সারাক্ষণ রিপোর্ট
বঙ্গোপসাগরের নরম নীলজলে ভেসে‑থাকা সেন্ট মার্টিন—স্থানীয় মানুষের কাছে ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’—বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। মাত্র ১২ বর্গকিলোমিটার দ্বীপটি গঠিত হয়েছে মৃত ও জীবন্ত প্রবালের স্তূপে, যার উপর ভর করে বেড়ে উঠেছে কেয়া, নারকেল আর পায়রার ঝাঁক। আশির দশকে রঙিন প্রবালচাদরে ঢাকা এই দ্বীপে বসবাস ছিল কেবল কয়েকশো জেলে পরিবারের; দ্বীপজুড়ে প্রবালের আচ্ছাদন তখন ৪০‑৪৫ শতাংশের ঘরে বলে গবেষণাপত্রে উল্লেখ রয়েছে ।
আশির দশকের নিস্তরঙ্গ দিন
১৯৭৫‑৮৯ সময়ে সেন্ট মার্টিন ছিল যেন দেশের শেষ নিঃশব্দ নীড়। জেলেরা সাগর থেকে মাছ ধরত, রাত হলে কচ্ছপেরা নির্ভয়ে ডিম পাড়ত, আর দায়‑দায়িত্বহীন পর্যটকেরা সেই ঢেউখেলা জলে পৌঁছাতই না। তখনও সরকারের নজরদারি ছিল সীমিত; পরিবেশ‑আইনের ধারনাও ছিল নরম কাদা মাটির মতো।
পর্যটনের জোয়ার ও প্রবাল ক্ষয়ের সূচনা
নব্বইয়ের গোড়ায় ঢাকায় গড়ে ওঠা পর্যটন কোম্পানির বিজ্ঞাপনে দ্বীপের নাম প্রথম বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০০ সাল ঘুরতেই সেন্ট মার্টিনে পর্যটক আসা বছরে কয়েক হাজার থেকে কয়েক লক্ষে পৌঁছে যায়—শুধু শুক্র‑শনিবারেই শতাধিক বোটে ভিড় । সেই ভিড়ের চাপ, স্নরকেল ও ডাইভিং‑এর অনিয়ন্ত্রিত দৌরাত্ম্যে প্রবাল ভাঙা শুরু হয়; ২০২২ সালের গবেষণায় জীবিত প্রবাল কভার নেমেছে ২৫ শতাংশের নিচে । যে প্রবালের জন্য দ্বীপের জন্ম, সেই প্রবালই আজ নিঃশেষের পথে।
কচ্ছপের কান্না: সমুদ্রের নির্জন ডিমবিছানা
কয়েক দশক আগেও রাতের আঁধার ফুঁড়ে সমুদ্র কচ্ছপ হাঁটে উত্তর‑পূর্ব সৈকতে। কিন্তু মেরিন বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, গত ৪০ বছরে ডিম পাড়ার সংখ্যা ৮০ শতাংশ কমেছে । ২০২৩ মৌসুমে মাত্র কয়েক‑শ’টি বাসা শনাক্ত হয়েছে—যেখানে এক সময় সংখ্যাটা হাজারের ঘরে উঠত । রাতে রিসোর্টের কাঁপা ফ্লাডলাইট আর দিনের বর্জ্যে অকেজো হয়ে পড়েছে কচ্ছপের নিশ্চিন্ত পথ।
ভাঙনের রেখায় দ্বীপের আয়ু
সমুদ্রের ঢেউ প্রবাল‑প্রাচীর দুর্বল হলে ঢুকে পড়ে দ্বীপের নরম বালিতে। ১৯৭৪‑২০২১ সময়ে তটরেখা গড়ে প্রতি বছর প্রায় ২.১৩ মিটার করে সরে গেছে বলে DSAS প্রযুক্তিনির্ভর এক গবেষণা জানিয়েছে । দ্বীপের দক্ষিণ‑পশ্চিম দিক কোথাও কোথাও ৬০ মিটার পর্যন্ত গিলে খেয়েছে সাগর।
জলবায়ু সঙ্কটে উষ্ণ নীলজলের দহন
