সারাক্ষণ রিপোর্ট
টেকনাফের নাফ নদীর পাড়ে ভোরের কুয়াশা ভেদ করে এখন আর পাখিদের সুর শোনা যায় না। বদলে শোনা যায় দলে দলে কাঠভাঙার শব্দ, জায়গায় জায়গায় টিন‑পলিথিনের ক্যাম্পের ভেতরের কোলাহল। ২০১৭‑এর আগস্টে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনিয়ন্ত্রিত প্রবাহের পর ছয় বছরে বদলে গেছে পুরো এক ভূপ্রতিবেশ। বনভূমির ঘন সবুজ আজ ধূসর‑বাদামি, পাহাড় গিলে নিয়েছে কাঁচা রাস্তা, পলি‑বর্জ্যে শুকিয়ে যাচ্ছে ঝিরি‑ছড়া। এই পরিবর্তন মানুষের দৃষ্টি এড়ালেও প্রকৃতি কিন্তু তার খেসারত বুঝিয়ে দিচ্ছে বন্যা, ভূমিধস আর জীববৈচিত্র্য হ্রাসের মাধ্যমে।
প্রবাহের চাপ ও জমির পুনর্বিন্যাস
উখিয়া‑টেকনাফে বর্তমানে ৯ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা ৩৪টি ক্যাম্পে বাস করছেন; এলাকার গড় জনঘনত্ব দাঁড়িয়েছে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৪০ হাজার। অতিরিক্ত মানুষের ঠিকানার জায়গা করে দিতে প্রথম তিন বছরে ৫ হাজার ৮৩৫ একর বনভূমি আইনগতভাবে কেটে ফেলা হয়। সাম্প্রতিক পরিবেশ‑মন্ত্রণালয় ও বন বিভাগের সমন্বিত হিসাব বলছে, ২০২৪ শেষ নাগাদ ক্ষতিগ্রস্ত বনভূমি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার একরেরও ওপরে—এর মধ্যে প্রাকৃতিক বন প্রায় ৮ হাজার একর এবং সামাজিক বনায়ন ৪ হাজার একর।
বন‑পাহাড়ের ক্ষয়
• ব্যাপক বৃক্ষচ্ছেদ ও বাঁশ‑কাটা চলতে থাকায় রামু‑টেকনাফ বনের স্থায়ী সবুজ ঢাল ৪০ শতাংশের বেশি হারিয়েছে।
• পাহাড় সমতল করার ফলে বর্ষাকালে নতুন ধসের মোড় তৈরি হয়েছে; ২০২2‑২৫ পর্যন্ত অন্তত ৩৮টি ছোট‑বড় ভূমিধস ক্যাম্প এলাকায় ঘটেছে।
• সমতলভূমিতে পলি জমা ঝুঁকি বেড়েছে, ফলে ধান ও লবণ চাষ উভয়ই ব্যাহত হচ্ছে।
হাতি‑করিডর সংকুচিত, বন্যপ্রাণীর জীবন হুমকিতে
নাফ নদী হয়ে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত এশীয় হাতি করিডরের মাঝখানে এখন ক্যাম্পের কংক্রিট বাঁধা। অন্তত ৪০টি বন্য হাতি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় মানুষ‑হাতি সংঘাত বেড়েছে; সাম্প্রতিক হিসেবে ২০১৮ থেকে ২০২৫ মধ্য পর্যন্ত ১৭টি হাতি ও ১৩ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বন‑নির্ভর হরিণ, শকুন, বিরল সরীসৃপ—সবকটি প্রজাতিই বাসস্থান সংকটে পড়েছে।
পানি‑মাটি দূষণ ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি
গভীর নলকূপের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে গেছে; মার্চ‑এপ্রিল শুকনো মৌসুমে অনেক টিউবওয়েলই পানি দিতে ব্যর্থ হয়। অপরিকল্পিত নর্দমা ও প্লাস্টিক‑বর্জ্য ঝিরি‑ছড়া বন্ধ করে দিয়েছে; এতে মিষ্টি পানির মাছ, বিশেষ করে বুবুজ (স্থানীয় ছোট চেলা) প্রায় বিলুপ্তির পথে। কাদা‑পানি জমে ম্যালেরিয়া‑ডেঙ্গু সংক্রমণের ক্ষেত্র তৈরি করছে।
অর্থনৈতিক ভাঙচুর
