্তর্ভুক্ত, যা ‘ভাওয়াল রাজ্য’ নামে পরিচিত ছিল। বনভূমির বিস্তার তখন প্রায় ১ লাখ একর ছাড়িয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এই অঞ্চলের মাটি ছিল লালচে দোআঁশ, যা শালগাছের জন্য আদর্শ। বনের মধ্যে ছিল বন্যপ্রাণী যেমন ময়ূর, হরিণ, বাঘ ও ভালুকের বসবাস।
এই বন শুধু পরিবেশগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, বরং স্থানীয় মানুষের জীবিকা, ওষুধি গাছ, কাঠ, মধু এবং জ্বালানির উৎস হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
অবক্ষয়ের শুরু: স্বাধীনতার পর কাঠ পাচার ও দখল (১৯৭১-২০০০)
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই ভাওয়ালের বনাঞ্চল ব্যাপক হারে ধ্বংস হতে শুরু করে। এই ধ্বংসযজ্ঞের মূল কারণ ছিল:
- বন উজাড় করে কাঠ পাচার: সরকারি তদারকির অভাবে এবং বন প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগে হাজার হাজার একর শালগাছ কেটে পাচার করা হয়।
- দখল ও জনবসতি: আশেপাশের এলাকা থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বসতি গড়ে তোলে, এবং জমি দখল করে কৃষিকাজ শুরু করে। অনেকে বনের ভেতর চাষাবাদ শুরু করে দেয়।
- সড়ক ও শিল্প স্থাপনা: আশুলিয়া, টঙ্গী ও গাজীপুরে শিল্প স্থাপনের জন্য বনভূমি কেটে রাস্তা ও কারখানা তৈরি করা হয়।
- পুনরায় বনায়ন নয়: এই সময়ে যত শালগাছ কাটা হয়েছিল, তার মাত্র একাংশই পুনরায় রোপণ করা হয়। অনেক জায়গায় বিদেশি প্রজাতির গাছ লাগানো হয়, যা স্থানীয় জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
২০০০ সালের মধ্যে ভাওয়ালের মূল প্রাকৃতিক বনভূমির ৭০ শতাংশেরও বেশি অংশ হারিয়ে যায়।
বর্তমান অবস্থা: ছায়া বন, বাণিজ্যিক বৃক্ষরোপণ ও বনবিহীন ভবিষ্যতের শঙ্কা
বর্তমানে ভাওয়ালের ঐতিহ্যবাহী শালবন খুবই সীমিত পরিসরে টিকে আছে, মূলত ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান এবং আশপাশের কিছু সংরক্ষিত খণ্ডে।
বর্তমান অবস্থা সংক্ষেপে:
- প্রাকৃতিক বনভূমি অবশিষ্ট: আনুমানিক ১০-১৫% এর নিচে।
- স্থানীয় প্রজাতির হ্রাস: শাল, গর্জন, তেলেগাছের জায়গায় এখন বিদেশি ইউক্যালিপটাস ও আকেশিয়া প্রাধান্য পাচ্ছে।
- বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির পথে: বনাঞ্চল সংকুচিত হওয়ায় বন্যপ্রাণীদের চলাচলের পথ কেটে গেছে।
- গাজীপুরে নগরায়ন: শহর ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রসারে বন একপ্রকার বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে।
- অভ্যন্তরীণ পর্যটন চাপে: বনভূমিতে অসংখ্য পর্যটক যান, যার প্রভাব পড়ে জীববৈচিত্র্যের ওপর।
ভবিষ্যৎ: বন পুনরুদ্ধার না হলে বিলুপ্তির আশঙ্কা
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ভাওয়ালের আসল বনভূমির অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে এখনও কিছু সম্ভাবনা রয়েছে:
ভবিষ্যৎ করণীয়:
- স্থানীয় শালগাছের পুনরায় রোপণ: শুধুমাত্র প্রাকৃতিকভাবে অভিযোজিত প্রজাতির গাছ লাগাতে হবে।
- সামাজিক বনায়নকে উৎসাহ: স্থানীয় মানুষকে বন সংরক্ষণের অংশীদার করতে হবে।
- জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার: বনাঞ্চলে বন্যপ্রাণীর বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
- শিক্ষামূলক ও গবেষণা কেন্দ্র: বন সংরক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করতে হবে।
- বনভিত্তিক পর্যটন সীমিতকরণ: সংবেদনশীল এলাকাগুলোতে পর্যটন সীমিত করে ‘নির্বিঘ্ন পুনর্জন্মের অঞ্চল’ তৈরি করা।
ভাওয়ালের বন ছিল এক সময় ঢাকার উত্তরে একটি প্রকৃতিক দুর্গ। গত ৫০ বছরে অবহেলা, লোভ এবং দুর্নীতির কারণে এই বন আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এখনও সময় আছে তা পুনরুদ্ধারের। নীতিনির্ধারক, স্থানীয় প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে ভাওয়ালের হারানো শালবনকে ফিরিয়ে আনতে।