বঙ্গোপসাগরের পৃষ্ঠজল উষ্ণ হচ্ছে ক্রমাগত। তাপমাত্রা বাড়তি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে বলে সাম্প্রতিক সমুদ্র‑গবেষণা সতর্ক করেছে, যার ফল—প্রতিবছর গ্রীষ্মের শেষে প্রবাল ব্লিচিংয়ের সাদা গ্লানি । প্রবাল যখন মরে যায়, তা আর শুধু রং হারায় না; হারিয়ে ফেলে মাছের আবাস, ভেঙে পড়ে সাগরের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ‑ব্যূহ।
মানুষের পদচিহ্ন: পর্যটন, বর্জ্য ও বেহাল শাসন
বর্তমানে দ্বীপে স্থায়ী বাসিন্দা আনুমানিক ছয় হাজার; তাদের অর্ধেকের জীবিকা পর্যটননির্ভর । কিন্তু পর্যটকের সঙ্গে আসে প্লাস্টিক‑বোতল, পলিথিন আর ডিজেল জেনারেটরের কালো ধোঁয়া। রাতে জেনারেটরের শব্দে ঢেকে যায় সমুদ্রের নার্গিস, আলোর ঝলকে পথ ভুলে যায় কচ্ছপ‑শিশু; সকালে বেলাভূমি পরিণত হয় ফেলে‑আসা চিপসের প্যাকেট আর গৃহস্থালি বর্জ্যের ভাগাড়ে। পর্যটক সীমা বেঁধে দিতে ২০২৪‑এ সরকার দৈনিক সর্বোচ্চ ২,০০০ জনের কোটা আর নভেম্বর‑ফেব্রুয়ারি রাতযাপন নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও বাস্তবায়ন এখনো অনিয়মিত ।
রক্ষা করার লড়াই: আইনের ঘেরাটোপ
২০১৯‑এ পরিবেশ মন্ত্রণালয় সেন্ট মার্টিনকে ‘ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া’ ঘোষণার পাশাপাশি দ্বীপ ও আশপাশের ১,৭৪৩ বর্গকিলোমিটার জলাঞ্চলকে মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছে । নীতিমালা অনুযায়ী প্রবাল ভাঙা, রৌদ্র‑বিছানায় বিচিং পার্টি, সীফুড‑বুফেতে হরিণ শিকার সবই নিষিদ্ধ। কিন্তু মানবসম্পদ ও বাজেট‑ঘাটতিতে টহল সীমিত; ‘আইন আছে, বাস্তব নেই’—অভিযোগ করছেন মাঠ‑পর্যায়ের কর্মীরা।
স্বপ্নের দিগন্ত: টিকে থাকার সাতটি পথ
১) অনলাইন পারমিট‑ভিত্তিক পরিবেশ‑সহনশীল পর্যটন; ২) দ্বীপের প্লাস্টিক ফেরত‑নীতি; ৩) স্থানীয় নার্সারিতে প্রবাল পুনঃস্থাপন; ৪) সামুদ্রিক শৈবাল‑চাষ ও সামুদ্রি মধু উৎপাদনে বিকল্প আয়; ৫) কচ্ছপের জন্য আলো‑দূষণ মুক্ত রাত; ৬) ড্রোন‑ভিত্তিক রিয়েল‑টাইম মনিটরিং; ৭) গবেষণায় বেসরকারি‑বিশ্ববিদ্যালয় অংশীদারি—এসব উদ্যোগ স্বপ্নের মতো শোনালেও নীতি‑সমর্থন ও জনগণের অংশগ্রহণ পেলে বাস্তব হতে পারে।
সেন্ট মার্টিনের গল্পটা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য ও মানবচাপের চরম দ্বন্দ্ব। প্রবাল‑চাদরের ওপর গড়ে ওঠা দ্বীপ আজও টিকে আছে, তবে জড়িয়ে আছে ভাঙন, উষ্ণতা ও অনিয়ন্ত্রিত লোভের ফাটলে। মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া ঘোষণায় দুর্বল একটি আশার আলো জ্বলছে—যদি তা রক্ষার দায় সবাই নিতে পারে। প্রবাল, কচ্ছপ আর মানুষের সহাবস্থানের সেই দুর্লভ সূর্যাস্ত এখনও ডুবে যায়নি; তাকে বাঁচিয়ে রাখাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।