বন উজাড় ও প্রতিবেশব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বন বিভাগের হিসাবমতে আর্থিক ক্ষতি ইতোমধ্যে ১.১ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে, যা বাংলাদেশের একটি জেলাভিত্তিক বার্ষিক জিডিপির প্রায় সমান। হাতি করিডর নষ্ট হওয়ার কারণে ভবিষ্যৎ ইকো‑ট্যুরিজম সম্ভাবনাও প্রায় নিঃশেষ।
পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ ও বাস্তব চিত্র
• ২০১৯‑এ শুরু হওয়া ৩ কোটি বনজ চারা রোপণের লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪৫ ভাগ এখনো টিকে আছে; বাকিটি রোপণের আগেই ক্যাম্প‑সম্প্রসারণে হারিয়ে গেছে।
• শরণার্থীদের কাছে ২ লাখ এলপিজি সিলিন্ডার পৌঁছালেও মোট জ্বালানি‑চাহিদার অর্ধেকও এতে মেটেনি; তাই কাঠ‑জ্বালানি নির্ভরতা স্থায়ী হয়ে আছে।
• ‘পরিবেশ‑সহনশীল ক্যাম্প মডেল’ পরীক্ষামূলকভাবে চালু হলেও বৃষ্টির পানি আবদ্ধ থাকায় বহুরোগের প্রাদুর্ভাব।
মানবিক সংকট বনাম পরিবেশের ভারসাম্য
পরিবেশবিদদের মতে, আপাতত ক্যাম্প পুনর্বিন্যাস এবং জ্বালানি‑বিকল্পের ওপর জোর না বাড়ালে বন‑পাহাড় ফিরিয়ে আনা যাবে না। অন্যদিকে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, নিরাপদ প্রত্যাবাসন এবং মানবিক সহায়তা নিশ্চিত ছাড়া ক্যাম্পের পরিবেশ‑ঋণ (environmental debt) শোধ করা অসম্ভব।
পথ খুঁজে পাওয়ার নির্দেশনা
১. জরুরি ভিত্তিতে পাহাড়ের সংযোগস্থলে ‘ইকো‑বাফার জোন’ ঘোষণা করে সব ধরনের নির্মাণ বন্ধ।
২. এলপিজি ভর্তুকি ও স্কেল‑আপড ক্লিন‑কুকিং স্টোভ কর্মসূচি বাড়িয়ে রোজ এরিয়া কাঠ‑ব্যবহার অর্ধেকের কমে আনা।
৩. বন পুনর্গঠনের কাজটি শুধু চারা রোপণে সীমিত না রেখে আগের প্রাকৃতিক প্রজাতি পুনঃস্থাপনের দিকে নজর।
৪. মানবিক সহায়তায় গ্রিন প্রকিউরমেন্ট নীতিমালা অনুসরণ করে প্লাস্টিক‑বর্জ্য শূন্য ক্যাম্প উদাহরণ তৈরি।
৫. স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বন সেবাদাতা (forest steward) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে বিকল্প আয়‑সূত্র সৃষ্টি, যাতে উজাড় বন্ধ হয়।
সর্বোপরি, টেকনাফের বন‑পাহাড়‑নদী একসময় স্থানীয় শ্রুতি গাঁথায় পরিচিত ছিল ‘সবুজ সীমানা’ হিসেবে। আজ সেখানে ধূলো, পলি আর প্লাস্টিকের স্তূপ। রোহিঙ্গা সংকট নিঃসন্দেহে মানবিক, কিন্তু এর পরিবেশ‑খেসারত বহুপক্ষীয়: খাদ্য নিরাপত্তা থেকে জীববৈচিত্র্য, এমনকি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্লাইমেট‑সহনশীলতাও ঝুঁকির মুখে। সংহতি, দূরদর্শিতা ও বাজেট প্রধান্য—এই তিনকে একত্রে নিয়ে পরিকল্পিত উদ্ধার কর্মসূচি না নিলে, টেকনাফের সবুজ হয়তো আর ফিরবে না।
আর তাই সব মিলেএখানে তৈরি হয়েছে এক জটিল অংক, মানুষ বাঁচতে এসেছে অথচ প্রকৃতি মরছে; দুটির ভারসাম্য ফেরানোর উদ্যোগ এর অঙ্কটির সমাধান অজানা এবং অধরা।